× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

৩ দশকে বিশ্বরঙ

“বিশ্বরঙ যেন মোর মর্মে লাগে”

বিপ্লব সাহা

প্রকাশ : ১১ ডিসেম্বর ২০২৪ ২৩:৪৩ পিএম

আপডেট : ১১ ডিসেম্বর ২০২৪ ২৩:৪৫ পিএম

“বিশ্বরঙ যেন মোর মর্মে লাগে”

সময় কত গতিশীল, দেখতে দেখতে অতিক্রম হয়ে যাচ্ছে ৩ দশক। ৩ দশক পূর্বে আজকে যে আলো ঝলমলে সবার ভালোবাসার রঙ্গীন “বিশ্বরঙ” তার শুরুটা বলতে গেলে মর্মে লাগানোর মতোই ছিল। কালক্রমে সেই রঙ ছড়িয়েছে কর্মে। ভরিয়েছে সকল গুনগ্রাহীর আবরণ এবং মননে। একদিন শখের বশেই দেশীয় আত্মপরিচয়ের মূল্যবোধ থেকে অনেক স্বপ্ন নিয়ে শুরু হয় ১৯৯৪ সালে ১০০ স্কয়ার ফুটের একটা দোকান নিয়ে। রাতারাতি সাফল্য যে আসে তা কিন্তু নয়। কিন্তু ক্রমেই নামটা ছড়িয়ে যায় মানুষের মুখে মুখে। ঐ সময়ের চারুকলার শিক্ষক মরণ চাঁদ পালের কাছ থেকে তার তৈরি সিরামিকসের সামগ্রী নিয়ে এসে বিক্রি হলে তার দাম দিয়ে আবার নতুন সামগ্রী কিনে আনা হত। এভাবেই চলতে থাকে এই সিরামিকসের আর্ট পিসগুলো, সাথে বিয়ে বাড়ির স্টেজ ও আল্পনার কাজ। ক্রমেই বাড়ে এর চাহিদা। তখনও দোকানে কাপড়ের প্রবেশ ঘটেনি। সেটা আসতে সময় নেয় আরও কিছু দিন। ১৯৯৫ সালে শাড়ি স্থান পায় সিরামিকসের আর্ট পিসগুলোর পাশাপাশি ক্রমবর্ধমান পণ্যের তালিকায়।

ঈদের সময় অত কাপড় কেনা, তাতে কাজ করার মতো প্রয়োজনীয় পুঁজি থাকত না। তখন পরিচিত কাছের মানুষরাই যুগিয়েছেন পুঁজি। তাই দিয়ে ঈদের সময় বিক্রির জন্য কাপড় তোলা হতো। মজার ব্যাপার হলো ক্রমে ক্রমে পণ্যের তালিকায় প্রাথমিক সাফল্য আসে পাঞ্জাবিতে। এতদিন যেটা ছিল আবেগ বা শখ, সেটাই নতুন এক বোধের তৈরি করে আমার মধ্যে। এতদিন যেটা ছিল আবেগ ও শখ সেটাই রূপ নেয় দায়িত্ববোধে। কারণ ততদিনে সরাসরি শত শত মানুষ জড়িয়ে গেছে এই প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে, জড়িত হয়েছে শত শত তাঁতী পরিবার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে। আমার শিল্পবোধ আর রুচির বাস্তবায়নের প্রধান কারিগর এরাই।

উদ্যোক্তা হিসেবে আপাদমস্তক শিল্পসত্ত্বায় পরিপূর্ণ হতে চেয়েছি বারংবার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে ১ম বিভাগে এম এফ এ সম্পন্ন করে শিল্পসত্ত্বাকে দেশ ও জাতির কল্যাণে ব্যবহারের প্রচেষ্টায় আত্মমগ্ন করি অবিরাম। মুক্তবাজার অর্থনীতির এই অস্থির সময়েও নিজস্ব শেকড়ের সন্ধান করতে গিয়েই ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে দেশীয় তাঁতকে প্রাধান্য দিয়েছি সবসময়। এ দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্যের বিশ্বব্যাপী মূল্যায়নে “বিশ্বরঙ” এর পথচলা সুদীর্ঘ ৩০ বছরের।

এ দেশের অন্যতম ফ্যাশন ব্র্যান্ড “বিশ্বরঙ” ১৯৯৪ সাল থেকে ভিন্নধর্মী কাজের জন্যই ফ্যাশন সচেতনদের অকৃত্রিম ভালোবাসায় সিক্ত। বিগত সময়ে বাংলাদেশের ফ্যাশন জগতে ফ্যাশন সচেতনদের জন্য অন্তঃপ্রাণ প্রচেষ্টার ফসল আমাদের নিরীক্ষামূলক কাজগুলো। এ দেশের ইতিহাস ঐতিহ্য- শখের হাড়ি, মুখোশ, নকঁশী পাখা, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাংলার পটচিত্র, বাংলা পঞ্জিকা, ঐতিহ্যে বাংলা সিনেমা, পানাম নগর, কান্তজী মন্দিরের টেরাকোটা, রিকশা মোটিফসহ আল্পনার মতো মহামূল্যবান মোটিফকে পোশাকের অলংকরণ হিসেবে ব্যবহার করে দেশীয় ফ্যাশনকে ইতিহাস ঐতিহ্যের মিশেলে নিয়ে যেতে চেয়েছি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমৃদ্ধির শিখড়ে।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশীয় ফ্যাশনকে ইতিহাস ঐতিহ্যের মিশেলে প্রদর্শন করেছি আমেরিকা, ভারত, মালয়েশিয়া, কানাডার মত ফ্যাশন সচেতনদের দেশে। আমরা উপহার দিয়েছি পোশাকে অতি উজ্জ্বল রঙের অনুভবকে, যা বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিকে আরও রাঙ্গিয়েছে অনুকরণীয়ভাবে। টাঙ্গাইলের মলিন তাঁতের শাড়ীকে আধুনিক ফ্যাশনের অনুষঙ্গ করতে নিরলস প্রচেষ্টার ফলাফল বর্তমানে বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে বিদ্যমান। বিভিন্ন দিবসে পোশাকের বর্ণিলতা আমাদের মাধ্যমেই শুরু হয়, যা আজ অভিন্ন এক রীতিতে সামগ্রিকভাবে প্রচলিত।

শুধু পোশাকে সীমাবদ্ধ না থেকে সামাজিক দ্বায়বদ্ধতা থেকেই ২০১০ সালে জাতীয় যাদুঘরে প্রথম বারের মতো “আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনে রঙের উপস্থিতি” শীর্ষক এক যুগান্তকারী প্রদর্শনীর আয়োজন করি, যা সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বোদ্ধা মহলেও ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করে। সময়ের প্রয়োজনে দেশীয় বুটিক শিল্পকে রক্ষায় রাজপথেও ছিলাম সরব।

শিশুদের মেধাবিকাশের লক্ষ্যে আয়োজন করি “মা” দিবসে “আমার রঙে আমার মা” শীর্ষক এক ব্যতিক্রমধর্মী প্রতিযোগীতা ও প্রদর্শনীর। শিশুদের আঁকা প্রাণবন্ত চিত্রকলাকে ফ্যাশনের উপাত্ত হিসেবে ব্যবহার করে দিয়েছি ভিন্ন মাত্রা। ২০ বছর পূর্তিতে ‘আর টিভি’র সাথে যৌথ আয়োজনে করি ‘টোয়েন্টি- টোয়েন্টি কালার্স’ নামক প্রতিযোগীতা। সারাদেশের টিনএজদের মধ্য থেকে প্রতিভাবানদের বাছাই করে উন্নত প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে এদেশের মিডিয়াকে উপহার দিয়েছি একঝাঁক নতুন মুখ। যাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ আন্তর্জাতিক পর্যায়েও কাজ করছে এখন।

ফ্যাশনের মাধ্যমে চলচ্চিত্রের প্রচারণার যে প্রচলন শুরু হয়েছে তা এ দেশের চলচ্চিত্র এবং ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে আমরাই পথিকৃৎ।


ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মিলনে সমৃদ্ধ আমাদের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি অতীব সম্ভাবনাময় এই শিল্পখাতটি স্বাধীনতা পরবর্তী ৫২ বছরেও অভীষ্ট লক্ষে পৌঁছাতে পারেনি। দূর্ভাগ্য আমাদের, এ দেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি সবসময় উপেক্ষিত থেকেছে। রাষ্ট্রীয় কোনো পৃষ্ঠপোষকতা নেই এই শিল্প খাতে। সবার ধারণা, সব দায় ও দায়িত্ব উদ্যোক্তাদের। অন্যদিকে, মুক্তবাজার অর্থনীতির দোহাই দিয়ে নানা দেশের পণ্য সহজেই আমদানির সুযোগ করে দিয়ে দেশীয় ফ্যাশন উদ্যোক্তাদের ফেলে দেওয়া হচ্ছে কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্যে। অন্যদিকে আমাদের নিজস্বতা, ইতিহাস আর ঐতিহ্যকে নষ্ট করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমাদের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্তদের একাংশ আবার আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে উপেক্ষার মধ্য দিয়েই এই ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলায় প্রয়াসী হয়েছেন। দেশের পটবদলের প্রেক্ষাপটে এই পরিস্থিতি বদলে দেওয়ার প্রত্যয়ে দেশীয় ফ্যাশন শিল্পখাতের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা ও ডিজাইনারদের অংশগ্রহণ ও বিশ্বরঙের কর্ণধার প্রখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার বিপ্লব সাহার নেতৃত্বে গড়ে তোলা হয়েছে বিশ্বরঙ উদ্যোক্তা ভূমি। নকশা থেকে শুরু করে উৎপাদন এবং বিপণনের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রয়োজনীয় সহায়তা ও দিকনির্দেশনা প্রদান, প্রদর্শনী আয়োজনের মাধ্যমে বিপণনে সহায়তা করা এবং সেমিনার, প্রশিক্ষণ ও কর্মশালা আয়োজনের মাধ্যমে নতুন ও পুরনো উদ্যোক্তাদের গুণগত উন্নয়ন সাধনই এই প্ল্যাটফর্মের উদ্দেশ্য।


প্রতি মাসেই ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলায় আয়োজিত হচ্ছে ‘বিশ্বরঙ উদ্যোক্তা ভূমি'র আড্ডা’। এখানে উদ্যোক্তারা পাচ্ছেন সুপরামর্শ। এদের মধ্যে থেকে বাছাই করে ১৬ জনকে নিয়ে গেল সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয় ‘শরৎ হাওয়া’ শিরোনামে দুই দিনের প্রদর্শনী। সেই ধারাবাহিকতায় “বিশ্বরঙ” এর ৩০ বছর উপলক্ষে ঢাকা ও ঢাকার বাইরের প্রায় ১ হাজার ৫০০ উদ্যোক্তা থেকে বাছাই করে ৩০ জনকে নিয়ে ১৮ থেকে ২৪ ডিসেম্বর চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জয়নুল গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হবে ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল খাতের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের পণ্য নিয়ে সপ্তাহব্যাপী প্রদর্শনী ‘শীতের হাওয়া’। এবারের আয়োজন আরও সুপরিসর ও বিস্তৃত।

বিশ্বরঙ এর সৃষ্টিশীলতা সবসময়ই সুস্পষ্ট এবং স্বতন্ত্র। আমরা আমাদের স্থানীয় কারিগর, তাঁতি, সূচিশিল্পী, কারুশিল্পীদের সাথে কাজ করি এবং বিস্ময়করভাবে প্রাণবন্ত সংগ্রহের পরিসীমা অতিক্রম করি ফ্যাশন প্রেমীদের অভিন্ন নিরবিচ্ছন্ন চাহিদাকে। আমাদের নকশাগুলো আমাদের লোক সংস্কৃতির ঐতিহ্য দ্বারা অনুপ্রাণিত; যা ঐতিহাসিকভাবে দক্ষতার উৎস হিসাবে একটি নির্ধারিত ভূমিকা পালন করে আসছে সুদীর্ঘ ৩০ বছর ধরে। সর্বপরি এদেশের সাধারণ মানুষরাই আমাদের সৃষ্টির এক মহান অনুপ্রেরণা। এই সুদীর্ঘ সময়ের পথচলায় “বিশ্বরঙ”- এর পাশে ছিলেন সাংবাদিক বন্ধুরা, বিভিন্ন মিডিয়া কর্মীরা, মিডিয়া তারকারা, অভিনেতা, অভিনেত্রী, মডেল সহ নানা শ্রেণির সাধারণ শুভানুধ্যায়ীরা। তাদের প্রতি অকৃত্রিম অশেষ কৃতজ্ঞতা। ‘বিশ্বরঙ’ পরিবার সবসময় কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করে শুভানুধ্যায়ীদের। শুভেচ্ছা সবসময়ের।

লেখক: বিপ্লব সাহা, কর্ণধার, বিশ্বরঙ 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা