হাসনাত শাহীন
প্রকাশ : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২২:১১ পিএম
আপডেট : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২২:১১ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
বই মানুষকে শুধু জ্ঞান দান করে না, মানুষের চিন্তা-চেতনা ও বোধের সমৃদ্ধিও ঘটাই। পাল্টে দিতে পারে যেকোন মানুষের জীবনাচার। যে কারণেই হয়তো যুগের বহমানতায় সৃষ্টি হয়েছে সাহিত্যের নতুন নতুন সব ধারা। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বইয়ের প্রকার ভেদ-‘সৃজনশীল’ ও ‘মননশীল বই’।
যেখানে সৃজনশীল বলতে আমরা পেয়েছি- গল্প, কবিতা, ছড়া, উপন্যাস, নাটকসহ হালের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি বা সায়েন্স ফিকশন। আর মননশীল বলতে আমরা পেয়েছি- সমাজ, জাতি, রাষ্ট্র, ইতিহাস-ঐতিহ্যসহ সৃজনশীল সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বুদ্ধিভিত্তিক লেখনী। যা, মানবীয় গুণাবলী অর্জনের অন্যতম বাহন এবং জীবনের পথনির্দেশক। এ জন্যেও প্রতিবছর অমর একুশে বইমেলা এলেই সারাদেশের মানুষ ছুটে আসে বই কিনতে। এবারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। প্রতিদিনই মানুষ আসছে, বই বিক্রিও হচ্ছে। বইমেলার শুরু থেকে রবিবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে তেমনটি দেখা গেছে।
বইমেলায় প্রতিদিনই আসছে বিষয়বৈত্রিময় প্রচুর নতুন বই। কিন্তু প্রতিবারের মতো এবারের মেলায়ও দেখা গেছে সৃজনশীল বইয়ের চেয়ে মননশীল বা প্রবন্ধের বই তুলনামূলক কম বিক্রি হচ্ছে। তবে প্রকাশকরাও জানাচ্ছেন- দিনদিন মননশীল বইয়ের পাঠক বাড়ছে। তারা বলছেন- প্রবন্ধের বই লেখাটা যেমন- সৃজনশীল, পরিশ্রমলব্ধ কাজ, প্রবন্ধের বই পড়ার জন্যও পাঠককে তৈরি হতে হয়। ভালো প্রবন্ধের বই পাঠককে সমৃদ্ধ করে। তাই সংখ্যায় কম হলেও অনেকের আগ্রহ প্রবন্ধের বইয়ের প্রতি; এবং সেই পাঠক সংখ্যা ধীরে হলেও বাড়ছে। বিশেষ করে যেসব পাঠক বিষয়ের গভীরে যেতে চান, জানতে চান নানা বিষয়ের ব্যাখ্যা, সেইসব পাঠকরাই মননশীল বই নিচ্ছেন। রুচিশীল, সাহিত্যমনা পাঠকের কাছে প্রবন্ধের বইগুলোর চাহিদা বেশি।
এ বিষয়ে দেশের মননশীল বইয়ের অন্যতম প্রকাশনা সংস্থা ‘অবসর প্রকাশনী’র ব্যবস্থাপক মাসুদ রানা প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, বিভিন্ন বিষয়ে পাঠের আগ্রহ বাড়ছে পাঠকের। গল্প-কবিতা-সায়েন্স ফিকশন শুধু নয় অর্থনীতি, সমাজনীতি, বিজ্ঞান, সমাজতত্ত্ব ইতিহাস-এমনি নানান বিষয়। সেসব বইয়ের বিক্রি তুলনামূলক কম; কিন্তু পাঠক রয়েছে। আর সেই পাঠক চাহিদা দিনদিন কমছে না বরং বাড়ছে।
রোদেলা প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী রিয়াজ বলেন, চিন্তাশীল পাঠকই আসেন মননশীল বা প্রবন্ধের বইগুলো কিনতে। তাদের কথা চিন্তা করেই আমাদের প্রকাশনা থেকে নিয়মিত প্রবন্ধের বই প্রকাশ করছি। কোনো কোনো প্রবন্ধের বই গল্প ও উপন্যাসের বইয়ের চেয়েও বেশি চাহিদা থাকে। তাই আমরা চেষ্টা করি ভালো প্রবন্ধের বই প্রকাশ করতে। আর পাঠকের রুচির গঠনে প্রবন্ধের বই খুবই জরুরি। আর সারাবছরই কিছু কিছু প্রবন্ধের বই বিক্রি হয়। মেলায়ও কম-বেশি প্রবন্ধের বই চলে।
