সাহিত্য সংবাদ
প্রবা প্রতিবেদন
প্রকাশ : ০৬ জানুয়ারি ২০২৫ ১৬:৩৫ পিএম
আপডেট : ০৬ জানুয়ারি ২০২৫ ১৭:৪২ পিএম
ছবিতে প্রকাশক, অতিথিবৃন্দ ও সম্পাদনা পর্ষদের সদস্যের সঙ্গে পুরস্কার বিজয়ীরা
সময়টা যদি হয় শনিবার ৪ জানুয়ারি, ২০২৫, জায়গাটা যদি হয় রাজধানীর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ইসফেনদিয়ার জাহেদ হাসান মিলনায়তন, সারা দেশ থেকে আসা তরুণ লেখকরা এখানেই ভিড় জমাবেনÑ এটাই স্বাভাবিক। শুধু কি তরুণ! যশস্বী লেখক, প্রাজ্ঞ সংস্কৃতজনসহ প্রায় সব শ্রেণির মানুষেই সর্বজনীন সমাবেশস্থল হয়ে উঠেছিল দোতলার কক্ষটির সঙ্গে মিলিয়ে একচিলতে করিডোর। কয়েকদিন যাবৎ তীব্র শীত হুল ফোটালেও শনিবার বিকালের প্রকোপ ছিল অনেকটাই সহনীয় মাত্রার।
অনুপ্রাণন প্রকাশনের
নিয়মিত আয়োজনের আরেকটি জমকালো আসর বসেছিল এই দিন। লেখক সম্মেলন, নির্বাচিত তিনটি বইয়ের
পাঠ-উন্মোচন ও তরুণ পাণ্ডুলিপি পুরস্কার-২০২৫ প্রদানÑ এমনই ছিল অনুষ্ঠান পরিকল্পনায়।
কিন্তু তিন পর্বের অনুষ্ঠান যে চার পর্বে গিয়ে পৌঁছাবে এটা আয়োজকদের কল্পনারও বাইরে
ছিল। শেষ পর্যন্ত সেটাই হলো। ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪-এ গতায়ু হন অনুপ্রাণন সম্পাদনা পর্ষদের
অন্যতম সদস্য সুলতানা শাহরিয়া পিউ। বাচিকশিল্পী, কবি ও অনুবাদক সুলতানা শাহরিয়া পিউকে
শ্রদ্ধা-স্মরণের মাধ্যমেই শুরু হয় অনুষ্ঠান। ড. অনুপম কুমার পালের কণ্ঠে ‘তুমি কি কেবলই
ছবি/শুধু পটে লেখা...’ গানটি গাওয়ার মধ্য দিয়েই সূচনা হয় অনুষ্ঠানের। হল ভর্তি মানুষের
মধ্যে নেমে আসে নৈঃশব্দ্য।
স্মৃতিচারণা করেন
পিউর ঘনিষ্ঠ সহচর রুখসানা কাজল, আমিরুল বাসার ও মারুফ রায়হান। স্বাগত বক্তব্যে সম্পাদক
ও প্রকাশক আবু এম ইউসুফ অনুষ্ঠানের ধারাপরম্পরা বর্ণনার পাশাপাশি সুলতানা শাহরিয়া পিউ
ওতপ্রোতভাবে অনুপ্রাণনের কার্যক্রমের সঙ্গে কীভাবে যুক্ত ছিলেন স্মৃতিমেদুর কণ্ঠে যুগ-পেরোনোর
গল্পগাথা তুলে ধরেন। স্মৃতিতর্পণ শেষে তিনি আরও বলেন, ‘অনুপ্রাণন কোনো দল নয়, গোষ্ঠীও
নয়। বাংলাদেশের সব লেখকের একটা প্ল্যাটফর্ম। বিশেষ করে তরুণ লেখকদের। দলমতনির্বিশেষে
সব লেখকেরই প্ল্যাটফর্ম এটা। প্রগতিশীল হিসেবে নিশ্চয়ই আমরা প্রতিক্রিয়াশীলতাকে সমর্থন
করি না। ১৫ বছর যাবৎ শিল্প-সাহিত্য চর্চায় কাজ করে যাচ্ছে অনুপ্রাণন। এটা আরও এগিয়ে
যাবে। আমাদের লক্ষ্য থেকে কখনও বিচ্যুত হব না।’
প্রকাশকের বক্তব্যের
পর আমন্ত্রিত আটজন বিশেষ অতিথি ইসহাক খান, নীরু শামসুন্নাহার, মণীশ রায়, সরকার আবদুল
মান্নান, শোয়েব শাহরিয়ার, গোলাম কিবরিয়া পিনু, মোজাম্মেল হক নিয়োগী ও স্বকৃত নোমানকে
ফুল দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়। এরপর শুরু হয় বই আলোচনা। আবদুল মান্নান সরকারের ‘উদ্বাস্তু’
উপন্যাসটি আলোচনা করেন সরকার আবদুল মান্নান। এ দুই লেখক একই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন
করেছেন। ব্ক্তব্যের শুরুতে সরকার আবদুল মান্নান সরস ভঙ্গিতে দুজনের অভিন্ন নাম থাকার
কারণে কী ধরনের বিড়ম্বনা সৃষ্টি হতো তা উল্লেখ করেন। পরে একজন নিজ নামাংশ সরকার-এর
স্থানচ্যুতি ঘটালেও আপাত সমস্যার সমাধান হয়। কিন্তু প্রকৃত অর্থে বিভ্রান্তি আর ঘুচল
না!
