প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২০ জুন ২০২৪ ১৯:৫৬ পিএম
আপডেট : ২১ জুন ২০২৪ ১৮:০২ পিএম
বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) মিলনায়তনে বক্তব্য দেন অর্থমন্ত্রী। প্রবা ফটো
কৃষি হচ্ছে বাংলাদেশের আসল জায়গা। কৃষি না হলে বাংলাদেশ চলবে না বলে মন্তব্য করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। তিনি বলেন, দেশকে এগিয়ে নিতে হলে কৃষিকে সামনে রেখেই কাজ করতে হবে। কেননা কৃষিই আমাদের দেশের প্রাণ।
বৃহস্পতিবার (২০ জুন) বেলা ১১টায় রাজধানীর ফার্মগেটে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) মিলনায়তনে ‘বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অর্থনীতি : প্রবৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় জাতীয় বাজেট ২০২৪-২০২৫' শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন। বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতির উদ্যোগে সেমিনারটি অনুষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসানের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, বিশেষ অতিথি ছিলেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু, সম্মানিত অতিথি ছিলেন জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) বাংলাদেশ প্রতিনিধি ড. জিয়াকুন শি, মূল আলোচক ছিলেন সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম, মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিব্যবসা ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম ও স্বাগত বক্তব্য রাখেন মিজানুর রহমান কাজল এবং সেমিনার বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক শুভংকর সাহা।
আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, বাজেট খুব কঠিন জিনিস। এবার অনেক চিন্তা-ভাবনা করে বাজেটটি দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বাজেট নিয়ে বিশ্বব্যাংক বলেছে বাংলাদেশ ভালো করছে। কাজ করতে হলে টাকা দরকার। বিশ্বব্যাংক সেখানে অর্থ লগ্নি করে থাকে। তাদের কথা শুনতে হবে। আপনি টাকা দেন আপনার কথা শুনবো। আবার অনেকেই বলছে বাংলাদেশ দেউলিয়া হয়ে গেছে কিন্তু তা তো হয়নি। বলেছে সরকার পড়ে যাবে, কই সরকার তো পড়ে যায়নি।
অর্থমন্ত্রী বলেন, শেখ হাসিনার সরকার যে বাজেটটি দিয়েছে তা বোঝার চেষ্টা করুন। এটি জনবান্ধন বাজেট। বাজেট এখনো পাশ হয়নি। সেখানে অনেক বিষয় পূণর্বিবেচনার সুযোগ আছে এবং তা করা হবে। অর্থমন্ত্রী বলেন, এবছর এক কোটির উপরে পশু কোরবানি হয়েছে। সব পশু আমাদের নিজেদের। অর্থাৎ দেশ এগিয়ে যাচ্ছে।
কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতিকে আরো কাজ করতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু এটি উদ্বোধন করেছিলেন। আমি জানতাম এ নামে একটি সমিতি আছে কিন্তু তারা কি কাজ করছে জানতাম না। এখন দেখছি তারা ভালো কাজ করছে। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতিও কাজ করছে। তাদের সঙ্গে কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতিকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে।
আহসানুল ইসলাম টিটু বলেন, প্রবৃদ্ধি বাড়লে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। এবারের নির্বাচনী ইশতেহারে মূল্যস্ফীতি সকলের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখাই আমাদের লক্ষ্য। গত ৪ মাস যাবত এক কোটি পরিবারকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য দেওয়া হচ্ছে। এটি সারা দেশে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের উপকার হচ্ছে। এই পণ্য সবার জন্য সম্মানজনক না। এতে ১০-১৫ শতাংশ নিশ্চিত করা যাচ্ছে না, নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পণ্যবিতরণে বর্তমানে সারাদেশে সাড়ে ৭ হাজার ডিলার আছে তা ১০ হাজারে উন্নীত করা হবে। এরপর এসব পণ্য স্থায়ী দোকান থেকে সরবরাহ করা হবে। তাতে সময় যেমন বাঁচবে তেমনি সবাই নিতে পারবে।
তিনি বলেন, কৃষির উৎপাদনে ২৫ শতাংশ ফসল সেচের জন্য ক্ষেতে রেখে আসতে হয়, অর্থাৎ ব্যয় হয়। আমাদের রিজার্ভের ১৪ বিলিয়ন ডলার দিতে হয়েছে সার ও তেল আমদানির কারণে। আমাদের ভূ-উপস্থ পানি ব্যবহার করা হচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, একদিকে কৃষক তার পণ্যের ন্যায্যমূল্য পায় না, আবার ক্রেতারাও সঠিক মূল্যে পণ্য পায় না। এজন্য এ ব্যাপারে সরবরাহ কীভাবে বাড়ানো যায় তা নিয়ে কাজ করতে হবে। পণ্যের উৎপাদনে প্রজেকশন একেকজন
একক ধরনের করে থাকে। অথচ সঠিক চাহিদা নিরুপণ করা না হলে কোন মাসে কোন পণ্যের আমদানি কত করতে হবে তা আগে জানা থাকলে সমস্যার সমাধান করা সহজ হয়। তা ছাড়া পচনশীল পণ্য কীভাবে সংরক্ষণ করা যাবে সে বিষয়ে চিন্তা করতে হবে। তিনি বলেন, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এমন হবে ২০ বছর আগে কেউ চিন্তা করতে পারতো না।
টিটু বলেন, আমাদের প্রবাসী আয় সরাসরি গ্রামে চলে যায়। এজন্য শহরের চেয়ে গ্রামের অর্থনীতি চাঙ্গা হচ্ছে। রাশিয়া, মিয়ানমার থেকে কৃষিপণ্য কীভাবে আনা যায় এজন্য চুক্তি হয়েছে। ভারতের সঙ্গেও চুক্তির কাজ চলতে। গত কয়েক বছর আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম বাড়লেও দেশে বাড়েনি।
বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ২৬ দেশের সঙ্গে ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট করার কাজ চলছে। আমাদের বাজেটটি না পড়েই ৬ তারিখের বাজেট সম্পর্কে ৭ তারিখে সমালোচনা না করে এক বছর সময় দিতে হবে। তিনজন অর্থনীতিবিদ কিন্তু এক হতে পারে না। ভিয়েতনাম বছরে ৪ বিলিয়ন রপ্তানি করতে পারলে আগামী ৩-৪ বছরের মধ্যে আমরা এক বিলিয়ন রপ্তানি করতে পারবো।
সাজ্জাদুল হাসান বিগত ১৫ বছরের বাজেট পর্যালোচনায় করে বলেন, দেশজ উৎপাদন ৬ শতাংশ বেড়েছে। এ সময়ে দারিদ্রের হার ১৮ শতাংশ কমে এসেছে। আগে আয়ু ছিল ৪২ বছর, বর্তমানে তা বেড়ে ৭২ বছর হয়েছে। সরকারি হাসপাতালে শয্যা দ্বিগুণ বেড়ে ৭১ হাজার হয়েছে।
তিনি বলেন, কৃষির উৎপাদন বেড়েছে। শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসারকালে ৩০ লাখ মেট্রিক টন খাদ্য ঘাটতি ছিল, বর্তমানে তা উদ্বৃত্ত রয়েছে। বর্তমান বাজেট নিয়ে তিনি বলেন, এডিপির আকার কিছুটা ছোট করা হয়েছে। কেননা কোভিডকালে বিভিন্ন দেশ ও বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক ছিল কিন্তু বাংলাদেশে ছিল ইতিবাচক।
সারের ভর্তুকি সম্পর্কে বলেন, কৃষকের জন্য ভর্তুকি সঠিকভাবে ব্যবহার হচ্ছে কি না তা দেখতে হবে। প্রান্তিক খামারিরা যাতে ভর্তুকি পায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। শুধু বড় বড় খামারিরা পেলে হবে না।
প্রতিযোগিতা কমিশন সম্পর্কে তিনি বলেন, মনোপলি মার্কেটিং যাতে না হয় তা নিয়ে প্রতিষ্ঠানকে ভালোভাবে কাজের ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
ড. জিয়াকুন শি বলেন, বাংলাদেশে ৪১ শতাংশ শ্রম কৃষিকাজে যুক্ত। এটি এদেশের অন্যতম আয়ের উৎস্য কিন্তু বর্তমানে সমুদ্রের নিম্ন স্তর বৃদ্ধির কারণে কৃষি সমস্যার মুখে পড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
ড. শামসুল আলম বলেন, এ বাজেট পরিমিত সাহসী বাজেট। ৮ম পরিকল্পনার শেষবর্ষে প্রখ্যাপণ অনুযায়ী ৯ লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকার বাজেট হওয়ার কথা ছিল কিন্তু হয়েছে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ২ লাখ কোটি টাকার কম বাজেট হয়েছে।
তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতিতে মানুষ আক্রান্ত আর সরকারও চিন্তিত। এটি উৎপাদন তাড়িত মূল্যস্ফীতি। এরশাদ সরকার সংসদ সদস্যদের জন্যে ট্যাক্স ফ্রি গাড়ি আনা শুরু করেন। বর্তমানে সেখানে ট্যাক্স যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে এজন্য আইন পরিবর্তন করতে হবে।
শামসুল আলম বলেন, ইলেক্ট্রনিক ফিসকেল ট্রানজেকশন চালু হলে ব্যবসায়ীরা ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকি দিতে পারবে না। তা ছাড়া লাইসেন্স নবায়ন করতে হলে ভ্যাট-ট্যাক্সের কাগজ দেখাতে হবে। সাড়ে ৩৮ লাখ টাকার বেশি আয়ের লোকদের বেশি ট্যাক্স দিতে হবে।
বাজেটটির কারণে মূল্যস্ফীতি কেন কমবে এ সম্পর্কে তিনি বলেন, আগে সুদের হার ছিলো ৯ থেকে ৬ শতাংশ আর এখন ১৪ শতাংশ সুদের হার করা হয়েছে। ব্যাংকে ডেপুসিট এক বছরে সাড়ে ৮ শতাংশ বেড়েছে। উৎপাদনে কৃষি যন্ত্রপাতিতে আমদানিতে কর কমানো হয়েছে। খাদ্যপণ্যে উৎসে কর ২ শতাংশ কমানো হয়েছে। এসবের প্রভাব বাজেটে পড়বে।
সামষ্টিক অর্থনীতির ইতিবাচক দিক সম্পর্কে তিনি বলেন, রাজস্ব বাড়ছে, এ বছর বোরো ধানের আবাদ ভালো হয়েছে। শাক-সবজি উৎপাদন ভালো হয়েছে। বাজেটের পর বাজারে পণ্যের দাম বাড়েনি। গত বছরের মে থেকে চলতি মে মাস পর্যন্ত ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। তিনি বলেন, ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি বাড়ার অর্থ হচ্ছে আড়াই লাখ কর্মসংস্থান বৃদ্ধি। তবে শিল্পের কাচামাল সাপ্লাই কমে গেছে।
খেলাপি ঋণ সম্পর্কে বলেন, যা ঋণ দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে ২২ শতাংশ খেলাপি হয়ে পড়েছে। বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলে রোগাক্রান্ত হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে মনোযোগ দিতে হবে।
কর ন্যায়পাল নিয়োগ দিতে হবে দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের কর ন্যায়পাল নিয়োগ দিতে হবে। কেননা মামলা করার ফলে অনেক ট্যাক্স ঝুলে আছে। আমদানি সহজীকরণ করতে হবে। সিন্ডিকেট হয় ঘাটতি হলে। তাই ঘাটতির আগেই আমদানির সুযোগ দিতে হবে।
ডলার সংকটের কারণ অর্থপাচার উল্লেখ করে সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী বলেন, বছরে ৭-৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচার হয়ে যায়। এ কারণে ডলারের সংকট দেখা দিচ্ছে। এসব পাচার বন্ধ করতে পারলে ইতিহাসের অর্থমন্ত্রী অমর হয়ে থাকবেন।
ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, গত ৫২ বছরে দেশে বাজেটের আকার বেড়েছে ১০১৪ গুণ। বর্তমান বাজেটে কৃষিতে ৩ দশমিক ৯ শতাংশ প্রস্তাব করা হয়েছে।