এমপি আনার হত্যা
আলাউদ্দিন আরিফ
প্রকাশ : ২৭ মে ২০২৪ ১১:২৯ এএম
আপডেট : ২৭ মে ২০২৪ ১১:৫৬ এএম
সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার। ছবি : সংগৃহীত
সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড আক্তারুজ্জামান শাহীন ও শিমুল ভূঁইয়া ওরফে আমানুল্লাহ সাইদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রয়েছে এমন বেশ কয়েকজনকে চিহ্নিত করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। যেখানে রয়েছে স্বর্ণ ও ডায়মন্ডের ব্যবসায়ী, দুজন সাবেক সংসদ সদস্য ও বৃহত্তর যশোর অঞ্চলের একাধিক রাজনৈতিক নেতার নাম। তাদের মধ্যে অন্তত আটজনকে এরই মধ্যে গোয়েন্দা নজরদারিতে আনা হয়েছে। তাদের প্রয়োজনমাফিক জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) সূত্রে জানা গেছে।
তদন্ত সূত্র জানায়, শাহীনের গুলশান, বসুন্ধরা ও বারিধারার ফ্ল্যাটের সিসিটিভি ফুটেজ দেখে বেশ কয়েকজনকে সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তারা শাহীনের ফ্ল্যাটে যাতায়াত করতেন। এ ছাড়া তার কোটচাঁদপুরের এলেঙ্গি গ্রামের আলীশান বাগানবাড়িতে যাদের যাতায়াত ছিল তাদেরও চিহ্নিত করা হচ্ছে। শাহীন ও শিমুলের মোবাইল ফোনের কল রেকর্ড (সিডিআর) বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। হত্যাকাণ্ডের আগে-পরে তারা কাদের সঙ্গে কথা বলেছেন তা খতিয়ে দেখে সম্ভাব্য সন্দেহভাজনদের একটি তালিকা করা হয়েছে। এই তালিকায় দুইজন সাবেক সংসদ সদস্য, কয়েকজন স্বর্ণ ব্যবসায়ী ও চোরাকারবারি, চরমপন্থি নেতা, প্রশাসনের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাও রয়েছেন। একই সঙ্গে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে আসা-যাওয়ার সময় তাদের সফরসঙ্গী কারা ছিলেন সেটারও পর্যালোচনা চলছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) হারুন অর রশীদ রবিবার খুনের ঘটনা তদন্তে ভারতে পশ্চিমবঙ্গে যাওয়ার আগে বলেন, আনার হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক চোরকারবারসহ অনেক কারণ আমরা পাচ্ছি। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে কারা লাভবান হয়েছে তাদের একটি তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। যশোর, চুয়াডাঙ্গা ও ঝিনাইদহ সীমান্ত একটি অপরাধপ্রবণ এলাকা। সেখানে প্রায়ই হত্যাকাণ্ড ঘটে। এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে বিভিন্নজন বিভিন্ন কারণ বলছে। আমরা সোর্সনির্ভর ও প্রযুক্তিগত তদন্ত করছি। যদি মনে হয়, এর সঙ্গে স্বর্ণ চোরাচালানের বিষয় আছে তাহলে যাদের নাম আসবে তাদেরও আমরা ডাকব।
স্বর্ণ চোরাচালান যারা করে তাদের আপনারা খুঁজছেন কি না, এমন প্রশ্নে হারুন অর রশীদ বলেন, তদন্তে আনার কিলিংয়ের সঙ্গে অনেকের নাম আসছে। তাদের কেউ কেউ হয়তো সোনা চোরাচালান ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তাদের আমরা তদন্তের আওতায় নিয়ে আসব।
তদন্ত সূত্র জানায়, গুলশান-২-এর ৬৫ নম্বর সড়কের ১৭ বাড়ির ২/বি/১, ঠিকানায় অভিজাত ফ্ল্যাটটি শাহীনের। এ ছাড়া ভাটারা থানার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার এল ব্লকের ৩২ নম্বর রোডের ১৯/২৯ নম্বর বাড়িতে শাহীনের আরেকটি ফ্ল্যাট আছে। ওই ফ্ল্যাটটি অবৈধ মদের বার ও বিনোদনের জন্য ব্যবহার করা হতো। গুলশান ও বসুন্ধরার ফ্ল্যাট দুটি স্বর্ণ ও মাদক চোরাচালানের আস্তানা হিসেবেও ব্যবহার করতেন শাহীন। এ ছাড়া কোটচাঁদপুরের এলেঙ্গি গ্রামে ২৫ বিঘা জমির ওপর তার বিলাসবহুল বাড়িটি স্বর্ণ ও মাদক চোরাচালানের ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এই বাড়ি থেকে গেদে সীমান্ত, জীবননগর, দর্শনা, মহেশপুর জিন্নানগর, সামান্তা, মাটিলা, যাদবপুর, সামুন্দা বাগাডাঙ্গা, শ্যামকুড়াসহ বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে স্বর্ণ চোরাচালান করা হতো।
এই তিনটি বাড়িতে অনেক ভিআইপি, সিআইপি ও প্রভাবশালীদের যাতায়াত ছিল। তিনটি বাড়িতেই ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা (সিসিটিভি) আছে। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে এবং ঢাকার দুটি ফ্ল্যাটের প্রবেশ রেজিস্টার দেখে শাহীনের ঘনিষ্ঠজনদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। এরই মধ্যে তার দুটি ফ্ল্যাট ও এলেঙ্গির বাগানবাড়ি সিলগালা করা হয়েছে।
বিশ্লেষণ হচ্ছে সিডিআর
যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী শাহীনের বাংলাদেশি ও একাধিক বিদেশি নম্বর রয়েছে। তিনি এসব নম্বর থেকে কিলিং মিশন বাস্তবায়নকারী শিমুল ভূঁইয়া, সেলে নিক্সি ওরফে সিলেস্তি রহমানসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। শাহীন ও শিমুলের বাংলাদেশি নম্বরের সিডিআর সংগ্রহ করে সেগুলো বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। তানভীর ওরফে ফয়সালের মোবাইল ফোনের সিডিআর নিয়েও বিশ্লেষণ চলছে। এই প্রযুক্তিগত অনুসন্ধানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা গেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এরই মধ্যে কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া চরমপন্থি নেতা শিমুল ভূঁইয়া, ভাড়াটে কিলার সিয়াম, জিহাদ, ফয়সাল, মোস্তাফিজুর রহমান ফকির ও সেলে নিস্কির পরস্পরের মধ্যে বিশেষ অ্যাপসে যোগাযোগ রাখার তথ্য মিলেছে।
ক্ষোভ জমে ছিল ডা. টুটুলের মৃত্যুতেও
ডিবির রিমান্ডে থাকা শিমুল জিজ্ঞাসাবাদে রবিবার জানিয়েছে, এমপি আনারের ওপর দীর্ঘদিন থেকেই তার ক্ষোভ ছিল। ২০০৯ সালের ২৫ জুলাই র্যাব ঢাকার উত্তরা থেকে পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল-লাল পতাকা) শীর্ষ নেতা ডা. মিজানুর রহমান টুটুলকে আটক করে। ২৭ জুলাই ভোর রাতে নওগাঁয় র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যান টুটুল। বিসিএস ক্যাডার এই চিকিৎসক ছিলেন শিমুলের ভগ্নিপতি। টুটুলের আটক হওয়া ও পরে বন্দুকযুদ্ধে মারা যাওয়ার ঘটনায় এমপি আনারকেই দায়ী মনে করতেন শিমুলসহ এমএল লাল পতাকার নেতারা। আনারের ওপর পুরোনো ক্ষোভ ছিল শিমুলের। প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মরিয়া ছিলেন তিনি।
এ ছাড়াও জিজ্ঞাসাবাদে শিমুল জানান, আনারের ইন্ধনে ২০০৭-০৮ সাল থেকে বিপুলসংখ্যক এমএল লাল পতাকার কর্মী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা যান। আনারের কারণে শিমুল নিজেও বহু বছর আত্মগোপনে ছিলেন। পরে গ্রেপ্তারও হন। সবকিছু মিলিয়ে আনারের ওপর শিমুলের ক্ষোভের মাত্রা ছিল ব্যাপক। তাই যখনই আনারকে হত্যার জন্য শাহীন প্রস্তাব দেন তখন শিমুল তাতে হাসিমুখে রাজি হয়ে যান। শাহীনের পরিকল্পনা অনুযায়ী শিমুল নিজে উপস্থিত থেকে কিলিং মিশন বাস্তবায়ন করেন।
পশ্চিমবঙ্গে ডিবির টিম
আনার হত্যাকাণ্ডের তদন্তে রবিবার সকালে ডিবির তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল পশ্চিমবঙ্গে পৌঁছেছে। দলের নেতৃত্বে আছেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। কমিটির অপর দুই সদস্য হলেনÑ উপকমিশনার আব্দুল আহাদ ও অতিরিক্ত উপকমিশনার সাহিদুজ্জামান।
কলকাতায় পৌঁছে হারুন অর রশীদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাংলাদেশের একজন সংসদ সদস্য পশ্চিমবঙ্গে খুন হয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের প্রতিনিধিদল আমাদের ওখানে গিয়েছে। গ্রেপ্তার আসামিদের সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলেছেন। আমরাও পশ্চিমবঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া আসামিদের সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলার অনুমতি চাইব। হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থলসহ প্রয়োজনীয় জায়গাগুলো দেখব।’ তিনি আরও বলেন, কলকাতায় গ্রেপ্তার হওয়া আসামির সঙ্গে বাংলাদেশে গ্রেপ্তার হওয়া আসামিদের মুখোমুখি করে জিজ্ঞাসাবাদ প্রয়োজন। এক্ষেত্রে আমরা আসামিকে নেওয়ার অনুমতি চাইব। এ ছাড়া প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাদের ভিডিও কলে মুখোমুখি করার চেষ্টা করব। গতকাল বিকালে ডিবির প্রতিনিধিদল ঘটনাস্থল ঘুরে দেখেছে। তারা সেখানকার পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছে।
দুর্গন্ধযুক্ত ব্যাগ উদ্ধার
এদিকে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া কসাই জিহাদকে সঙ্গে নিয়ে আনারের লাশের অংশবিশেষের খোঁজে তল্লাশি অব্যাহত রাখে সেখানকার পুলিশ। জিহাদের তথ্য অনুযায়ী ভাঙরের কৃষ্ণমাটি এলাকার বাগজোলা খাল থেকে পচা ও দুর্গন্ধযুক্ত একটি ব্যাগ উদ্ধার করেছে সিআইডি। ব্যাগটির ভেতরে এমপি আনারের মরদেহের খণ্ডিত অংশ রয়েছে কি না, তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সেটি পরীক্ষা করে দেখছেন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা। কসাই জিহাদ পুলিশের জেরায় জানিয়েছেন মরদেহের খণ্ডিত অংশ জিরেনগাছা ও কৃষ্ণমাটি সেতুর কাছে বাগজোলা খালে ফেলা হয়েছিল।
শাহীনকে ফেরাতে যৌথভাবে কাজ চলছে
আনার হত্যা মামলায় শাহীনকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনতে যৌথভাবে কাজ করছে বাংলাদেশ ও ভারতের পুলিশ। পশ্চিমবঙ্গের সিআইডির কর্মকর্তা জানান, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দি বিনিময় চুক্তি নেই; কিন্তু ভারতের আছে। আমরা শাহীনকে ভারতে ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা করছি। কারণ অপরাধটি আমাদের রাজ্যে ঘটেছে। এক রাষ্ট্রের নাগরিক অন্য দেশে কোনো অপরাধে জড়িত হলে বন্দি বিনিময় প্রক্রিয়ায় সেই দেশটি ওই ব্যক্তিকে বিচারের আওতায় আনতে যে দেশে আত্মগোপন করেছে তাদের কাছে আনুষ্ঠানিক আবেদন করতে পারে। ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদও জানান, শাহীনকে ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলের সহায়তা চাওয়া হবে। এ বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন রবিবার সাংবাদিকদের জানান, শাহীনকে পেতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারত, নেপাল, ইন্টারপোল ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাজ করছে। ভারতীয় সংবাদ সংস্থা পিটিআইর সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, শাহীন মূল সন্দেহভাজন এবং পলাতক। তাকে ফিরিয়ে আনতে একটি প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ চলছে। তার পরিবারের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে ইন্টারপোলসহ সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে।
গত ১২ মে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় যান ঝিনাইদহ-৪ (কালীগঞ্জ) আসনের আওয়ামী লীগদলীয় সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার। এরপর সেখানেই রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হন তিনি। ১৮ মে থানায় একটি নিখোঁজ ডায়েরি করেন তার পূর্বপরিচিত পশ্চিমবঙ্গের বরানগরের বাসিন্দা গোপাল বিশ্বাস। ২০ মে কলকাতার একটি ফ্ল্যাটে আনারকে হত্যা করে লাশ টুকরো টুকরো করার তথ্য জানায় ভারতীয় পুলিশ। গ্রেপ্তার হওয়া ঘাতকদের স্বীকারোক্তি থেকে জানা যায়, ১৩ মে দুপুরেই আনারকে হত্যা করা হয়েছে।
আনার হত্যায় জড়িত সন্দেহে ঢাকায় ডিবির হাতে গ্রেপ্তার হওয়া তিনজন আট দিনের রিমান্ডে রয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। রবিবার ছিল রিমান্ডের দ্বিতীয় দিন। অপরদিকে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার মুম্বাইয়ের কসাই জিহাদ ১২ দিনের রিমান্ডে রয়েছে। কিলিং মিশনে সরাসরি জড়িত সিয়াম নামে আরেকজনকে পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁও এলাকা থেকে আটক করা হয়েছে।