মোখলেস মুকুল
রচিত উপন্যাস ‘বঙ্গালী ভইলী’র আলোচনা করেন শোয়েব শাহরিয়ার। চর্যাপদে খুঁজে পাওয়া সেকালের
জনজীবন নিয়ে এ উপন্যাসের অবয়ব গঠিত। উপন্যাসটির গুরুত্ব ও প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে শোয়েব
শাহরিয়ার বলেন, ‘বাঙালি জাতির গৌরবোজ্জ্বল দিকগুলো নিয়ে উপন্যাস কমই লেখা হয়েছে। মোখলেস
মুকুল এ উপন্যাসে এমন সব শব্দ ব্যবহার করেছেন এটা আশ্চর্য ঘটনা। প্রাচীন আমলের প্রচুর
শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। সব মিলিয়ে এটা অসাধারণ বই।’
প্রাজ্ঞ এ আলোচক
আরও বলেন, ‘ইতিহাস কেন্দ্র করে কালোত্তীর্ণ, রসোত্তীর্ণ বা চিরায়ত উপন্যাস বেশি লেখা
হয়নি। বঙ্গালী ভইলী উপন্যাসে মোখলেস মুকুল যে বিষয়গুলো সন্নিবেশিত করেছেন, সেটা ধারণ
ও বিশ্লেষণ করা সহজ বিষয় নয়। দীর্ঘকাল পর চমৎকার একটি উপন্যাস পড়লাম।’
প্রবীর বিকাশ
সরকারের লেখা ‘জানা অজানা জাপান’ পাঁচ খণ্ডের বইটি নিয়ে আলোচনা করেন নীরু শামসুন্নাহার।
তিনি বলেন, ‘প্রবীর বিকাশ সরকার বিরলপ্রজ লেখক। বাংলাদেশের গর্ব। বাংলাদেশ-জাপান সম্পর্কোন্নয়নের
ক্ষেত্রেও তিনি কাজ করেছেন। অন্তর্গত তাগিদ থেকে তাকে দিয়ে এসব লেখা কেউ লিখিয়ে নিয়েছে।’
অনুষ্ঠানের শেষ
পর্বে (অনূর্ধ্ব ৪০ বছর বয়সি) অনুপ্রাণন পাণ্ডুলিপি পুরস্কার বিজয়ী তরুণদের বই নিয়ে
আলোচনা করা হয়। পুরস্কারজয়ী পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ মনিকা মারইয়ামের ‘নীল সমুদ্র স্নানে’,
ফাগুন মল্লিকের ‘সন্তের মতো একা’, নুসরাত জাহান চ্যাম্পের ‘ছন্দে বাঁধা দ্বিধা’, হাসনাইন
হীরার ‘ব্রাত্যভিটার নকশা’, এমরান হাসানের ‘মোহনীয় মৃত্তিকাগণ’ নিয়ে চুলচেরা আলোচনা
করেন কবি গোলাম কিবরিয়া পিনু।
তরুণদের পাঁচটি
গল্পগ্রন্থের আলোচনা করেন কথাসাহিত্যিক মণীশ রায়। পুরস্কারজয়ী বইগুলো নিবেদিতা আইচের
‘প্রজা কাহিনি’, ফরিদুল ইসলাম নির্জনের ‘সে শুধু আড়ালে থাকে’, আরিফুল আলমের ‘আধ্যাত্মিক’,
আহাদ আদনানের ‘সেদিন বর্ষাকাল’, জয়শ্রী সরকারের ‘ঈশ্বরকে বল দুখী ডাকছে’।
তরুণদের তিনটি
বিজয়ী উপন্যাসের আলোচনা করেন কথাসাহিত্যিক মোজাম্মেল হক নিয়োগী। বইগুলো হচ্ছে কামরুল
হাছান মাসুকের ‘শরণার্থী’, মিলন আশরাফের ‘ভাগ্য এক কৌতুকের নাম’, আলিফা আফরিনের ‘বহুরূপী’।
পুরস্কারজয়ী দুই
তরুণের প্রবন্ধের বইয়ের ওপর আলোচনা করেন কথাসাহিত্যিক স্বকৃত নোমান। বই দুটি হচ্ছে
মুহাম্মদ ফরিদ হাসানের ‘চিত্রকলার জগৎ’, কাদের পলাশের ‘চাঁদপুরের সংস্কৃতি, লোককথা
ও অন্যান্য’।
আলোচকরা তরুণ
লেখকদের সম্ভাবনার কথা এবং লেখালেখির উৎকর্ষ সাধনের জন্য প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান
করেন। মোজাম্মেল হক নিয়োগী এক নামে বাংলা সাহিত্যে কতটি উপন্যাস আছে সেই পরিসংখ্যান
তুলে ধরেন। নামকরণের বিষয়ে লেখকদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন তিনি।
ইসহাক খান বিশেষ
অতিথির বক্তব্যে বলেন, ‘বাংলাদেশে যত সাহিত্য পুরস্কার আছে, সেসবের মধ্যে সবচেয়ে বড়
হচ্ছে অনুপ্রাণন পাণ্ডুলিপি পুরস্কার।’
অনুষ্ঠানের শেষ
দিকে পুরস্কার বিজয়ীদের উত্তরীয় পরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি তাদের হাতে সম্মাননা স্মারক
(প্রত্যয়নপত্র), উপহার ও নগদ অর্থ তুলে দেন বিশেষ অতিথিরা।
অনুষ্ঠানের ফাঁকে
ফাঁকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছিল সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্ব শুরু
হয় বৃন্দ আবৃত্তি দিয়ে। যৌথ এ পরিবেশনার শিরোনাম ছিল ‘আমার সীমার বাঁধন টুঁটে’। একক
নৃত্য-গীত পরিবেশন করেন রূপতি। আফরা তারান্নুমের গান দিয়ে সংগীতানুষ্ঠান শেষ হয়।
খুদে শিল্পী পূর্বা
ও পৃথা গেয়েছে বাউল শাহ আবদুল করিমের গান ‘কেমনে চিনিব তোমারে/মুর্শিদ ধনহে...।’
গান পরিবেশন করেন
রবিউল ইসলাম এবং মিথিলা আচার্যের পরিচালনায় পরিবেশিত হয় বৃন্দ নাচ।
সাংস্কৃতিক সংগঠন
‘শিল্পবাংলা’ ও সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজের ‘ললিতকলা কেন্দ্র’র শিক্ষার্থীদের অনবদ্য
পরিবেশনা দর্শকচিত্ত প্রফুল্ল করতে রেখেছে বিশেষ ভূমিকা। মুগ্ধতার রেশ ফুটে উঠেছিল
অনেকের চোখে-মুখে। সাংস্কৃতিক পর্বগুলোয় অংশ নেওয়া শিশু-কিশোরদের হাতে উপহার তুলে দেন
অনুপ্রাণন প্রকাশক আবু এম ইউসুফ ও অনুপ্রাণন সম্পাদনা পর্ষদ সদস্য কথাসাহিত্যিক সোলায়মান
সুমন।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন রূপশ্রী চক্রবর্তী, মিতা আক্তার শিখা ও খাইরুন্নাহার তামান্না।