× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

সরেজমিন পঙ্গু হাসপাতাল

পা হারানো রাকিব-নাজিমের সামনে অজানা ভবিষ্যৎ

সাইফ বাবলু

প্রকাশ : ২৭ জুলাই ২০২৪ ১৩:০৮ পিএম

আপডেট : ২৭ জুলাই ২০২৪ ১৩:৩৫ পিএম

কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার গুলিতে আহত হওয়ার পর পা কেটে ফেলতে হয় রাকিবের। শুক্রবার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে। প্রবা ফটো

কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার গুলিতে আহত হওয়ার পর পা কেটে ফেলতে হয় রাকিবের। শুক্রবার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে। প্রবা ফটো

ওমানে গিয়ে মামার সেলুনে চাকরি করার স্বপ্ন নিয়ে গত পাঁচ মাস ধরে সেলুনে চুল কাটার কাজ শিখছিলেন কুমিল্লার বরুড়া থানার কবির হোসেনের কিশোর ছেলে রাকিব। বিদেশ যাওয়ার জন্য বয়স বাড়িয়ে পাসপোর্টও করেছেন। আর কিছুদিনের মধ্যে ওমান যাওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার গুলিতে আহত হওয়ার পর পা কেটে ফেলতে হয়েছে রাকিবের। এখন এক পা হারিয়ে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের (পঙ্গু হাসপাতালের) বেডে শুয়ে নিজের অনিশ্চিত জীবনের কথা ভেবে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন রাকিব। তারই মতো আরেক কিশোর নাজিমেরও এক পা কেটে ফেলতে হয়েছে গুলি লাগার কারণে।

রাকিব-নাজিমের মতো পা কেটে ফেলতে হয় কি না তা নিয়ে হাসপাতালের বেডে শুয়ে উদ্বেগে দিন কাটাচ্ছেন আরও অনেকে। উদ্বেগের সঙ্গে ভর করেছে আতঙ্কও। কারণ এই হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের ফিঙ্গার প্রিন্ট, আইরিশ ও ছবিসহ নাম ঠিকানা সংগ্রহ করছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা।

সরেজমিন দেখা যায়, পঙ্গু হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি-২ ওয়ার্ডে ৫২ জন বিভিন্ন বয়সি রোগী ভর্তি রয়েছে। যাদের অধিকাংশ পায়ে ও উরুতে গুলিবিদ্ধ। আন্দোলনের সময় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার গুলিতে আহত হয়ে আরও রোগী ভর্তি রয়েছে ক্যাজুয়ালটি-১ সহ কয়েকটি ওয়ার্ডে। গত ১৭ জুলাই থেকে এ হাসপাতালে পাঁচ শতাধিক গুলিবিদ্ধ মানুষ এসেছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। যারা বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। এর মধ্যে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে এই হাসপাতালে। বাকি রোগীদের মধ্যে ২৭০ জনকে ভর্তি রেখে চিকিৎসাসেবা দিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তবে অন্য একটি সূত্র জানিয়েছে, ওই হাসপাতালে ১৭ জুলাই থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত এক হাজারের বেশি গুলিবিদ্ধ রোগী এসেছে। তাদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে নার্স চিকিৎসকদের হিমশিম খেতে হয়েছে। আহত রোগীদের রক্তের চাহিদা মেটাতে গিয়ে হাসপাতালটির ব্লাড ব্যাংকে বিভিন্ন গ্রুপের রক্তের সংকট দেখা দেয়।

পঙ্গু হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৭ জুলাই থেকে যারা এই হাসপাতালে এসেছেন তাদের বেশিরভাগ গুলিবিদ্ধ অবস্থায় এসেছেন। ১৭ জুলাই থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত পাঁচ দিনে হাসপাতালটিতে সংঘর্ষে আহত ১ হাজার ২৬৯ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। মিরপুর, মোহাম্মদপুর, উত্তরা, বাড্ডা, নারায়ণগঞ্জ, যাত্রাবাড়ী, রামপুরাসহ বিভিন্ন এলাকার রোগীদের চাপ ছিল এখানে।

তবে নিটোর (পঙ্গু হাসপাতাল) পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী শামীম উজজামান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে জানিয়েছেন, তাদের হাসাপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে বর্তমানে ৫৯ জন ভর্তি রয়েছেন। তাদের অধিকাংশ গুলিবিদ্ধ। চিকিৎসা নিয়েছেন আরও ২৭০ জনের মতো।

শুক্রবার (২৬ জুলাই) দুপুর ১২টার দিকে হাসপাতালে গেলে ক্যাজুয়ালটি ২ (পুরুষ) ওয়ার্ডের চিকিৎসকেরা জানান, গত দুদিন ধরে অন্যান্য ওয়ার্ডে ভর্তি রোগীদেরও এ ওয়ার্ডে আনা হয়। রোগীদের মধ্যে শিক্ষার্থী ছাড়াও রিকশাচালক, দিনমজুর, চাকরিজীবীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ রয়েছে। আহতের তারা সাধ্যমতো চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন।

ক্যাজুয়ালটি-২ ওয়ার্ড ঘুরে দেখা যায়, একটি বেডে শুয়ে আছেন পা হারানো কিশোর রাকিব। পাশে বসে আছেন তার বাবা কবির হোসেন। কাটা পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা। এ প্রতিবেদককে দেখার পর সেই পা ঢেকে ফেলেন। ছবি তুলতে চাইলে রাকিবের এক স্বজন বলেন, ভাই ছবি তুইলেন না। আমরা বড় বিপদে আছি। পরে কথা হয় রাকিবের বাবা কবির হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, দুই ছেলের মধ্যে রাকিব বড়। তিনি ছোট্ট একটি মুদি দোকান করেন নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে। ছেলেকে ওমানে তার শ্যালকের কাছে কাছে পাঠিয়ে দেবেন বলে পাঁচ মাস ধরে সেলুনে কাজ শেখাচ্ছিলেন। তার মামা কয়েক বছর হলো ওমানে থাকে। সেখানে তার সেলুনের দোকান। কিছুদিনের মধ্যেই বিদেশে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন সব শেষ হয়ে গেছে। ছেলের এক পা কেটে ফেলতে হয়েছে। এখনও পুরোপুরি সুস্থ হয়নি। ছেলে বাঁচবে কি না এখন তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করছেন।

রাকিবের এক বন্ধু বলেন, শনিবার (২০ জুলাই) সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় বেশ ঝামেলা হচ্ছিল। রাকিব সন্ধ্যার দিকে সেলুন থেকে বের হয়ে বাসায় ফিরছিল। ওই সময় গুলি হচ্ছে দেখে সে একটি বৈদ্যুতিক খুঁটির আড়ালে আশ্রয় নেয়। হঠাৎ একটি গুলি এসে তার উরুতে লাগে।

ক্যাজুয়ালটি-২ ওয়ার্ডের ১৯ নম্বর বেডে ভর্তি আরেক গুলিবিদ্ধ রোগী নাজিমেরও এক পা কেটে ফেলতে হয়েছে। তার রিকশাচালক বাবা দুলাল মিয়া জানান, তিন ছেলের মধ্যে সবার বড় নাজিম। চিটাগং রোডে একটি দোকানে এমব্রয়ডারির দোকানে কাজ করেন। ২০ জুলাই দোকান থেকে ফেরার সময় তার পায়ে গুলি লাগে। নানা হাসপাতাল ঘুরে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করানো হলে অস্ত্রোপচার করে তার একটি পা কেটে ফেলতে হয়েছে।

দুলাল মিয়া জানান, অভাবের সংসারে ছেলের ৮ হাজার টাকা বেতনের চাকরিটি ভরসা জোগাত। নিজে রিকশা চালিয়ে যা রোজগার করেন তার সঙ্গে ছেলের বেতনের টাকা মিলিয়ে তাদের সংসার চলত। এখন এই পঙ্গু ছেলের ভারও তাকে সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে। ছেলের সঙ্গে হাসপাতালে থাকার কারণে তার গত কয়েক দিনের রোজগারও বন্ধ।

হাবিবের রোজগারে সংসার চলত 

রামপুরার বনশ্রীর এ ব্লকে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন হাবিব। শিক্ষার্থীদের আইএলটিএস পরীক্ষার বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটি কনসালটেন্সি করে। এসএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করার পর অসুস্থ বাবা শাহিন মিয়া আর মা আম্বিয়ার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব তার ওপর পড়ে। বাবা তিনবার স্ট্রোক করেছেন। কাজ করতে পারেন না। ১০ হাজার টাকা বেতনের মধ্যে বেশিরভাগটাই ময়মনসিংহে থাকা বাবা-মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিতেন। নিজে থাকতেন অফিসে। গুলিবিদ্ধ হয়ে হাবিব এখন পঙ্গু হাসপাতালে। বেতনের টাকা আর প্রতিষ্ঠানের কিছু আর্থিক সহায়তায় চলছে চিকিৎসা। আপাতত রোজগার বন্ধ। কাজ না করলে বেতনও পাওয়া যাবে না। হাবিবকে নিয়েই এখন চরম দুশ্চিন্তায় রয়েছে তার পরিবার।

