হাসনাত শাহীন
প্রকাশ : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২১:১৪ পিএম
প্রতীকী ফটো
‘দলে দলে নরনারী ছুটে এল গৃহদ্বার খুলি, লয়ে বীণা বেণু। মাতিয়া পাগল নৃত্যে হাসিয়া করিল হানাহানি, ছুঁড়ি পুষ্পরেণু।’ কবিগুরু রবি ঠাকুরের ‘বসন্ত’ কবিতার কথায় যেন সত্যে পরিণত হলো। কবিগুরুর হাত ধরেই ঋতুবরণের যে উৎসবের সূচনা হয়েছিলো সেই ঋতুবরণের অংশ হিসেবে প্রতি বছরের মত এবারও শীতের ঝরা পাতার দিনের শেষে প্রকৃতিতে প্রাণপ্রতিষ্ঠার আনন্দ-উৎসবে যোগ দিল হাজার-হাজার উৎসবপ্রিয় বাঙালি। সারা বছরের সব ভেদা-ভেদ ভুলে যেন পুরো দেশবাসি বরণ করে নিলো ঋতুরাজ ‘বসন্ত’-কে।
এমনই বসন্তের প্রথম মাস ফাগুনের আগুন ঝরানো প্রথম দিনের মাতাল হাওয়ায় মিলে মিশে একাকার হলো সব বাঙালির প্রাণ। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে উৎসবপ্রিয় সকল বাঙালির বসন্তবরণে মিলিত সেই প্রাণের ঢেউ এসে ভিড়লো একুশের চেতনাবাহি বাঙালির আরেক প্রাণের উৎসব প্রাণের মেলা ‘অমর একুশে বইমেলা’য়। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার প্রাণে-প্রাণে যেন, মিলে মিশে একাকার হয়ে গেল দুটো-প্রাণের উৎসব।
‘বসন্ত বরণ’ আর ‘প্রাণের মেলা-বইমেলা’ এই দুটো উৎসবের একপ্রাণের অনুপম আবেগের টানে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন কবি মাজহার সরকার। তিনি প্রতিদিনের বাংলাদেশ’কে বলেন, আজ প্রিয় ঋতু ‘বসন্ত’র প্রথম দিন-পহেলা ফাল্গুন এবং ভালোবাসা দিবস। এ জন্যেই আজ মেলায় একটু ভিন্নতর ভালোলাগা নিয়ে এসেছি। বইমেলায় এসে মনে হচ্ছে- যেন শরষে ফুলের বিস্তৃত মাঠ এক। বিশেষ করে মেয়েদের লাল-হলুদ-বাসন্তি রঙের শাড়ি পরার সঙ্গে মাথায় ফুলের পোপর পরার অনন্য-অপরুপ দৃশ্য আর ছেলেদের পরনে রঙিন পাঞ্জাবি পড়ার দৃশ্য দেখে।
এভাবেই এক টানা বলেও থামলেন না কবি! আবারও বলে চলে চললেন- আজ যদি মেলায় না আসতাম তাহলে চারিদিকের এই বসন্তের এই অনন্য মূখরতা উপভোগ করতে পারতাম না। উপভোগ করতে পারতাম না- এই সময়ের ভালোবাসা দিবসের রঙ। এই ফাগুন-এই বসন্ত-এই ভালোবাসা দিবসের মাখামাখি নিয়েই তো আমরা বেঁচে থাকি।
হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী অনন্য অসাম্প্রদায়িক সংষ্কৃতির উৎসবপ্রিয় বাঙালি যেন এভাবেই বেঁচে থাকেÑ সেই উদাহরণ মূর্ত হয়ে উঠলো আজ শুক্রবার পহেলা ফাল্গুন আর মেলার ১৪তম দিনে ‘অমর একুশে বইমেলা’র দুই প্রাঙ্গণ। পাশাপাশি ফুলে-কল্লোলে মুখর ছিল শাহবাগ থেকে টিএসএসি হয়ে দোয়েল চত্বর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত এলাকাসহ রাজধানীর সকল প্রায় সব-প্রান্ত। সেই আবহ-ই যেন পুরো মেলা প্রাঙ্গণে লেগেছে। যার ফলে মেলা প্রাঙ্গণ ছেঁয়ে যায় হলুদ আর বাসন্তি রঙের ছোঁয়ায়। তরুণীরা বসন্তের সাজে নিজেদের সাজাতে খোপায়-গলায়-মাথায় পরেছে গাঁদা ফুলের মালা, হাতে রেশমি চুড়ি আর পরনে বাসন্তি রঙের শাড়ি। পুরুষদের পরনেও শোভা পায় রঙিন পাঞ্জাবি-ফতুয়া। কেউ-কেউ হাতে-মুখে আঁকিয়েছেন আল্পনা।
