কূটনৈতিক প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১১ জুলাই ২০২৪ ০৯:২৫ এএম
আপডেট : ১১ জুলাই ২০২৪ ০৯:৩৩ এএম
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার বেইাজংয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ সময় দুই নেতা হাত মিলিয়ে পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানান। ছবি : পিএমও
বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক সুবিধার চারটি প্যাকেজসহ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে দৃঢ় সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। গতকাল বুধবার বেইজিংয়ের গ্রেট হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে এই ঘোষণা দেন চীনের প্রেসিডেন্ট। গ্রান্ট বা সহায়তা, সুদমুক্ত ঋণ, কনসেশনাল বা ছাড়যুক্ত ঋণ ও বাণিজ্যিক ঋণ- এই চার ধরনের অর্থনৈতিক সুবিধার একটি প্যাকেজ দেওয়ার ঘোষণা দেন শি জিনপিং। সেই সঙ্গে নিজে থেকেই বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসনে সর্বোচ্চ সহযোগিতা দেওয়ার কথা বলেছেন তিনি। এ সময় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং প্রয়োজনে আরাকান সেনাদের সঙ্গেও কথা বলবেন বলে জানান শি জিনপিং। গতকাল বিকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বেইজিংয়ের সেন্ট রেজিস হোটেলে প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব কথা জানান। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান ও প্রেস সচিব নাঈমুল ইসলাম খান উপস্থিত ছিলেন।
এদিন বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে চলমান ‘কৌশলগত অংশীদারত্ব’ থেকে ‘বিস্তৃত কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারত্বে’র লক্ষ্যে ২১টি দলিল স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর মধ্যে ২টি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) নবায়ন এবং আরও ৭টি প্রকল্পের ঘোষণা রয়েছে। গতকাল বেইজিংয়ের গ্রেট হল অব দ্য পিপলে দুই দেশের মধ্যে প্রতিনিধি পর্যায়ের আলোচনার পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াংয়ের উপস্থিতিতে দলিলগুলো সই হয়। পাশাপাশি অর্থনৈতিক সহযোগিতার অংশ হিসেবে বাংলাদেশকে ১০০ কোটি আরএমবি অর্থনৈতিক সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন চীনের প্রধানমন্ত্রী।
গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াংয়ের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেন। গ্রেট হল অব দ্য পিপলে বৈঠক দুটি অনুষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াংয়ের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের জন্য গ্রেট হল অব দ্য পিপলে পৌঁছলে তাকে লাল গালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সেখানে স্বাগত জানান চীনের প্রধানমন্ত্রী। দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় মূলত রোহিঙ্গা ইস্যু, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের পাশাপাশি বিভিন্ন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। প্রতিনিধি পর্যায়ের বৈঠকের পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং চীনের প্রধানমন্ত্রী নথি বিনিময় প্রত্যক্ষ করেন। বৈঠক প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ জানান, চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং বলেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয় চীন। এই প্রেক্ষাপটে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন তিনি।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ জানান, প্রধানমন্ত্রীর এই চীন সফর শতভাগ সফল হয়েছে। চীনের প্রেসিডেন্ট বৈঠকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের উন্নয়নকে অভূতপূর্ব বর্ণনা করেন এবং চীনা সহায়তা অব্যাহত থাকবে বলেও জানান। শি জিনপিং বলেন, ২০২৫ সালে চীন-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছরপূর্তিতে সম্পর্ককে দ্বিতীয় পর্যায়ে উন্নীত করে এ উদযাপনকে অর্থবহ করতে তারা প্রস্তুত। চীনের প্রেসিডেন্ট ‘গুড গভর্নেন্স নিডস গুড পার্টি’ বা ‘সুশাসনের জন্য ভালো দল’ মন্তব্য করে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যোগাযোগ বৃদ্ধি ও বন্ধনের ওপর জোর দেন। পাশাপাশি বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ, কারিগরি, কৃষি ও উৎপাদন খাতে সহায়তা এবং ছাত্রবৃত্তি বৃদ্ধির আশ্বাস দেন শি জিনপিং। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামের আনোয়ারায় চীনের জন্য এককভাবে বরাদ্দ ৮০০ একর জমিসহ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও আইটি ভিলেজগুলোতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং বাংলাদেশ থেকে পাট ও চামড়াজাত পণ্য, ফার্মাসিউটিক্যালস, সিরামিক, আম ও অন্যান্য ফলসহ পণ্য আমদানি বৃদ্ধির মাধ্যমে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার আহ্বান জানালে চীনের প্রেসিডেন্ট ইতিবাচক সাড়া দেন।
