হাসনাত শাহীন
প্রকাশ : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২০:৫৭ পিএম
আপডেট : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২১:৪২ পিএম
নির্বাসিত কবি ও কথাসাহিত্যিক তসলিমা নাসরিনের বই ‘চুম্বন’ কে কেন্দ্র করে সোমবার (১০ ফেব্রুয়ারি) প্রকাশনা সংস্থা ‘সব্যসাচী’র স্টল ভাঙচুর ও তার স্বত্বাধিকারী শতাব্দী ভবকে মারধর করার মতো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার পর মেলায় অংশ নেওয়া বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থার সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্টরা অনেকেই অনুমান করেছিলেন বইমেলায় আতঙ্ক ও উদ্বেগের সৃষ্টি করবে।
মঙ্গলবার (১১ ফেব্রুয়ারি) বইমেলার ১১তম দিনের শুরু থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে ঘুরে তাদের সেই আশঙ্কাকে বইপ্রেমী পাঠকরা বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়েছে। প্রকাশনা সংস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেনÑ মাত্র একদিন আগেই বইমেলায় ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্খিত ও অপ্রীতিকর ঘটনার পরে মেলায় এমন লোকসমাগম আশাব্যঞ্জক। আমরা চিন্তায় করিনি আজ মঙ্গলবার কর্মমুখর দিনে বইমেলায় এমন লোকজন আসবে এবং বই বিক্রি হবে।
মুক্তদেশের বিক্রয়কর্মী ঐশ্বর্য বলেন, গত রবিবার ও সোমবার অর্থাৎ গত দুই দিনের চেয়ে আজ (মঙ্গলবার) আমাদের বিক্রি বেশি হয়েছে। সম্প্রীতি প্রকাশনীর স্বত্তাধিকারী রেজাউল করিম বিল্লাল বলেন, ‘যা প্রত্যাশা করেছিলাম তার চেয়ে আজ অনেক বেশি লোকসমাগম ও বই বিক্রি হয়েছে। আজ গত ছুটির দিন শনিবারের চেয়ে বেশি বিক্রি করেছি।
বাবা তৌফিক অপুর হাত ধরে রাজধানীর বাড্ডা লিংক রোড থেকে মেলায় আসেন দ্বিতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী ওয়াসি। কি বই কিনেছো জানতে চাইলে ওয়াসি বলেন, ঠাকুরমার ঝুলি ও কার্টুনের বই কিনেছি। ক্ষুদে পাঠকের কথা শেষ না হতেই তার বাবা তৌফিক অপু বলেন, গত কয়েকদিন যাবত আসব আসব বলে আসা হচ্ছিল না। আজ মাঘি পূর্ণিমার ছুটি থাকাতে স্কুল বন্ধ ছিল; তাই বাচ্চাকে নিয়ে এলাম। শুক্র, শনিবার ভিড় বেশি থাকে বলে আজ বই মেলায় এসেছি। ভাবলাম কর্মব্যস্ত দিনে ভিড় কম থাকবে। কিন্তু ভিড় দেখে আমি নিজেই অবাক। এর আগে শনিবার মেলায় এসেছিলাম। আমার তো মনে হচ্ছে শনিবার ছুটির দিনেও এত ভিড় ছিল না।
এদিকে, সন্ধ্যার পরপর এবারের বইমেলার মূল প্রাঙ্গণ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিস্তীর্ণ প্রান্তর থেকে বের হওয়ার পথে অনেকের হাতে ব্যাগভর্তি বই নিয়ে যাওয়ার দৃশ্যও দেখা গেছে। আর এমন বইয়ের ব্যাগ হাতে যাওয়া দেখে মেলায় প্রবেশ করতে যাওয়া এক কয়েকজন বলে উঠলেন- এভাবে প্রতিদিন যদি মানুষ বই কিনে ফেরে; তাহলে এবারের বইমেলা সফল হবে।
মেলার নতুন বইয়ের তথ্য
বাংলা একাডেমির জনসংযোগ উপবিভাগ জানায়, আজ মঙ্গলবার মেলার ১১তম দিনে নতুন বই এসেছে ৯১টি। এ পর্যন্ত মেলায় মোট নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে ৮২৮টি। এরমধ্যে গল্পের বই- ১০৫টি, উপন্যাস- ১৫৪, প্রবন্ধ- ৩৫, কবিতা- ২৫৩, গবেষণা- ১৬, ছড়া- ১১, শিশুতোষ- ১৭, জীবনী- ২৬, রচনাবলি-৬, মুক্তিযুদ্ধ- ৭, নাটকের বই- ১০, বিজ্ঞান- ১৮, ভ্রমণ- ১০, ইতিহাস- ২৪, রাজনীতি- ১২, চিকিৎসাশাস্ত্র- ২, ভাষার বই- ৫, গণ অভ্যুত্থান- ৫, ধর্মীয়- ১৫, অনূবাদ- ৬, অভিধান- ২, সায়েন্সফিকশন- ৬ ও অন্যান্য বিষয়ে বই প্রকাশিত হয়েছে ৮০টি।
মেলার মূলমঞ্চের আয়োজন