গুলিবিদ্ধের কেউ ছাত্র, কেউ শ্রমজীবী

পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে পঙ্গু হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছেন ভোলার লালমোহনের কালমা ইউনিয়নের ডাওরী বাজার এলাকার জামাল মিয়ার ছেলে রায়েন। মোহাম্মদপুর এলাকায় রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। মোহাম্মদপুর টাউন এলাকায় কাজ শেষ করে ফেরার সময় গুলিবিদ্ধ হন। চার দিন আগে তার দাদি হাজেরা বেগম মারা যান দেশের বাড়িতে। হাসপাতালে ভর্তি থাকায় দাদিকে শেষ দেখাও দেখতে পারেননি। ছেলেকে হাসপাতালে রেখেই বাবা জামাল গেছেন মাকে দাফন করতে। খালা ঝরনা বেগম রায়েনের খোঁজ-খবর রাখছেন। সেই খালা জানান, মোহাম্মদপুর টাউন হল এলাকা দিয়ে বাসায় ফেরার পথে রায়েন গুলিবিদ্ধ হয়। উরুতে গুলি লেগে হাড় ভেঙে বের হয়ে গেছে।

ভোলার ইলিশার বাসিন্দা সিরাজের স্কুল পড়ুয়া ছেলে সিফাত। ক্যাজুয়ালটি-২ ওয়ার্ডে ভর্তি। পল্লবী মাজেদুল ইসলাম মডেল হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেণির এই শিক্ষার্থীর বাবা সিরাজ পেশায় সিকিউরিটি গার্ড। থাকেন পল্লবী এলাকায়। গুলিবিদ্ধ সিফাত জানান, ১৮ জুলাই সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় এক বন্ধুর বাসায় গিয়েছিলেন। ফেরার সময় সহিংসতার মধ্যে তার পায়ে গুলি লাগে।

একইভাবে গুলিবিদ্ধ হন উত্তরা হাইস্কুল থেকে এবার এইচএসসি পরীক্ষার্থী মো. রাকিব উদ্দিন। তার স্বজনরা জানায়, রাকিবের আরও কয়েকটি পরীক্ষা বাকি রয়েছে। গুলিতে আহত হওয়ার কারণে এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে তার।

কৃষক আরিফ সরকারের ছেলে ইমন ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী। থাকেন যাত্রাবাড়ী এলাকায় মামার কাছে। ইমন জানান, ১৯ জুলাই নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বের হয়েই সংঘর্ষে মধ্যে পড়ে যান। ওই সময় একটি গুলি এসে তার পায়ে লাগে। মুসল্লিরা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে আনেন। তার বাবা আরিফুল ইসলাম জানান, ছেলের চিকিৎসার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গ্রামের বাড়িতে চারটি ছাগল বিক্রি করেছেন। এ পর্যন্ত লক্ষাধিক টাকা খরচ হয়েছে।

ভর্তি রোগীদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেওয়ার অভিযোগ

পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীদের স্বজনরা জানিয়েছেন, দুদিন আগে পঙ্গু হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভর্তি সব রোগীর ফিঙ্গারপ্রিন্ট, চোখের মণির ছবি নিয়েছেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন। এ ছাড়া সব রোগীর তথ্য নিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থা। গতকাল সরেজমিন দেখা যায়, এসব কারণে ভর্তি রোগীদের স্বজনরা আতঙ্কিত হয়ে আহতদের পাশে সার্বক্ষণিক পাহারায় রয়েছেন। তাদের মতে, তারা নানাভাবে খবর পাচ্ছেন যে আহত রোগীদের গ্রেপ্তার করা হতে পারে।

একজন রোগীর স্বজন জানান, পুলিশ এসে কয়েক দফায় তার ছেলের ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও চোখের ছাপ নিয়েছে। সেই সঙ্গে ছবিও তুলেছে। নাম-ঠিকানা নিয়ে গেছে। তিনি শুনেছেন, সবার কাছ থেকেই তথ্য নেওয়া হয়েছে। এটা নিয়ে তিনি বেশ চিন্তায় আছেন।

জানা গেছে, ঢাকার সব সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে আন্দোলন চলাকালে যেসব শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ চিকিৎসা নিয়েছেন তাদের সবার নাম ঠিকানা সংগ্রহ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহতদের বিষয়েও তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা