ফারিহা জেসমিন ইসলাম, সহকারী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশ : ০৮ মে ২০২৫ ১৪:৪১ পিএম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যাকে আমি বলব বাংলা সাহিত্যাকাশের প্রথম রবি, প্রথম সূর্যালোক। এটি এমন একটি নাম, যার আবেদন প্রতিটি বাঙালির কাছে চির কাঙ্ক্ষিত। তাঁর প্রতিটি নিবেদন সর্বজনীন। সমগ্র বাংলার মানুষকে এক জাদুর মূর্ছনায় আজীবন বেঁধে রেখেছে। তাঁর সৃষ্টিমাধুর্য ছড়িয়েছে আমাদের অন্তিম অনুভবে। বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় বিস্তর ফুল ফুটিয়েছেন। গীতাঞ্জলির মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যকে পৌঁছে দিয়েছেন বিশ্ব দরবারে।
প্রেম, বিরহ, মিলন, বিচ্ছেদ, শোষণ, বঞ্চনা, জন্ম, মৃত্যু, দর্শন, রাজনীতি কী নেই ঠাকুরের রচনায়? মানুষের মনের অনুভব ও প্রকৃতির এমন কল্পনাতীত সুর আর কেউ কখনও রচনা করতে পারেনি। ভাবে দার্শনিক, ভাষায় জাদুকর, সুরে যেন আত্মার গীতিকার। আমার কাছে এই মহাপুরুষ এক অনন্ত বিস্ময়। বাংলার নদী, মাঠ, ফসল, সবুজ প্রকৃতিতে মশগুল ছিলেন তিনি।
বাংলার মাটি ও মানুষের সঙ্গে ঠাকুরের ছিল এক গভীর এবং প্রাণোৎসারিত স্থায়ী সম্পর্ক। শুধু পশ্চিম বাংলায় নয়, পৈতৃক জমিদারির প্রয়োজনে কবি বসবাস করেছেন বাংলাদেশেও। কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, নওগাঁর পতিসর, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে রবিঠাকুর জমিদারি দেখাশোনা করার জন্য প্রায়ই আসতেন। জমিদারি পরিচালনা করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে হৃদয় দিয়ে মিশেছেন এবং তাঁর সাহিত্য, দর্শন , সমাজ ভাবনা ও সংস্কারে সেসব চিত্রায়িত হয়েছে।
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর ছিল রবি ঠাকুরের সাহিত্যজীবনের একটি আবেগময় ঠিকানা। এখানে বসে কবি তার সোনার তরী কাব্যগ্রন্থের কিছু কবিতাসহ বিখ্যাত সব সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি করেছেন। ১৮৯০ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পৈতৃক জমিদারির দেখভালের জন্য প্রথম সাজাদপুরে (কবি শাহজাদপুরকে সাজাদপুর বলেই বিভিন্ন রচনায় লিখেছেন) আসেন। এখানে তিনি কম থাকতেন, তবে তাঁর নিজের কাছারি বাড়িতেই তিনি উঠতেন। শাহজাদপুরের মানুষ, তাদের জনজীবন, প্রকৃতি, ফসলের মাঠ, চারদিকের সবুজ কবিকে আকুল করত এবং তিনি তাঁর এক চিঠিতে লিখেছিলেন ‘সাজাদপুরে আসলে তাঁর যেমন লেখার আগ্রহ আসে তেমন আর কোথাও গেলে হয় না।’ একটি লেখা পড়ে জানতে পারলাম, করতোয়া নদী দিয়ে তার নিজস্ব বোট পদ্মা এবং চিত্রায় করে খোনকারের জোলা দিয়ে কবি শাহজাদপুরের কাছারি বাড়িতে আসতেন।
বেশিরভাগ সময় তিনি কুষ্টিয়ার শিলাইদহে থাকলেও সাজাদপুরে বসে তিনি রচনা করেছেন অসাধারণ সব সাহিত্য কর্ম। কবি কাছারি বাড়িতে বকুল তলায় বসে লিখতেন, তবে এখন কবির সেই স্মৃতিবিজড়িত বকুল গাছটি আর নেই। গাছটি মরে গেলে একই জায়গায় আরেকটি বকুল গাছ লাগানো হয়েছে, যা এখন আমরা দেখতে পাই।
আমরা অনেকেই কি জানি, আমাদের অতি প্রিয় গান ‘ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো তোমার মনের মন্দিরে...’ কবি সাজাদপুরে বসে লিখেছেন? আমাদের প্রাণ আকুল করা গানÑ ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা তুমি আমার সাধের সাধনা, মম শূন্য গগন বিহারী...’ কবি এখানে বসে লিখেছেন। তা ছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সাজাদপুরে বসেই রচনা করেছেন বিখ্যাত গল্প ছুটি, পোস্টমাস্টার, সমাপ্তি, ক্ষুধিত পাষাণ ইত্যাদি ।
এক লেখায় পড়লাম ১৮৯৭ সালে কবির সাজাদপুরের জমিদারি ভাগ হয়ে তাঁর কাকার হাতে চলে গেলে তিনি শাহজাদপুর আসা ছেড়ে দেন। কিছুদিন আগে বেড়াতে গিয়ে দেখলাম শাহজাদপুরের জমিদার শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে ঘরটিতে প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা নিতেন সেই দালানটি ভাঙা অবস্থায় পড়ে আছে। দেখলাম তখন যে ইঁদারা বা পাতকুয়া থেকে পানি তোলা হতো সেটিও পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে। এইবার কাছারি বাড়িতে গিয়ে এইসব স্মৃতি ধরে রাখার নতুন কোনো প্রয়াস দেখতে পেলাম না। অথচ আমার মতো অনেকেই ক্ষুধাতুর চোখে, মনে এসব অতীত ঐতিহ্য খুঁজে বেড়াচ্ছি। হতাশ হলাম। তবে উঁচু জোড়া তালগাছ দেখে দারুণ লাগল।
পরবর্তী প্রসঙ্গে যেতে যেতে একটুখানি গল্পের অবতারণা না করলেই নয়। তবে এই গল্প কবিগুরুরকে সাজাদপুরের শিকড়ের মানুষগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত করে রেখেছে আজীবনের জন্য।
বাছুর এবং গাভীগুলো বেড়া দিয়ে বানানো পৃথক দুটি ঘরে সারিবদ্ধভাবে রাখা। এক এক করে গাভীগুলোকে ডেকে তাদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করা হচ্ছিল। সে এক নতুন এবং অবাক করা বিষয় ছিল আমার জন্য। এই জায়গাটা স্থানীয়দের কাছে পরিচিত পাথার হিসেবে। পাথার হলো এক বিশাল তৃণভূমি, যেখানে বাথান জেগে ওঠে। এই বাথান রবিঠাকুরের অবদান। বর্ষায় এই সুবিশাল এলাকা পানিতে ডুবে যায়। থৈ থৈ করা পানি তিন থেকে চার মাস স্থায়ী হয়। মাইলের পর মাইল পানি ছাড়া কিছু দেখা যায় না বলে এই জায়গাকে বলা হয় পাথার যেমন আমরা বইপত্রে পড়েছি বা কথায় কথায় বলি অকূল পাথার। সেই কূল উপচানো পানিতে চলাচলের একমাত্র উপায় হয় তখন বোট বা নৌকা। বর্ষা চলে গেলে যখন পানি নেমে যায় তখন ধলাই নদীর তীর ঘেঁষে এই পাথারেই জেগে উঠে দেড় হাজার কিংবা বারোশ একরের বাথান। শাহজাদপুরের এই বাথান বাংলাদেশের বৃহৎ গোচারণভূমি সম্ভবত। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের রেশমবাড়ির কাছে অবস্থিত এই বাথান সাজাদপুরের জমিদার শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গবাদিপশু লালন-পালনের জন্য কৃষকদের লাখেরাজ হিসেবে দান করেছিলেন। শীতামন, আহ্লাদী, রূপসী, কবিতা, শ্যামলী, ময়নাসহ বিভিন্ন নামে শত শত গরু এখানে পালিত হয়। শাহজাদপুরে গোয়ালাদের হাতে উৎপাদিত দুধ-দই, ঘোষদের মিষ্টি, ঘি এসব খুব মানসম্মত হওয়ায় কবিগুরু খুব পচ্ছন্দ করতেন এবং জোড়াসাঁকোতেও পাঠাতেন। একদিন এক ঘোষ জানালেন, চারণভূমির অভাবে গরু পালন অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তখন মানুষের এই দুর্দশার কথা চিন্তা করে তাদের কষ্ট লাঘবের জন্য ঠাকুর এই বাথানের জমি তাঁর প্রজাদের দান করেছিলেন।
১৮৮৯ সালে পারিবারিক জমিদারির দায়িত্ব পালনের জন্য বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কুষ্টিয়ার শিলাইদহে আসেন এবং ১৮৯৯ সাল পর্যন্ত মাঝেই মাঝেই দীর্ঘদিন কবি এখানে বসবাস করেছেন। এই শিলাইদহ ছিল কবির সাহিত্য রচনার উর্বরভূমি। সোনার তরীর বেশিরভাগ কবিতা এখানে বসেই তিনি লিখেছিলেন। খেয়া, বলাকা, চোখের বালি ছাড়াও অনেক কালজয়ী সাহিত্য এখানে জন্ম নেয়।
পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত কালিগ্রাম পরগনার জমিদারি দেখা শোনার জন্য কবি ১৮৯১ সালে প্রথম নওগাঁর পতিসরে আসেন। এখানে এসে তিনি এখানকার মাটি ও সহজ-সরল মানুষদের ভালোবাসতে শুরু করেন। জনসাধারণ তাঁকে ভক্তি ও সম্মান করত। গরিব মানুষগুলোর আর্থিক দীনতা কবিকে ভাবাত। পতিসরের সাধারণ মানুষের উন্নয়নের জন্য তিনি দাতব্য চিকিৎসালয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে কৃষকদের জন্য ব্যাংক পর্যন্ত স্থাপন করে দেন। প্রথমে মন বসাতে না পারলেও পরবর্তীতে পতিসরের সবুজ প্রকৃতির শব্দহীন নীরবতা কবিকে আকুল করেছিল। এখানে বসেই তিনি রচনা করেছেন চিত্রা, সন্ধ্যা, গোরা, ঘরে-বাইরেসহ অন্যান্য। রবিঠাকুরের বিখ্যাত ছোটগল্প প্রতিহিংসা ও ঠাকুরদা এই পতিসরেই রচিত হয়েছিল।
আমাদের সবার প্রিয় রবীন্দ্রসংগীতÑ ‘আমি কান পেতে রই’ কবি পতিসরে বসে লিখেছেন। ১৯৩৭ সালের জুলাই মাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষবার পতিসরে আসেন। পতিসরে ঠাকুরের কুঠিবাড়ি তাঁর স্মৃতির স্বাক্ষর হয়ে আছে।
১৮৬১ সালের ৭ মে, বাংলা পঁচিশে বৈশাখ ১২৬৮, কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বাংলা সাহিত্যের এই প্রাণপুরুষ। পশ্চিমবাংলায় জন্মগ্রহণ করলে ও এপার বাংলার মানুষকেও প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিলেন। পূর্ববাংলার নদী, ফসলের মাঠ, বাথান, সবুজ প্রকৃতি ও মানুষগুলো তাঁর সৃষ্টিতে নিঃশব্দে জেগে থাকবে অনন্তকাল। যতদিন বাংলা ও বাঙালি থাকবে কবির সাহিত্যকর্ম আলোকদ্যুতির মতো আলো ছড়াবে তাদের হৃদয় জুড়ে।
১৬৪তম জন্মদিনে কবিকে শ্রদ্ধার্ঘ্য– কে বলে গো এই প্রভাতে নেই তুমি!