আজ বিকালে বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘আদর্শায়িত কল্পলোক ও শাহেদ আলীর দ্বিধাচিত্ত মন’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন শিবলী আজাদ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন মোস্তাক আহমাদ দীন। সভাপতিত্ব করেন চঞ্চল কুমার বোস।
সব্যসাচী’র স্টল বন্ধ, মিশ্র প্রতিক্রিয়া
এদিকে, তসলিমা নাসরিনের বই ‘চুম্বন’কে কেন্দ্র করে প্রকাশনা সংস্থা ‘সব্যসাচী’র স্টল ভাঙচুর করা ও তার স্বত্বাধিকারী কবি ও কণ্ঠশিল্পী শতাব্দী ভব’কে মারধর করার করার কারণে স্টল বন্ধ রেখেছে প্রকাশনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। আজ মঙ্গলবার সরেজমিনে মেলার মূলপ্রাঙ্গণ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে অবস্থিত ‘সব্যসাচী’র স্টল প্রাঙ্গণে গিয়েও বন্ধ দেখা গেছে।
সব্যসাচী’র প্রকাশক মেহেরান সানজানা প্রতিদিনের বাংলাদেশকে জানান, আমরা নিরাপত্তার কারণে কয়েকদিন স্টল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এখনকার যে পরিস্থিতি তা থেকে একটু উত্তরণ হলে এবং বাংলা একাডেমি যদি স্টল খোলার সিদ্ধান্ত দেয় ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে; তাহলে স্টল খুলব। নতুবা কি করব; সেই সিদ্ধান্ত পরে গ্রহণ করব।’
অন্যদিকে, সব্যসাচী’র সঙ্গে ঘটে যাওয়া গত সোমবারের এ অপ্রীতিকর ঘটনা ও হট্টগোল নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন বেশ কয়েকজন প্রকাশক। প্রকাশনা সংস্থা সব্যসাচী পরিকল্পিতভাবে এই অপ্রীতিকর ঘটনার নেপথ্যে ইন্ধন যুগিয়েছিলেন বলে জানান তারা। তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আগামী প্রকাশনী, অন্বেষা ও বিদ্যাপ্রকাশ অনেক বছর আগেই তসলিমা নাসরিনের বই প্রকাশ করেছিল। কিন্তু তারা স্টলে বই রাখেনি। তাহলে সব্যসাচী কেন তাদের স্টলে বিতর্কিত ও নিন্দিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনের বই রাখল এবং পরে সরিয়েও ফেলল এ নিয়ে প্রকাশকদের মাঝে নানা ধরনের প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এছাড়া হুমায়ুন আজাদের মতো বিতর্কিত লেখকের বইয়ের প্রকাশক হওয়ার পরেও আগামী প্রকাশনীতেও কেউ হট্টগোল করেনি। তাতে বোঝা যায় এটা সব্যসাচীর পরিকল্পিত।
অনন্যার স্বত্তাধিকারী মনিরুল হক বলেন, একটা রেজিম ও ফ্যাসিবাদের পর বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনের বই রেখে সব্যসাচী যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছেন সে দায় দায়িত্ব তাদেরকেই নিতে হবে। এত মানুষের হট্টগোলের মধ্যে জয় বাংলা- স্লোগান দিয়ে পরিস্থিতিকে ভিন্ন পথে উস্কে দিয়েছেন বলেও আমি মনে করি। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের আগেই ভারতের আনন্দবাজারে সংবাদ প্রকাশ হওয়াতেও অনেক প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে।
সূচীপত্র প্রকাশনীর স্বত্তাধিকারী ও বৈষম্য বিরোধী প্রকাশক সমিতির সভাপতি সাঈদ বারী বলেন, ‘পতিত ফ্যাসিবাদের দোসররা এই বইমেলাকে ওউন করছে না। তারা চায় না, বইমেলা সার্থক, সুন্দর আর সফল হোক। ঢাকার মিডিয়া প্রচারের আগেই আনন্দবাজার এত দ্রুত সংবাদটা করে ফেলল। এতে বোঝা যায়- ফ্যাসিবাদের শিকড় অনেক গভীরে।’
আমার মনে হয়েছে, ফ্যাসিবাদের দোসরদের গভীর ষড়যন্ত্রের ফলই হচ্ছে সোমবারের ঘটনা। সুষ্ঠু তদন্ত হলে প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসবে। এর সঙ্গে জড়িতদের বিচার দাবি করছি।
সৃজনীর স্বত্তাধিকারী মশিউর রহমান বলেন, মেলাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার
জন্য সব্যসাচী প্রকাশনীর এটা একটা ঘৃণ্য চক্রান্ত। ষড়যন্ত্রের দায়ে তাদেরকে বিতর্কিত
লেখিকা তসলিমা নাসরিনের বইয়ের প্রকাশক শতাব্দী ভবকে আইনের আওতায় আনা উচিত।