শাহীন আখতার
প্রকাশ : ১৯ জুন ২০২২ ২১:২৩ পিএম
সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
‘বিশিষ্ট গদ্যশিল্পী সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় আর নেই’ এই শিরোনামে ঢাকার কাগজে খবর ছাপা হবে, যে কোনো দিন পত্রিকা খুলে আমরা তাঁর মৃত্যুসংবাদ পাবো- গত দেড় বছর ধরে এ আশঙ্কা করে করে যখন প্রায় ভুলে যেতে বসেছিলাম তখনই খবরটা এলো। এভাবে বিস্মৃত হওয়া, একজন ক্যান্সার রোগীর ক্ষেত্রে, সন্দীপনদা বেঁচে থাকলে হয়তো বলতেন ‘ঠিক হয়েছে কি?’ না সন্দীপন দা, ঠিক হয়নি। তবে এর কারণ ছিল।
মাস দুয়েক আগে সন্দীপনদার সঙ্গে যখন দেখা, তখন আমি বম্বে টাটা মেমোরিয়াল হসপিটাল থেকে সবে কলকাতায় ফিরেছি। অসুস্থ বড়ভাই তখনো বম্বে। কেমোর সিরিয়াল ধরার জন্য রয়ে গেছেন। আমার কলকাতা যাওয়া-আসার দ্বিতীয় পর্বে, (প্রথম-পর্ব, দ্রষ্টব্য আমার ‘পালাবার পথ নেই’ উপন্যাস) গত চার-পাঁচ বছর, ওখানে পৌঁছেই যাকে ফোন করতাম, তিনি ছিলেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। এবার কলকাতা নেমে আমি দু'দিন চুপচাপ বসেছিলাম। যোগাযোগ করিনি। বম্বে থাকার সময়টা ছিল বিভীষিকা। টানা দুই সপ্তাহ ক্যান্সার হাসপাতালের পর আমার আর শক্তি ছিল না আরেকজন ক্যান্সার রোগীর মুখোমুখি হওয়ার। দেরিতে ফোন পেয়েও তিনি খুশি হলেন। অসময়ে আমার আসার কারণ তাঁকে কিছুটা নিরাশ করলো হয়তোবা। আমার বড় ভাই যে তাঁর চেয়ে বিশ বছরের ছোট, এ তথ্যটি কথার মাঝখানে আমিই ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম কি? আমি হয়তো চাচ্ছিলাম না- উনি নিজের অসুখ নিয়ে বেশি কিছু বলেন। সন্দীপনদা অত্যন্ত তীক্ষ্ন অনুভূতির লোক। অল্প কথায় বুঝে গিয়েছিলেন আমার দুশ্চিন্তার কেন্দ্রে উনি আর নেই- বড়ভাই ঢুকে পড়েছে, যার সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক। এই ভয়ঙ্কর ব্যাপারটা তিনি মেনে নিয়েছিলেন। তারপর কলকাতা থাকার সময় বার তিনেক দেখা হয়েছে। ‘ও খুব আনমাইন্ডফুলÑ লক্ষ্য করেছো?’ কথার ফাঁকে ফাঁকে তিনি অঞ্জনকে বলছিলেন। তারপর হয়তো আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যই বললেন, ‘বুঝলে ক্যান্সারে কেউ এতো তাড়াতাড়ি মরে না। এই দেখো আমাকে- পারফেক্টলি অলরাইট।’
পছন্দের মানুষদের ছোট-বড় অনুভূতিকে মূল্য দেওয়ার দুর্লভ গুণ ছিল সন্দীপনদার। একটা সাক্ষাৎকার নেয়া ছাড়া লেখক সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের জন্য আমি কী করেছি? সেসময় আমার একা থাকা নিয়ে একজন বাবার মতো তিনি যে উৎকন্ঠায় থাকতেন, ওনার উপদেশ মতো কিছু করতে পারি আর না-পারি আমি যে তা অনুভব করতাম, উনি তা বুঝতে পারতেন। লেন-দেন যদি বলি এটুকুই। ততোদিনে আমি তাঁর লেখার মনোযোগী পাঠকও আর ছিলাম না। খুশি হবেন জেনেও, আমি এমনই গোঁয়ার যে, পীড়াপীড়ি না করলে আগ বাড়িয়ে কখনো বলিনি- সন্দীপনদা আপনার নতুন বইটা পড়বো। অথচ তিনি আমার লেখা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তেন। তাঁর অপছন্দের ‘বড় ক্যানভাস’-এ তালাশ লিখেও আমি ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছি, যা সন্দেহের চোখে না দেখে উপায় নেই। কেননা সেখানে সাহিত্যের চেয়ে অপত্য স্নেহের ভূমিকাই ছিল বেশি। তিনি তা স্বীকার না করলেও।
নব্বইয়ের দশকের শেষ দিক পর্যন্ত সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের লেখা আমি বিস্তর পড়েছি। তাঁর সুন্দর বাক্য আর স্মার্ট উপস্থাপন যাদু করেছিল। লিখতে হলে এমনই লেখা উচিত- এ ঘোর থেকে বেরুতে আমাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। তারপর ২০০১-এর দিকে সন্দীপন দার সঙ্গে যখন পরিচয়, তখন চক্ষু লজ্জার খাতিরে তাঁর অতীত লেখার জাবর কাটি। তাঁর বেশ কিছু ছোট গল্প, যা একাধিক বার পড়ার দাবি রাখে- সেসব নিয়ে খুচরো আলাপ হয়। দেখা গেল, তিনি সবচেয়ে বেশি খুশি হন কৃত্তিবাস যুগের বন্ধু শক্তি-সুনীল-দীপক মজুমদার ও অন্যদের গল্প করতে পারলে। কথায় কথায় নিজের গল্প-উপন্যাস কখন কীভাবে কেন লেখা হলো- সেসব বিষয়ও চলে আসতো। তবে ‘কুকুর সম্পর্কে দুটো-একটা কথা যা আমি জানি’-এর শেষটা কি অন্যরকম হতে পারতো না- এ জাতীয় আলোচনা প্রায়সময় দানা বাঁধতে পারেনি মূলত আমাদের মতো বেয়াড়া শ্রোতা আর সন্দীপনদার পেঁচানো ও দীর্ঘ লয়ের কথা-বার্তার জন্যই। কিন্তু সুস্থির আর মনোযোগী হলে ক্ষতির কিছু ছিল না, লাভই হতো বরং। তাঁর বইয়ের সাজানো বাক্যে যে তাক লাগানো শব্দদ্যুতি, সেটা মামুলি কথায়ও সময় সময় ঝলকে উঠতো। লেখার টেবিলের বাইরে এ শব্দের খেলা, ‘লেখার বিষয়’ তাঁর নিজের ভাষ্যে যা একটাই ছিল- এ নিয়ে অবিরাম চর্চা তিনি বছরের পর বছর করে গেছেন। সাহিত্যকে ঘিরে তাঁর প্রত্যাশাও ছিল অনেক।
দীর্ঘ সময় লেখালেখি করেও সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের মতো একজন গুণী লেখক যে পাঠক-অপরিচিত রয়ে গেলেন, তা প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতার কাছে লেখকের অসহায়ত্বেরই নজির। আমাদের বইয়ের বাজার আর মধ্যবিত্তের ঘর-বাড়িতে যখন আনন্দবাজার-এর ছাপমারা বাজে বইয়ের ¯তূপ দেখি, তখন সন্দীপনদার কথাই প্রথম মনে পড়ে।
