প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০২ নভেম্বর ২০২৪ ১৮:১০ পিএম
বই এখন খুব দুর্দিনে আছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেছেন, আজকে বইয়ের ভবিষ্যত মানুষের ভবিষ্যতের মতোই ঝুঁকিপূর্ণ। মুনাফাবাদী বিশ্বব্যবস্থা মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে, স্বার্থপরে পরিণত করছে। মানুষ বই পড়ায় আগ্রহী না হয়ে, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে বাংলাদেশের মানুষ এবং সারা বিশ্বের মানুষকে বইয়ের অন্তর্গত মানবিক বাণী ধারণ করেই বেঁচে থাকার ও সুষম পৃথিবী গড়ার লড়াই করতে হবে।
শনিবার (২ নভেম্বর) বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউজ চত্বরে প্রকাশনা সংস্থা ঐতিহ্যের দুই যুগ পূর্তিতে দশদিন ব্যাপী ঐতিহ্য বই উৎসবে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
আগামী ১১ নভেম্বর পর্যন্ত এই উৎসবে প্রতিদিন সকাল ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড়ে ঐতিহ্য প্রকাশিত প্রায় দুই সহস্র বই থেকে তার পছন্দের বই সংগ্রহ করতে পারবেন পাঠকরা।
বই পড়ার গুরুত্ব সম্পর্কে তিনি বলেন, বইয়ের মধ্যে দিয়ে মানুষ সচেতন হবে, বইয়ের মধ্যে দিয়ে মানুষ পথ খুঁজে পাবে, বইয়ের মধ্যে মানুষের হৃদয় শিক্ষিত হবে। মানুষের যে বুদ্ধি সেই বুদ্ধি সংকীর্ণ থাকবে না, স্বার্থপর থাকবে না। সেই বুদ্ধি অন্যের বিরুদ্ধে শত্রুতায় লিপ্ত হবে না। সেই বুদ্ধি মানুষের সামগ্রিক উন্নতির জন্য চেষ্টা করবে।
বইয়ের ওপরে রাষ্ট্রের নানা চাপ তৈরি হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা এই দেশে রাষ্ট্র বিপ্লব করেছি। পাকিস্থান রাষ্ট্র করলাম। সেই রাষ্ট্র ভেঙে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলাম। তারপর রাষ্ট্রের অত্যাচার, নিপীড়ন, স্বৈরশাসন, ফ্যাসিবাদি দুঃশাসন দেখলাম। সে ক্ষেত্রে বইয়ের ওপরে রাষ্ট্রের চাপ তৈরি হয়। বিশেষ বিশেষ প্রকাশককে দেখেছি একজনের গুণগান শতশত বই প্রকাশ করতে।
রাষ্ট্র ও অর্থনীতির মালিকরা বই ও জ্ঞানের চর্চাকে পছন্দ করেনা উল্লেখ করে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বই যে কত গুরুত্বপূর্ণ সেটা আমরা বুঝি। এই বই বিপদের মধ্যে আছে। অনেককে দেখেছি ইন্টারনেট থেকে নামিয়ে বই দেখে নেন। কিন্তু বই দেখার বিষয় নয়; বই পড়ার বিষয়। একটা বিষয় খুবই সত্য প্রযুক্তি উন্নতি হয়েছে। এই প্রযুক্তির উন্নয়ন কিন্তু বইকে প্রত্যেক স্তরে সাহায্য করেছে। এক সময় কাগজ ছিল না। কাগজের উদ্ভাবন হয়েছে, তাতে বইয়ের সুবিধা হয়েছে। তারপর যখন ছাপাখানা এলো, বইকে সহজলভ্য করে দিল। প্রযুক্তি কিন্তু বইয়ের বিরোধিতা করেনি। এরপর রেডিও, টিভি এলেও তখনও বই বিপদে পড়েনি। কিন্তু এখন যখন কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের যুগে এলাম তখন দেখলাম প্রযুক্তি বইকে সহযোগীতা করছে না। প্রযুক্তি বইয়ের বিরোধিতা করছে। এই বিরোধিতা প্রযুক্তি ও বইয়ের কারনে নয়। কারন হচ্ছে মালিকানা। রাষ্ট্র ও অর্থনীতির মালিক যারা, তারা বই ও জ্ঞানের চর্চাকে পছন্দ করেননা। তারা মুনাফা চায়।
পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থা হটিয়ে দেশের সম্পদের সর্বজনীন মালিকানা প্রতিষ্ঠায় দেশে সামাজিক বিপ্লব গড়ে তুলতে বইয়ের ভূমিকা মুখ্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, ঔপনিবেশিক শাসকরা আমাদের দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করত। বাংলাদেশের ধনীরা এখন সেই কাজ করছে। বাংলাদেশ এখন ধনীদের উপনিবেশে পরিণত হয়েছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সমস্ত পৃথিবী রুগ্ন হয়ে পড়েছে। এ জায়গায় পরিবর্তন আনা দরকার। সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা দরকার। এই সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে বই মুখ্য ভূমিকা পালন করবে।
পৃথিবীজুড়ে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে যে লড়াই চলছে সে লড়াই বাংলাদেশেও অব্যাহতভাবে পরিচালনা করতে গেলে সংস্কৃতি চর্চায় গুরুত্বারোপ করতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের দেশে এ লড়াই চালাতে হলে সংস্কৃতির চর্চাটা খুব জরুরি। সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে বইয়ের ভূমিকাই মুখ্য ভূমিকা। সেজন্য বইয়ের কাছে যেতে হবে, বাঁচার জন্য যেতে হবে। বাঁচার অর্থ মানুষের মতো বাঁচা, মানুষের মনুষ্যত্বকে রক্ষা করে বাঁচা।
অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- লেখক-গবেষক শারমিন আহমেদ, তরুণ অনুবাদক মাহীন হক। স্বাগত বক্তব্য দেন- ঐতিহ্যের প্রধান নির্বাহী আরিফুর রহমান নাঈম। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলা সাহিত্যের ২৪টি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন অতিথিরা।