প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০১ জুলাই ২০২৪ ১০:১৮ এএম
আপডেট : ০১ জুলাই ২০২৪ ১১:০২ এএম
ছবি: সংগৃহীত
ঢাকার বাইরে বাড়ছে লোডশেডিং। জেলা শহরগুলোতে লোডশেডিং তুলনামূলক কম হলেও গ্রামাঞ্চলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা থাকছে না বিদ্যুৎ। এ অবস্থায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন অসহনীয় পরিস্থিতির শিকার গ্রাহকরা। অনেকেই বিদ্যুৎ বিভাগের সমালোচনা করে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এরই মধ্যে গত মঙ্গলবার হামলা হয়েছে সেনবাগে পল্লী বিদ্যুৎ অফিসে। তবে বিদ্যুৎসংশ্লিষ্টদের দাবি, চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম পাওয়ায় লোডশেডিং দিতে হচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে গত শনিবার বিকালে জাতীয় সংসদ অধিবেশনে প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গ্রামে লোডশেডিং না দিয়ে রাজধানীর গুলশান-বনানী-বারিধারাসহ বিত্তশালীদের এলাকায় লোডশেডিং দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন।
সাম্প্রতিক ঝড়ে ভাসমান টার্মিনাল (এফএসআরইউ) ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় গত এক মাস ধরে দিনে গ্যাস সরবরাহ প্রায় ৬০ কোটি ঘনফুট কম। যে কারণে পরিবহন, শিল্প ও বাসাবাড়িতে গুরুতর সংকট দেখা দিয়েছে। ফিলিং স্টেশনগুলোতে গাড়ির লাইন দীর্ঘ হচ্ছে। গ্যাস-স্বল্পতার পাশাপাশি সংস্কারের কারণে কয়লাভিত্তিক একাধিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আংশিক বন্ধ রয়েছে। এতে কমেছে বিদ্যুৎ উৎপাদন। ঢাকার বাইরে এখন লোডশেডিং হচ্ছে ১০-১২ ঘণ্টা। গ্যাস-বিদ্যুৎ দুটিরই সরবরাহ কমে যাওয়ায় গরমে জীবনযাপন কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। অসুস্থ হয়ে পড়ছেন বৃদ্ধ-শিশুরা। শিল্প-কারখানায় উৎপাদন কমার পাশাপাশি ব্যয় বাড়ছে। আষাঢ় মাসের অর্ধেক দিন চলে গেলেও পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ায় আমন ধানের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন কৃষকরা।
এরই মধ্যে রবিবার (৩০ জুন) থেকে এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হয়েছে। কিন্তু গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটে পরীক্ষার্থীদের পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটছে। পরীক্ষা কেন্দ্রগুলোতে বিদ্যুৎ না-ও থাকতে পারে, এমন আশঙ্কায় ছাত্র-ছাত্রীদের মোমবাতি নিয়ে পরীক্ষাকেন্দ্রে আসতে বলা হয়েছে। অন্য শিক্ষার্থীদেরও লেখাপড়া ব্যাহত হচ্ছে।
বর্তমানে ১৫-১৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন হচ্ছে ১৩-১৪ হাজার মেগাওয়াট। এতে দৈনিক ঘাটতি থাকছে ৩ হাজার মেগাওয়াটের মতো। যদিও বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৬ হাজার মেগাওয়াট। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির (পিজিসিবি) হিসেবে গত বৃহস্পতিবার সর্বোচ্চ প্রায় ২ হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং ছিল। শুক্রবার ছুটির দিন থাকায় বিদ্যুতের চাহিদা ছিল কম। ফলে লোডশেডিং কম হয়। তবে লোডশেডিংয়ের সরকারি তথ্য নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ঢাকার বাইরে এলাকাভেদে দৈনিক ১০-১২ ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) চাহিদার চেয়ে আড়াই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম পাচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে অতিরিক্ত লোডশেডিংয়ের কারণে বিদ্যুৎ অফিসে হামলার ঘটনা ঘটছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ভারতের আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৮০০ মেগাওয়াটের একটি ইউনিট বন্ধ আছে। এটি আগামী ৫ জুলাই উৎপাদনে ফিরতে পারে। একই ক্ষমতার দ্বিতীয় ইউনিটে কারিগরি ত্রুটিতে উৎপাদিত হচ্ছে ৩৭০ মেগাওয়াট। দেশের আরেকটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র পটুয়াখালীর পায়রার ৬২২ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি ইউনিট রক্ষণাবেক্ষণে গেছে গত মঙ্গলবার। এতে বরিশাল অঞ্চলে লোডশেডিং বেড়েছে। এটিতে আগামীকাল ২ জুলাই উৎপাদন শুরুর কথা রয়েছে।
বিদ্যুৎ সচিব হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আগামীকালের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে পারে। শিল্পকারখানা-ফিলিং স্টেশনে গ্যাসের সরবরাহ কমায় ঢাকাসহ সারা দেশের ফিলিং স্টেশনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন ধরেও গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। শিল্পকারখানার অবস্থাও শোচনীয়।’ শিল্প মালিকরা বলছেন, এমনিতেই গ্যাসের চাপ থাকে না, এখন তা আরও কমে গেছে। গাজীপুর, কোনাবাড়ী, কাশিমপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের চাপ নেই।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার দেশে গ্যাসের চাহিদা ছিল ৪২০ কোটি ঘনফুট, বিপরীতে সরবরাহ ছিল ২৫৫ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে এলএনজি থেকে পাওয়া গেছে ৬০ কোটি ঘনফুট গ্যাস। গত মাসেও যখন দুটি এফএসআরইউ চালু ছিল, তখন ১১০ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত গ্যাস এলএনজি থেকে সরবরাহ করা হয়। গত ২৭ মে ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে বঙ্গোপসাগরে দুই এলএনজি টার্মিনালের একটির (সামিট গ্রুপের) ক্ষতি হয়। আগামী মাসে মেরামতের পর এটি চালু হতে পারে। সরবরাহ কমায় বিদ্যুতেও গ্যাস সরবরাহ কমেছে। গত বৃহস্পতিবার বিদ্যুতে ৯৭ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়; যা গত মাসেও ছিল ১১০ কোটি ঘনফুটের ওপর। গ্যাস দিয়ে এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। কিন্তু কয়লা ও তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম উৎপাদন করেছে। এর দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, কয়লা ও তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বেশি। দ্বিতীয়ত, বকেয়া পরিশোধ না করায় তেল ও কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো উৎপাদন কম করছে। বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পিডিবির কাছে পায় ১৫ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর পাওনা ৬ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। ভারতের আদানি গ্রুপ ৪ হাজার ১৪০ কোটি টাকা পায়। এ ছাড়া জ্বালানি সংকটে প্রায় ১ হাজার মেগাওয়াট এবং কেন্দ্র মেরামতের জন্য ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম উৎপাদন হচ্ছে।
নোয়াখালী জেলার ৯টি উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অতিরিক্ত লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন গ্রাহকরা। দিনে ১২-১৫ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ থাকছে না অনেক এলাকায়। অতিরিক্ত লোডশেডিংকে কেন্দ্র করে যেকোনো সময় বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মীদের সঙ্গে গ্রাহকদের সংঘর্ষের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু জানিয়েছেন, চলতি অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে ৩১ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে। একই অর্থবছরে এলএনজি খাতে সরকার সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকির দরকার হবে।
পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ‘গ্যাসের সরবরাহ বৃদ্ধির কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ায় পরিস্থিতি আগের চেয়ে সহনীয় হয়েছে। গত বছর গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে সর্বোচ্চ ৬ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা গেলেও এবার তা ৮ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে। এরপরও কিছু লোডশেডিং হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বিদ্যুতের চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। প্রয়োজনে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বাড়িয়ে বিদ্যুতের চাহিদা পূরণের চেষ্টা করা হচ্ছে।’
এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের মোমবাতি ও দিয়াশলাই আনার নির্দেশ দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার মুখে পড়েছে টাঙ্গাইলের মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসান আদর্শ মহাবিদ্যালয়। এটি ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের আওতাভুক্ত পরীক্ষাকেন্দ্র। এখানে ১ হাজার ১৯৭ পরীক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেবেন।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ড বলছে, মোমবাতি-দিয়াশলাই আনার কোনো নির্দেশনা বোর্ড থেকে কেন্দ্রগুলোকে দেওয়া হয়নি। কেন্দ্রে বা পরীক্ষার হলে যা যা প্রয়োজন, তার সব আয়োজন করবেন কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।
এর মধ্যেই তীব্র লোডশেডিংয়ের প্রতিবাদে ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের দাবিতে গত মঙ্গলবার রাতে নোয়াখালীর সেনবাগ পল্লীবিদ্যুৎ অফিসে হামলা চালান স্থানীয়রা। উপজেলার নবীপুর ইউনিয়নের আইচেরটেক এলাকায় পল্লী বিদ্যুতের উপকেন্দ্রে এ হামলায় হতাহত না হলেও কার্যালয়ের জানালার কাঁচ ভেঙে যায়।
বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, জেলায় মোট চাহিদার অর্ধেকের কম সরবরাহ থাকায় লোডশেডিং হচ্ছে। নোয়াখালী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে জেলা শহর ও জেলার ৯ উপজেলায় ৯ লাখ ৪১ হাজার গ্রাহক রয়েছেন। এর মধ্যে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের গ্রাহক ১ লাখ ৬৮ হাজার এবং পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির গ্রাহক ৭ লাখ ৭৩ হাজার। সেনবাগ উপজেলার কাদরা ইউনিয়নের বাসিন্দা ওহিদুল ইসলাম জানান, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৮ ঘণ্টাও বিদ্যুৎ থাকে না। তীব্র গরমে আমাদের খুব কষ্ট হচ্ছে।