সেইবার আকাদেমি পুরস্কার পাওয়ার পর বইমেলার আজকাল-এর স্টলে ক্রেতার ঢল নেমেছে। সন্দীপনদা সেজে-গুঁজে বসেছেন অটোগ্রাফ দিতে। কোথা থেকে কি। টপাটপ পায়ের ধূলো কপালে ছোঁয়ানোর হিড়িক পড়ে গেল। বই থেকে মাথা তুলতেই ওনার চোখ ছানাবড়া। সামনের অটোগ্রাফ শিকারি সব কিশোর-কিশোরী। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের বইগুলি আকারে ছোট বলেই হয়তো। এ তো সাক্ষাৎ প্রতারণা! আজকাল-এর আসন ছেড়ে ধূলি-ধূসর মাঠে, আজও আমি দেখতে পাই, লম্বা লোকটা উট পাখির মতো কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন; সামনে বিশাল জনসমুদ্র, বিরাট আয়োজন- রবাহূতের মতো এসেছেন, শূন্য হাতে ফিরে যাচ্ছেন।
যে প্রতিষ্ঠা, টাকা-কড়ি মানুষকে আত্মবিশ্বাস এনে দেয়- তাঁর তা ছিল না। বাতাসে দোল খাওয়া নিজের লম্বা-পাতলা শরীরটার মতো তিনি ছিলেন দোদুল্যমান। লিটল ম্যাগাজিনের কিছু চাটুকারের সামনে তাঁকে বহুবার জিভে শান দিতে দেখেছি। তাতে তাঁর শত্র“র সংখ্যাই বেড়েছে। আর সাচ্চা সমঝদার তো সবসময় আড়ালেই থাকে। আনন্দবাজার-এর বাইরে দাঁড়াতে তাঁর শক্ত খুঁটির দরকার ছিল। সংবেদনশীল শিক্ষিত পাঠক-সমালোচক কিংবা দেজ-এর মতো প্রতিষ্ঠিত প্রকাশক- সে যাই হোক। কারণ তিনি কলকাতা নগরীর চক্করেই ঘুরপাক খেয়েছেন- অর্থ-খ্যাতি-স্বীকৃতির মোহ হয়তো ষোল আনাই ছিল। ‘রুবি কখন আসবে’, ‘একক প্রদর্শনী’ বা ‘কলকাতার দিনরাত্রি’ উপন্যাস আর বেশ কিছু গল্পে তা পরিস্কারভাবেই আছে। কিন্তু এর জন্য যা দরকার, তা বোধ হয় ওনার ধাঁতে ছিল না। অল্প উস্কানিতেই তাঁকে দিয়ে অনেক কথা বলিয়ে নেয়া যেতো। সে আনন্দবাজার, কলেজস্ট্রিট পাড়ার বড় প্রকাশক বা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়- যার বিরুদ্ধেই হোক। একে সরলতা কিংবা কূটবুদ্ধির অভাবই হয়তো বলা যায়। তাছাড়া তিনি লেখা ও কথায় পরকীয়া প্রেমের যে ধ্বজা উড়িয়েছিলেন, কলকাতার রক্ষণশীল হাটে তা বিকোয় নি। মার্কামারা হয়ে গিয়েছিলেন।
কাছের মানুষের মৃত্যুর সঙ্গে জীবিতদের যে অনুশোচনা জড়িয়ে থাকে তা হয়তো চিরকালের। কিন্তু ‘ভাবনা-চিন্তা ছাড়াই যা খুশি বলার’ যে দুর্লভ একটা জায়গা আমার ছিল, সন্দীপনদার মৃত্যুর সাথে সাথে আমি তা হারিয়ে ফেলেছি। শূন্যতার বোধ হয়তো এ থেকেই, যা শুধু আমার একার নয়। ১৪ ডিসেম্বর কলকাতা থেকে মানস রায় ইমেল করেছেন: আকাশ-পাতাশ খুঁজেও সন্দীপনদাকে আর পাওয়া যাবে না কোনোদিন- এ বোধ আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে গত দু’দিন। তোমাকে সন্দীপনদা খুব ভালবাসতেন, আমাকেও। আমার খুব শূন্য লাগছে শাহীন- ভালবাসার একটা মানুষ চলে গেল।