এমনই সাজ-সজ্জায় রাজধানীর নানা স্থানের বসন্ত বরণের উচ্ছসিত উৎসবে ঢুঁমেরেই সকাল গড়িয়ে দুপুর, আর দুপুর গড়িয়ে বিকালের আগে-আগেই নগরীর বিভিন্ন প্রান্তের তরুণ-তরুণীরা বইমেলার আশেপাশে ভিড় করতে থাকেন। বিশেষ করে- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে আয়োজিত সকালের বসন্তবরণ উৎসবে অংশ নেওয়া সবারই দ্বিতীয় গন্তব্য ছিল বইমেলা। সাপ্তাহিক ছুটির দিন এবং মেলার শিশুপ্রহর উপলক্ষে বেলা এগারটায় মেলার প্রবেশ পথ খুলে দিলে- ফাগুনের মাতাল হাওয়া, গাছের পাতঝরা সুমিষ্ট ঝংকার আর কোকিলের কুহুতানে জেগে ওঠার এই দিনে শিশু-কিশোরদের সঙ্গে নানা বয়সী মানুষের প্রাণের মেলা ‘অমর একুশে বইমেলা’ ছেঁয়ে যায় বাসন্তী রঙের বর্ণিল ছোঁয়ায়।
সময়কে যত গড়িয়ে যায় মেলার উভয় অংশে ততই বাড়তে থাকে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার ভিড়। আর সন্ধ্যার আগে আগে মেলা প্রাঙ্গণ পরিণত হয় জনসমুদ্রে। সেই জনসমূদ্র বইমেলার উভয় প্রাঙ্গণে শেষ সময় পর্যন্ত বয়ে দিয়েছে অনাবিল উচ্ছাসের উচ্ছসিত প্রাণচঞ্চলতায়। ফাগুনের এ উচ্ছসিত-প্রশান্তিময় আগুনে প্রকাশকদের খুশির মাত্রা বাড়ানো দিনে মেলায় বসন্তের এই প্রথম দিনের ফুলের বাহারে তারুণ্যেও ফুলেল উপস্থিতির মতোই বেচাকেনাতেও ছিলো মধুময় বসন্তের ছোঁয়া। মেলায় আগতরা তারুণ্যের উচ্ছসিত আবেগে কেউ কেউ হাতে হাত রেখে ঘুরেছেন মেলা প্রাঙ্গণে। একে অপরকে উপহার দিয়েছেন প্রিয় লেখকের নতুন বই। ফাল্গুনের এমনই আবহ মেখে উৎফুল্ল দিন অতিবাহিত করা লেখক-প্রকাশকরাও বিপুল খুশি। সেই খুসির রেশ আগামীকাল শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন এবং এবারের মেলার ১৫ দিনেও অতিবাহিত হবে-এমনই আশা প্রকাশ করতেও দ্বিধা করছেন না তারা।
শুক্রবারের মেলার নতুন বই: বাংলা একাডেমির জনসংযোগ উপবিভাগ থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, শুক্রবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) ১লা ফাল্গুন ‘বইমেলা’র ১৪তম দিনে নতুন বই এসেছে ২৫০টি। এসব বইয়ের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বই হলো- বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে- গোলাম মোহাম্মদ ভূঞা’র গবেষণাগ্রন্থ ‘সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও তাঁর বিখ্যাত আবিষ্কার’, সময় প্রকাশন থেকে বেরিয়েছে- হাফিজা শারমীন সুমী’র উপন্যাস ‘মেঘ বরষা ঝুম’, অনুপম প্রকাশনী থেকে- স্বপন কুমার গায়েনের কিশোর সাহিত্য ‘স্বাতীর কীর্তি’, পাঠক সমাবেশ এনেছে- আবু সাইদ খানের প্রবন্ধ বই ‘মুক্তিসংগ্রামে বিপ্লববাদ ও অন্যান্য’, উৎস প্রকাশন থেকে এসেছে- কাঁলাচাদ শীলের কাব্যগ্রন্থ ‘বিশুদ্ধ ভালোবাসা অমর কাব্য’, ভাষাচিত্র প্রকাশনী থেকে হাসান তারেক চৌধুরী’র পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ক বই ‘হিগস বোসন বা গড় পার্টিকেল’, অবসর থেকে এসেছে- খোন্দকার মেহেদী হাসানের থ্রিলার বই ‘টাইম ট্রাভেলার্স রিং’ ও প্রিম রিজভী সীমা’র সায়েন্স ফিকশন ‘দংশন’, ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ থেকে এসেছে- ইনতিশা তাবাসসুমের কাব্যগ্রন্থ ‘নির্বিশঙ্ক’, এক রঙা এক ঘুড়ি প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছে- সাদ-ই-বাহার হামিদের কবিতার বই ‘ফাগুন হাওয়া’ এবং কথাপ্রকাশ থেকে এসেছে- সাহরীন ফেরদৌসসের উপন্যাস ‘জলজ লকার’ ইত্যাদি।
মেলার মূলমঞ্চের আয়োজন: শুক্রবার, বইমেলার ১৪তম দিনের বিকেলে মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘আহমদ ছফার আগ্রহী যুবকেরা’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন- তাহমিদাল জামি। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন- নূরুল আনোয়ার এবং সাজ্জাদ শরিফ। সভাপতিত্ব করেন-সলিমুল্লাহ খান।
এরপরেই সেখানে অনুষ্ঠিত হয় সাংস্কৃতিক আয়োজন। এতে কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ করেন-কবি জাহাঙ্গীর ফিরোজ, কবি চঞ্চল আশরাফ, কবি আসাদ কাজল, কবি হিজল জোবায়ের, কবি তাসনোভা তুশিন, কবি সুনৃত সুজন, কবি নাজমা আহমেদ এবং কবি মো. শফিক-উল-ইসলাম। আবৃত্তি পরিবেশন করেন- আবৃত্তিশিল্পী ফেরদৌসী বেগম, ইশিতা জাহান অর্ণা, শিমুল পারভীন এবং আবীর বাঙালি।
এদিকে আজ মেলার সোহরাওয়ার্দী প্রাঙ্গণের ‘লেখক বলছি’ মঞ্চে নিজের নতুন বই নিয়ে আলোচনায় অংশ নেনÑ কবি আসাদ কাজল।
আগামীকালের বইমেলার আয়োজন: আগামীকাল শনিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) এবারের বইমেলার ১৫তম দিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাজনিত কারণে এ দিনের মেলার প্রবেশ দ্বার খুলবে সকাল ১১টার পরিবর্তে দুপুর ২টায় এবং চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। এই দিন মেলায় থাকবে না পূর্বঘোষিত শিশুপ্রহর। এর মধ্যে বিকাল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘জীবন ও কর্ম: সৈয়দ আলী আহসান’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন- কবি মুহম্মদ আবদুল বাতেন। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন- তারেক রেজা এবং মহিবুর রহিম। সভাপতিত্ব করবেন- আবদুল হাই শিকদার।