এবারের বইমেলার ১৬তম দিনে বাংলা একাডেমির জনসংযোগ উপবিভাগের তথ্য অনুযায়ী নতুন বই এসেছে ১০৪টি এবং প্রবন্ধের বই এসেছে মাত্র ৫টি। আর, এবারের মেলার আজ ১৬তম দিন পর্যন্ত মোট বই প্রকাশিত হয়েছে ১৫২১টি এর মধ্যে মননশীল বা প্রবন্ধের বই এসেছে- ৬২টি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু প্রবন্ধের বই: বিদ্যাপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে- কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক মোজাফ্ফর হোসেনের ‘ব্রাহ্মসমাজে ইসলাম সাহিত্যের সক্রিয়তাবাদ ও অন্যান্য’, অনন্যা থেকে প্রকাশিত হয়েছে- গোলাম মাওলা রনির ‘কি দেখেছি কি দেখছি’, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি. থেকে- ‘অতীত থেকে অধুনা: বাংলাদেশের নারী লেখক’, কথাপ্রকাশ থেকে- ওয়াসি আহমেদের ‘টিকিটাকা’, বিভাস থেকে এসেছে- তালুকদার সারোয়ার জাহান আরেফিনের ‘ভাটি বাংলার লোককাহিনী ও লোকসংস্কৃতি’, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ঝিন্দের বন্দী’, এমদাদ খানের ‘পূর্ববঙ্গ মৈমনসিংহ গীতিকা (২য় ও ৩য় খণ্ড)’, মজিবর রহমানের ‘বাংলা বাঙালি বাংলাদেশ’, রণেন সরকারের ‘একাত্তরের পটভূমিকায় ও অন্যান্য’, পালক পাবলিশার্স থেকে- কাজী খলীকুজ্জামান আহমদের ‘শিক্ষার তিন ভুবনে’, আফসার ব্রাদার্স থেকে- ফারহানা মাহ্রিনের ‘আহমদ ছফার উপন্যাস: সময়ের শিল্পায়ন’, ঐতিহ্য থেকে এসেছে- মো. আবদুল হাই ভুঁইয়ার ‘স্বার্থপরতার অর্থনীতি’, আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘শুদ্ধতম কবি’, জাকারিয়া প্রীণনের ‘কবির সোনালি অন্ধকার’, আলেয়া রেহমানের ‘লেখালেখি’, মো. মহিউদ্দিনের ‘গেস্ট রুম থেকে বলছি’ ও আসাদ চৌধুরীর ‘বাংলাদেশের উর্দু সাহিত্য’, বাংলাপ্রকাশ থেকে এসেছে- ড. মাহবুব হাসানের ‘গদ্যের ম্যাজিক’, আবিষ্কার প্রকাশনী থেকে এসেছে- গোলাম কিবরিয়া’র ‘বাংলাদেশী জাতীয়তার প্রেক্ষাপট’, আলী সানোয়ার ও দেলোয়ার হাসানের ‘র-রক্ষীবাহিনী-র্যাব ও অন্যান্য’, ‘গাজীউল হাসানের ‘রাজনীতির অগ্নিপুরুষ: ভাসানী’, সাহস পাবলিকেশন্স থেকে শহীদুজ্জামানের ‘আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের তত্ত্বাবলি’, শোভা প্রকাশ থেকে আফরোজা খাতুনের ‘বাংলা সাহিত্য ও সংগ্রামে নারী’, ফরিদ উদ্দিন নীরদের ‘সিরাজ সিকদার হত্যার অপ্রকাশিত অধ্যায়’ ও আবদুল হাই শিকদার ‘জানা-অজানা মওলানা ভাসানী’, কারুকাজ প্রকাশনী থেকে- আতাউর রহমান মিটন ‘সময় বিচিন্তা’ ও রেজাউল করিম সিদ্দিকের ‘অন্তরালের কথা’, আগামী প্রকাশনী থেকে হাবীবুল্লাহ সিরাজী ‘তিন ভুবনের চাঁদ’, ম্যাপ লেখনী থেকে- সিলভীয়া’র ‘শিক্ষার আপন সত্তা’, রোদেলা প্রকাশনী থেকে এসেছে- ড. মিজানুর রহমান ‘রহু চন্ডালের হাড়’ ও শেখ সায়মন পারভেজ হিমেলের ‘তারুণ্যের স্বদেশ ভাবনা, পাঠক সমাবেশ থেকে- আবু সাইদ খানের ‘মুক্তিসংগ্রামে বিপ্লববাদ ও অন্যান্য’, স্বরলিপি পাবলিকেশন থেকে ড. সাহেদ মন্তাজের ‘নজরুল ও বিবিধ প্রসঙ্গ’, আহমদ পাবলিশিং হাউজ থেকে কাজী জহিরুল ইসলামের ‘প্রমিত উচ্চারণের ভেতর’, প্রতিভা প্রকাশ থেকে সুমন সুবহানের ‘ফুটনোটে জলছাপ’, জাগৃতি প্রকাশনী থেকে সেলিম জাহানের ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি : বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’, পুথি প্রকাশ থেকে মোহাম্মদ আসাদুজ্জামানের ‘সোনার মানুষটিকে আমরা কোথায় রাখলাম’, প্রিয় বাংলা প্রকাশন থেকে ফারহানা রহমান মিষ্টির ‘জীবন যাপনে’, বেহুলা বাংলা থেকে আহমেদ উল্লাহের ‘অমুসলিম মনীষীদের দৃষ্টিতে মুহাম্মদ (সা.)’, রইশ উদ্দীন আহমদের ‘এক অদম্য পথিকের গান’, ছিন্নপত্র প্রকাশন অথই নূরুল আমিনের ‘আমার যুদ্ধ কলমে’ ও সরকার আজিজের ‘শ্বাসমূলের নিশ্বাস’ এবং গ্রন্থিক প্রকাশন থেকে বেরিয়েছে মুহাম্মদ গোলাম সারোয়ারে ‘পুরুষ শ্রেষ্ঠত্ব’।
এদিকে, আজ সাপ্তাহিক কর্মদিবস রবিবার মেলার দ্বার খোলে বিকেল তিনটায় এবং বন্ধ হয় রাত নয়টায়। অপরদিকে সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) এবারের মেলার ১৭তম দিনে মেলার প্রবেশ পথ খুলবে বেলা ৩টায় এবং বন্ধ হবে রাত ৯টায়।
মেলার মূল মঞ্চের আয়োজন
আজ রবিবার বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘জহির রায়হানের সাহিত্যকর্মে ঐতিহাসিক ঘটনার ‘বিচার’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন- সহুল আহমদ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন- মশিউল আলম এবং আহমাদ মোস্তফা কামাল। সভাপতিত্ব করেন- মাহবুব হাসান। আলোচনা শেষে একই মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এতে আবৃত্তি পরিবেশন করেন- আবৃত্তিশিল্পী আজহারুল ইসলাম রনি এবং ডা. মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন। আজ ছিল মো. আবুজার গিফারী’র পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘শিল্পতরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ এবং মোবাস শিরীন মোস্তফার পরিচালনায় ‘বেণুকা ললিতকলা কেন্দ্র’-এর পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী দেবিকা রানী পাল, জাহিন খান নেজাম, আনিলা আমীর লামী, সুমন চন্দ্র দাস, মো. টিপু চৌধুরী, মিতালী সরকার এবং ডালিয়া সুলতানা। শিল্পীদের সঙ্গে যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন- স্বপন কুমার দাস (তবলা), আনোয়ার সাহদাত রবিন (কী-বোর্ড), মো. শহিদুল ইসলাম (বাঁশি) এবং সুমন কুমার সাহা (অক্টোপ্যাড)।
বইমেলার সোমবারের কর্মসূচি
সোমবার বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘জীবন ও কর্ম : আল মাহমুদ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন- মজিদ মাহমুদ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন- মুসা আল হাফিজ এবং কাজী নাসির মামুন। সভাপতিত্ব করবেন- মাহবুব সাদিক। এরপর একই মঞ্চে সন্ধ্যায় শুরু হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এতে থাকবে-কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ, কবিতা-আবৃত্তি ও সংগীত পরিবেশনা।