সন্দীপনদার সাথে আমার যখন পরিচয় তখন তিনি সত্তর ছুঁই ছুঁই। মানুষ নাকি বৃদ্ধবয়সে বাল্য অবস্থায় ফিরে যায়। শিশুর মতো সরল মনে হয় তখন। আগে তিনি কেমন ছিলেন কবি বেলাল চৌধুরি নিশ্চয়ই ভাল বলতে পারবেন। আমি দেখেছি, সন্দীপনদার সাথে বেয়াদবি করার অনেক সুযোগ পাওয়া যেতো। কথার পিঠে কথা বলায় বাধা ছিল না। তিনি সশস্ত্র হয়ে বাকবিতণ্ডায় ঝাঁপিয়ে পড়তেন ঠিকই, তবে নিঃশব্দে রণেভঙ্গও দিতেন। আমার মতো মুখচোরাও এ সুযোগের অপব্যবহার করেছে বহুবার- এমনকি শেষ সাক্ষাতের দিনটিতেও।
সন্দীপন দার সঙ্গে কালি পুজোর রাতে শেষ দেখা। সেদিন ওনার বন্ধু অনিরুদ্ধ লাহিড়ী ওরফে চাঁদ দার বাড়িতে রাত দশটা পর্যন্ত আড্ডা হয়। আগের রাতে সন্দীপনদার একটা সাক্ষাৎকার টিভিতে দেখানো হয়েছিল। সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন গায়ক কবীর সুমন। কালি পুজোর পটকা ফাটানোসহ ইত্যাকার খারাপ দিক এবং মা কালির উৎপত্তি বা আর্বিভাব ছিল সাক্ষাৎকারের বিষয়। সন্দীপনদা যে টেলিভিশনে বলে আসতে পেরেছেন ‘এমন এক দেশ চাই, যেখানে ধর্ম নেই’ এ নিয়ে নিজে নিজের বগল বাজাচ্ছিলেন। আমি আর অঞ্জন তাঁর সেক্যুলার উষ্মায় যারপরনেই বিরক্ত। অসম্ভব খোঁচাখুঁচি চলে। ওনার একসময় মনে হয় আমরা ইসলামিক ফ্যানাটিক কিনা। এ পরিস্থিতিতে বাহাস নিরর্থক। আমি তাড়া দিচ্ছিলামÑ রাত হয়ে গেছে, আপনার বাড়ি ফেরা দরকার, রীনাদি ক্ষেপে যাবেন। উনি তখন কাউকে কেয়ার করছেন না। এখন থেকে স্বাভাবিক জীবন-যাপন করবেন। ‘কোনো অসুখই নেই আমার। অসুখটা বুঝলে তো মনের। এবার শান্তিনিকেতনে গিয়ে বুঝেছি।’
চাঁদ দার বাড়ি থেকে যখন বেরোই, তখন বাতাসে শীতের আমেজ। আমাদের বাঁ হাতেই কেওড়াতলা শ্মশান। ওখানে শ্মশানকালির পুজো হচ্ছে। প্ল্যান ছিল ট্যাক্সি ধরে সন্দীপনদাকে বাড়ি পৌঁছে আমরা গন্তব্যে ফিরবো। পুজোর ভিড়-ভাট্টার জন্যই হয়তো রাত দশটায় রাস্তায় যানবাহন তেমন ছিল না। অগত্যা সামনে একটা অটো আসতে সন্দীপনদা আসামের বাহারি গামছা গলায় পেঁচিয়ে চালকের পাশের সিটে উঠে বসলেন। আমরা যাবো উল্টোদিকে। আমাদের রাস্তা পার হওয়ার আগেই অটোটা সন্দীপনদাকে নিয়ে শ্মশানের বাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেল।
মৃতদেহ না দেখলে তো কাউকে মৃত ভাবা যায় না। ক’দিন ধরে মনে হচ্ছে সন্দীপনদার ইমেল আসবে। ২০০২ সালের ডিসেম্বর মাসে তাঁর খবর আরও একবার বাংলাদেশের কাগজে ছাপা হয়েছিল আকাদেমি পুরস্কারের সুবাদে। পরদিনই ইমেল আসে। আজকাল-এর ঠিকানা থেকে সন্দীপনদা লিখেছিলেন- ‘আমি আকাডেমি পুরস্কার পেয়েছি। ঘুঁটের মালা পাঠাও।’ সঙ্গে আকণ্ঠ ফুলেরমালা জড়ানো একটা ছবি- তাঁর চোখ দুটি ছিল খোলা।