উল্লেখ্য, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠকের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়েছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর। সফর সংক্ষিপ্ত করে বুধবার রাতেই প্রধানমন্ত্রী দেশের পথে রওনা দেন। এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, কন্যা সায়মা ওয়াজেদ বেশি অসুস্থ হওয়ার কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার চীন সফরের সকল অনুষ্ঠান অপরিবর্তিত রেখে শুধু ১১ তারিখ সকালের পরিবর্তে ১০ জুলাই রাতে বাংলাদেশ বিমানের একটি বিশেষ ফ্লাইটে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
চীনের সঙ্গে স্বাক্ষরিত স্মারকগুলো
ডিজিটাল অর্থনীতিতে বিনিয়োগ সহযোগিতা জোরদার করার বিষয়ে সমঝোতা, চায়না ন্যাশনাল ফাইন্যান্সিয়াল রেগুলেটরি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এনএফআরএ) এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে ব্যাংকিং ও বীমা নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত সমঝোতা, বাংলাদেশ থেকে চীনে তাজা আম রপ্তানির জন্য উদ্ভিদ স্বাস্থ্য সম্পর্কিত (ফাইটোস্যানিটারি) উপকরণ বিষয়ে প্রটোকল, অর্থনৈতিক উন্নয়ন নীতি সহায়তা ক্ষেত্রে সমঝোতা, বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ সহায়তা সমঝোতা, বাংলাদেশে প্রকল্পে চায়না-এইড ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টারের ‘সম্ভাব্যতা সমীক্ষা’ বিষয়ে আলোচনার কার্যবিবরণী, চীনের সহায়তায় ষষ্ঠ বাংলাদেশ-চায়না মৈত্রী সেতু সংস্কার প্রকল্পপত্র বিনিময়, নাটেশ্বর প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা পার্ক প্রকল্পে চায়না-এইড কনস্ট্রাকশনের সম্ভাব্যতা সমীক্ষাপত্র বিমিময়, চীনের সহায়তায় নবম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু প্রকল্পপত্র বিনিময়, মেডিকেল সেবা এবং জনস্বাস্থ্য বিষয়ে সহযোগিতা শক্তিশালীকরণ সমঝোতা, অবকাঠামোগত সহযোগিতা জোরদারে সমঝোতা, গ্রিন অ্যান্ড লো-কার্বন উন্নয়ন বিষয়ে সহযোগিতা, বন্যার মৌসুমে ইয়ালুজাংবু (ব্রহ্মপুত্র) নদীর হাইড্রোলজিক্যাল তথ্য বাংলাদেশকে দেওয়ার বিধি বিষয়ক সমঝোতা স্মারক নবায়ন, চীনের জাতীয় বেতার ও টেলিভিশন প্রশাসন এবং বাংলাদেশের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমঝোতা, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি) এবং বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা, চায়না মিডিয়া গ্রুপ এবং বিটিভির মধ্যে সমঝোতা, সিনহুয়া নিউজ এজেন্সি ও বিটিভির মধ্যে সমঝোতা, চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা সিনহুয়া এবং বাংলাদেশের জাতীয় সংবাদ সংস্থা বাসসের মধ্যে সমঝোতা, সিনহুয়া সংবাদ সংস্থা এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনের মধ্যে সমঝোতা, চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমঝাতা স্মারক নবায়ন, টেকসই অবকাঠামো উন্নয়নে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ বিষয়ে সমঝোতা এবং চীনের শ্যানডং অ্যাগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটির সাথে গাজীপুরস্থ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সমঝাতা।
সাতটি ঘোষণাপত্র
চীন-বাংলাদেশ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি বিষয়ে যৌথ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সমাপ্তি ঘোষণা, চীন-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ চুক্তি ত্বরান্বিত করা নিয়ে আলোচনা শুরুর ঘোষণা, ডিজিটাল কানেক্টিভিটি প্রকল্পের জন্য টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্কের আধুনিকীকরণের সমাপ্তির ঘোষণা, ডাবল পাইপলাইন প্রকল্পের সঙ্গে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিংয়ের ট্রায়াল রান সমাপ্তির ঘোষণা, রাজশাহী ওয়াসা সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট চালুর ঘোষণা, বাংলাদেশে লুবান ওয়ার্কশপ নির্মাণের ঘোষণা এবং চীনের শ্যানডং অ্যাগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটির সাথে গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সহযোগিতার ঘোষণা।
অর্থমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা, বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী, পররাষ্ট্র সচিব, অন্যান্য সচিববৃন্দসহ প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা অনুষ্ঠানে যোগ দেন।
বেইজিংয়ের সেন্ট রেজিস হোটেলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের উপস্থিতিতে চীনের শ্যানডং অ্যাগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটির সাথে গাজীপুরস্থ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সমঝোতা স্মারকটি স্বাক্ষরের সময় প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মোহাম্মদ তোফাজ্জল হোসেন মিয়া ও চীনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. জসিম উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন।