সেলিম আহমেদ
প্রকাশ : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১১:১৩ এএম
আপডেট : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১১:৪৩ এএম
অমর একুশে বইমেলায় শুক্রবার শিশুপ্রহরে অভিভাবকদের সঙ্গে আসা শিশু। আলী হোসেন মিন্টু
এবার শুরু থেকেই জমজমাট লেখক, পাঠক, প্রকাশক আর বইপ্রিয় মানুষের প্রাণের মেলা। দিন যতই গড়াচ্ছে ততই প্রাণবন্ত হয়ে উঠছে। একই সঙ্গে বাড়ছে বই বিক্রির হার। মেলায় আসা বিপুল জনসমাগম কেবলই ঘুরেফিরে আড্ডা দিয়ে চলে যাচ্ছে না, পছন্দের বইটিও নিয়ে যাচ্ছে, যা আশাবাদী করেছে প্রকাশকদের। করোনা মহামারির ক্ষত কাটিয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখছেন তারা।
গতকাল শনিবার মেলার দশম দিন ছিল সরকারি ছুটির দিন। সকালে মেলার প্রবেশদ্বার উন্মোচনের পরপরই দল বেঁধে আসতে শুরু করে নানা বয়সি মানুষ। বিকালে পাঠক ও দর্শনার্থীদের পদভারে জনারণ্যে পরিণত হয় মেলাপ্রাঙ্গণ। তখন বিস্তীর্ণ প্রান্তরটিকে খুব সংকীর্ণ মনে হয়। গায়ের সঙ্গে গা লেগে যাওয়া মানুষের জটলা দেখা দেয়।
দিন যাচ্ছে, বইয়ের কাটতিও বাড়ছে। প্রকাশকরা জানিয়েছেন, শুক্রবারের ছুটির দিনের চেয়ে শনিবার তাদের ব্যস্ততা ছিল বেশি।
অন্যপ্রকাশের সামনে কথা হয় যাত্রাবাড়ী থেকে আসা এক ব্যাংক কর্মকর্তা রিয়াদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, শুরুর দিন থেকেই মেলায় আসার সুযোগ খুঁজছিলাম। কিন্তু কাজের কারণে সুযোগ হয়নি। তাই আজ (গতকাল) বাচ্চাদের নিয়ে আসলাম। ওদের পছন্দ ও মনন উপযোগী বই কিনে দেওয়ার পাশাপাশি নিজের পছন্দের কিছু বই কিনলাম। আরও কিনব। ছুটির দিনে সকল অবসাদ কাটিয়ে মননের মেলায় মনটাকে ঝালাই করে নিলাম।
অন্বেষা প্রকাশনীর প্রকাশক শাহাদাত হোসেন বলেন, শনিবার মানুষ যেমন এসেছে তেমনি বই বিক্রিও হয়েছে। এতটা সত্যিই আশা করিনি। বইমেলার আগামী দিনগুলো আরও ভালো হবে আশা করি।
কথা প্রকাশের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ ইউনুছ জানান, শুক্রবার যারা মেলায় এসেছিল, তাদের অধিকাংশ দর্শনার্থী। তবে আজ যারা মেলায় এসেছে, তাদের বেশিরভাগই সিরিয়াস পাঠক। তারা স্টল ঘুরে ঘুরে কিনছে পছন্দের বই। আজকের বেচাকেনায় আমরা সন্তুষ্ট।
ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশের প্রকাশক আদিত্য অন্তর বলেন, অমর একুশে গ্রন্থমেলা এখন জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। শুক্রবার প্রচুর পাঠক ও দর্শনার্থীর সমাগম ঘটেছে। হয়তো তাদের প্রত্যেকেই বই কেনেনি, তবে তাদের এ আগমন বাড়িয়ে দিয়েছে মেলার ঔজ্জ্বল্য।
ছুটির দিনগুলোতে বইমেলায় ভিড় এমনই হচ্ছে যে, তা সমাল দিতে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। ছুটির দিনের বিকালে অত্যধিক যানবাহনের চাপ সামাল দিতে ওই সময় শাহবাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা পরিহার করে বিকল্প ট্রাফিক রুট অনুসরণ করার অনুরোধ জানিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ।
এখানে থেমো না : ক্যান্সার লড়াকুদের বয়ান
ক্যান্সার আক্রান্ত কিছু মানুষ আর তাদের পরিজনের অজস্র হাসি, কান্না, সংকল্প, সংগ্রাম, ভেঙে পড়া ও পরক্ষণেই নতুন উদ্যমে জীবনের মুখোমুখি হওয়ার সত্যিকারের গল্প নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে নতুন বই ‘এখানে থেমো না : ক্যান্সার লড়াকুদের বয়ান’। প্রকাশ করেছে সেন্টার ফর ক্যান্সার কেয়ার ফাউন্ডেশন আর পরিবেশক খ্যাতনামা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ইউপিএল। বইটির লেখক তিন বিশিষ্ট ব্যক্তি ক্যান্সার লড়াকু অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী, চলচ্চিত্র নির্মাতা মশিহউদ্দিন শাকের ও বিজ্ঞানী ড. সেঁজুতি সাহা। গতকাল তারা এসেছিলেন মেলায় ইউপিএলের স্টলের সামনে। ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পাঠকদের উৎসাহ দেওয়ার জন্যই তাদের আসা বলে জানান।
মেলার বই উন্মোচন মঞ্চে দেখা গেল অভিনেত্রী শম্পা রেজাকে। তিনি এসেছিলেন আনুশা চৌধুরীর মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক ‘ভয়হীন জীবনের খোঁজে’ বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে। এতে আরও ছিলেন কথাসাহিত্যিক ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মোহিত কামাল।
মেলা মঞ্চের আয়োজন
বিকাল ৪টায় বইমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘জন্মশতবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি : সুচিত্রা মিত্র’ শীর্ষক আলোচনা। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সাইম রানা। মফিদুল হকের সভাপতিত্বে আলোচনা করেন আহমেদ শাকিল হাসমী ও অণিমা রায়।
প্রাবন্ধিক বলেন, সুচিত্রা মিত্র মূলত রবীন্দ্র-প্রতিভার আলোয় বিচ্ছুরিত এক উজ্জ্বল বর্ণশোভা। তার গায়নশৈলীর মাধ্যমে রবীন্দ্রসংগীত মনন ও সৃজনের অনুপম সৌকর্যে চিত্রিত ও বিকশিত হয়েছে। তার সংগীত পরিবেশনার উচ্চারণ এবং বোধের শুদ্ধতা প্রায় প্রবাদের মর্যাদা পেয়েছিল।
মফিদুল হক বলেন, আমরা যদি বাংলা গানের সঙ্গে বাংলার সমাজ ও মানবমুক্তির আকুতির সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করতে যাই, তাহলে প্রাসঙ্গিকভাবেই সুচিত্রা মিত্রের কথা উঠে আসে। তার সাংস্কৃতিক-মানস ও অকুতোভয় আদর্শ আমাদের জন্য অনুকরণীয় হয়ে থাকবে।
মূল মঞ্চে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন কবি দিলারা হাফিজ, চঞ্চল আশরাফ ও রনজু রাইম। আবৃত্তি পরিবেশন করেন অনিমেষ কর, কাজী বুশরা আহমেদ তিথি, মিজানুর রহমান সজল ও মুস্তাক আহমেদ। পুঁথি পাঠ করেন ফকির আবুল হাশেম। এছাড়া ছিল মিতা মোস্তফার পরিচালনায় নৃত্য সংগঠন ‘বেণুকা ললিতকলা কেন্দ্র’ এবং মো. আনোয়ার হোসেনের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘আরশিনগর বাউল সংঘ’র পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী কিরণ চন্দ্র রায়, তপন মজুমদার, অনাবিল ইহসান, রুশিয়া খানম, বিমান চন্দ্র বিশ্বাস, জামাল দেওয়ান ও সাগর দেওয়ান।
গতকাল শনিবার লেখক বলছি- অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন কবি ও অনুবাদক জিল্লুর রহমান, কথাসাহিত্যিক পলাশ মজুমদার, শিশুসাহিত্যিক আহমেদ রিয়াজ ও প্রাবন্ধিক মোতাহার হোসেন মাহবুব।
শনিবারের নতুন বই
গতকাল মেলায় নতুন বই এসেছে ১৫২টি। উল্লেখযোগ্য বইগুলোর মধ্যে বাংলা একাডেমি এনেছে মুহম্মদ নূরুল হুদার ‘গণতন্ত্রের মনোকন্যা শেখ হাসিনা : শত শিশুকিশোর শত কবিতায় জন্মদিনের শুভকামনা’। কাকলী প্রকাশনী এনেছে আনিসুল হকের কৌতুকগ্রন্থ ‘সর্বশ্রেষ্ঠ কৌতুক’ ও জাকির তালুকদারের গল্পগ্রন্থ ‘বন পাহাড়ের গান। নন্দিতা প্রকাশ এনেছে চঞ্চল শাহরিয়ারের কাব্যগ্রন্থ ‘গোলকধাঁধার দিন’। আগামী প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছে ড. বদিউল আলম মজুমদারের প্রবন্ধগ্রন্থ ‘রাজনীতি আইন ও সুশাসন। ঐতিহ্য এনেছে বেলাল চৌধুরী ভাষা আন্দোলন বিষয়ক ‘একুশের স্মৃতি ও ভাবনা’ গ্রন্থের নতুন সংস্করণ। ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ এনেছে দীপু মাহমুদের ‘কিশোর মনের যত্ন’। মিজান পাবলিশার্স এনেছে রবীন্দ্র গোপের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গ্রন্থ ‘বারুদের দিন’। ঐতিহ্য এনেছে আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘কাজী নজরুল ইসলাম বিষয়ক সাক্ষাৎকার’। পাঠক সমাবেশ এনেছে র. আ. ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর ভাষণ সংকলন ‘রক্তের শপথে হই বলীয়ান’।
আজ রবিবার, বইমেলার ১১তম দিন। মেলা শুরু হবে বেলা ৩টায়, চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকাল ৪টায় বইমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘জন্মশতবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি : কলিম শরাফী’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান।