সাইবার নিরাপত্তা আইন বিষয়ে বিএফইউজের প্রস্তাব
প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ২০:৩৬ পিএম
আপডেট : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ২১:৪৫ পিএম
জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন বিষয়ে বিএফইউজের উপস্থাপনা’ শীর্ষক আলোচনা সভা। প্রবা ফটো
ডিজিটাল
নিরাপত্তা আইন থেকে সংশোধন করে সাইবার নিরাপত্তা আইন করেছে সরকার। সেই আইন পর্যবেক্ষণ
করে সাংবাদিক সমাজের পক্ষ থেকে কয়েক দফা সুপারিশ ও প্রস্তাব জানিয়েছে বাংলাদেশ ফেডারেল
সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে)। তাদের দাবি, বাংলাদেশে সাইবার নিরাপত্তায় আইন করা সময়ের
দাবি। খেয়াল রাখতে হবে, সেই আইন দেশকে স্বর্গরাজ্য না বানাক, জেলখানা যাতে না বানায়।
এটাই সাংবাদিক সমাজের প্রত্যাশা।
মঙ্গলবার
(৫ সেপ্টেম্বর) আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের কাছে বিএফইউজের পক্ষে এ প্রস্তাব করেন জ্যেষ্ঠ
সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল। জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন বিষয়ে
বিএফইউজের উপস্থাপনা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় লিখিতভাবে
এ প্রস্তাব করা হয়।
আলোচনা
সভায় সভাপতিত্ব করেন বিএফইউজের সভাপতি ওমর ফারুক। বিএফইউজের মহাসচিব দ্বীপ আজাদের
সঞ্চালনায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রীর সাবেক তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান
চৌধুরী, বিএফইউজের সাবেক মহাসচিব আব্দুল জলিল ভূঁইয়া, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক
সভাপতি কুদ্দুস আফ্রাদ, বর্তমান সভাপতি সোহেল হায়দার চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক আকতার
হোসেন প্রমুখ।
বিএফইউজের
প্রস্তাব ও সুপারিশ
এই
আইনে কেউ মিথ্যা বা হয়রানিমূলক মামলা করলে তার (বাদীর) বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার
বিধান থাকতে হবে।
খসড়া
আইনে ‘জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা এজেন্সি’ গঠনের যে প্রস্তাব করা হয়েছে,
সেখানে একজন সাংবাদিক বা সংবাদমাধ্যম বিশেষজ্ঞ রাখার প্রস্তাব রাখছি। এতে আইনটি প্রয়োগের
শুরুতেই অনেক ঝামেলা এড়ানো যাবে।
জাতীয়
সাইবার নিরাপত্তা কাউন্সিলে বিএফইউজের সুপারিশ অনুযায়ী- একজন সাংবাদিক বা গণমাধ্যম
বিশেষজ্ঞ রাখার প্রস্তাব করছি।
এ
সময় মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, ’সাইবার নিরাপত্তা আইনের কোনো ধারা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা
রক্ষায় সংবিধানের বিধান, তথ্য অধিকার আইন ২০১৯ ও
জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন, ২০১১-এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয় কি না, তা আরও নিবিড়ভাবে দেখার প্রয়োজন
রয়েছে।’
পরে
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক তার বক্তব্যে বিএফইউজের প্রস্তাবগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা
করার আশ্বাস দিয়ে বলেন, ‘অনেকেই সাংবাদিক সেজে অপরাধ
করে। কিন্তু প্রকৃত সাংবাদিক এবং সাংবাদিক সেজে অপরাধ করাটা এক নয়। এর মধ্যে একটা
বড় পার্থক্য আছে। সেই পার্থক্যটা যেন আমরা সবাই বুঝি, সেই অনুরোধ থাকবে। সাংবাদিক
সমাজের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে যেন এ আইন (সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট) ভালোভাবে পরিচালনা
করা যায়, সেটাই আমাদের লক্ষ্য।’
মিথ্যা
মামলা দিয়ে হয়রানি করলে বাদীর সাজা দেওয়ার বিধান রাখার ব্যাপারেও কাজ চলছে জানিয়ে
তিনি বলেন, ‘মিথ্যা মামলা করলে বাদীকে যে
উল্টো সাজা দেওয়ার ব্যাপারটা, সেটা নিয়েও কাজ করছি আমরা। এটার জন্য যা করা দরকার, তা
নিয়ে আজকেই কথা শেষ করে ফেলব। এটা আমি আপনাদের (সাংবাদিকদের) আশ্বস্ত করে গেলাম।’
সাইবার
নিরাপত্তা আইনের ৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২ ও ৪২ ধারায় অপরাধের সংজ্ঞা এবং এই আইনের
প্রয়োগপ্রক্রিয়া আরও সুস্পষ্ট করা প্রয়োজন। এগুলো বিবেচনার জন্য তাদের পর্যবেক্ষণ
হলো- (ক) ৮ নম্বর ধারায় উপধারা ২-এ বলা হয়েছে, যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিকট
প্রতীয়মান হয়। ‘প্রতীয়মান’ শব্দটি বিপজ্জনক। আইনি প্রক্রিয়ায়
কোনো অভিযোগপ্রাপ্তি, তদন্ত বা প্রমাণের আগেই শুধু ‘প্রতীয়মান’ হওয়ার ভিত্তিতে অবারিত ক্ষমতার
প্রয়োগ রাখার বিধান বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে।
(খ)
২১ নং ধারা : মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত ও জাতীয়
পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রপাগান্ডা ও প্রচারণার দণ্ড। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিষয়টি
সংজ্ঞায় স্পষ্টীকরণ করা হয়েছে। জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকার ক্ষেত্রে
‘বিরুদ্ধে’-এর পরিবর্তে আরও সুনির্দিষ্টভাবে
বলা উচিত বিদ্বেষ, বিভ্রান্তি ও কুৎসামূলক প্রচারণা চালানো হবে অপরাধ। এসব অভিযোগ
এবং এসবের প্রতি সমর্থনের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান থাকতে
হবে।
(গ)
২৫ নং ধারা : আক্রমণাত্মক, মিথ্যা ও ভীতি প্রদর্শক, তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ প্রকাশ ইত্যাদি।
আরও সুনির্দিষ্ট করা দরকার বা এই ধারাটি বাতিল করা দরকার। রাজনৈতিক বক্তৃতা তো আক্রমণাত্মক
হয়, কোনো মালিক বেতন ভাতা না দিলে তার অফিস ঘেরাও করে ভুক্তভোগী শ্রমিক কর্মচারীরা
যে আন্দোলন করে, সেখানে এসব উপাদান তো থাকবেই। এসব কি অপরাধ বলে বিবেচিত হবে?
(ঘ)
ধারা ২৮ : ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত প্রসঙ্গ। এটা আরও সুনির্দিষ্ট করা প্রয়োজন।
ধরা যাক, দুই পীরের বা মাজারের সমর্থক দুই গ্রুপ পরস্পরের পীর বা বিশ্বাসের প্রতি আক্রমণ
করে বক্তব্য দিল, এটি নিয়ে অভিযোগ আনা হলে এই বিতর্কের অবসান হবে কীভাবে? যেমন হিন্দুধর্ম
সংস্কার নিয়ে এক পক্ষ কাজ করছে, প্রকাশ্যেই আলোচনা চলছে, আবার অপর পক্ষ মনে করে এটা সনাতন
ধর্মের প্রতি আঘাত। এ নিয়ে কোনো মামলা কি এই আইনের আওতায় আসবে?
(ঙ)
ধারা ২৯ : মানহানিকর তথ্য প্রকাশ : এ বিষয়ে পেনাল কোডের (অ্যাক্ট ১৮৬০ ) সেকশন ৪৯৯-এ যেহেতু স্পষ্টীকরণ করা আছে, সেহেতু এই ধারা নতুন করে সাইবার নিরাপত্তা আইনের আওতায়
আনার প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে করি না।
(চ) ৩১ ধারা : আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো : এই ধারা এতই ব্যাপক যে রাজনীতি ও পেশাজীবী আন্দোলনের
যেকোনো কর্মসূচি পালনের পর যে কাউকে এই ধারায় অপরাধী সাব্যস্ত করা যাবে। ঘটনা ঘটায়
বা ঘটিবার উপক্রম হয়, বিষয়টি এতটা অস্পষ্ট এবং প্রয়োগের ক্ষমতা এতটা ব্যাপক যে একটা
ভয়ের পরিবেশ তৈরি করবে।
অফিসিয়াল সিক্রেটস আইনকে নতুন জীবন দেওয়ার বিরুদ্ধে আমরা। এই আইনের ৩২ ধারা পুরোটা
বাতিলের দাবি জানাচ্ছে সাংবাদিক সমাজ।