যাপিত জীবন ডেস্ক
প্রকাশ : ২৩ নভেম্বর ২০২২ ১৪:৪৪ পিএম
আপডেট : ২৩ নভেম্বর ২০২২ ১৫:০৬ পিএম
আমাদের শরীরের জন্য অন্যতম প্রয়োজনীয় নিউট্রিয়েন্ট ভিটামিন। ভিটামিন খুব কম মাত্রায় প্রয়োজন। কিন্তু এর অভাবে নানারকম শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। সাধারণত সুষম ডায়েটের মাধ্যমে বেশিরভাগ ভিটামিনের চাহিদাই পূর্ণ হয়। ব্যতিক্রম হলো ভিটামিন ডি।
ভিটামিন ডির প্রধান প্রাকৃতিক উৎস সূর্যের আলো। সূর্যালোকের উপস্থিতিতে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে ত্বকের এপিডার্মিসের নিচের স্তরে কলিক্যালসিফেরলের সংশ্লেষণের মাধ্যমে ভিটামিন ডি তৈরি হয়। এটি চর্বিতে দ্রবণীয় একটি সেকোস্টেরয়েড গ্রুপ; যা ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও ফসফেটের আন্ত্রিক শোষণ ও মানবদেহে বিভিন্ন জৈবিক প্রভাব সৃষ্টির জন্য দায়ী।
ভিটামিন ডি কেন প্রয়োজন
ভিটামিন ডি শরীরের নানা কাজে অংশগ্রহণ করে। এর অন্যতম প্রধান কাজ পেশির স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা বজায় রাখা। এ ছাড়া রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে ভিটামিন ডি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফলে ভিটামিন ডির অভাব হলে অন্যান্য অসুখ সহজেই আক্রমণ করতে পারে।হাড়ের সমস্যার সঙ্গে ভিটামিন ডির গভীর যোগসূত্র রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ভিটামিন ডির অভাবে ভুগলে তা হাড়কে ক্রমে দুর্বল ও ভঙ্গুর করে দেয়। মূলত ক্যালশিয়ামের কার্যকারিতা ভিটামিন ডির ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। ভিটামিন ডি ক্যালশিয়াম অ্যাবজর্বেশনে সাহায্য করে। অর্থাৎ ভিটামিন ডি কমে গেলে শরীর ক্যালশিয়াম গ্রহণ করতে পারে না। অনেকেই হাড়ের সমস্যার জন্য নিয়মিত ক্যালশিয়াম সাপ্লিমেন্ট খান। কিন্তু শরীরে পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি না থাকলে ক্যালশিয়ামের সাপ্লিমেন্ট খেলেও কোনো লাভ হয় না। শুধু তাই নয়, হাড় গঠন, বৃদ্ধি এবং ক্ষয়পূরণের অন্যতম উপাদান ক্যালশিয়াম। ফলে দেখা গেছে, ভিটামিন ডির অভাব ঘটলে তা হাড়ের বিভিন্ন সমস্যা আরও বাড়িয়ে তোলে।
ভিটামিন ডির অভাব কেন হয়
এই ভিটামিনের অভাব হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ভিটামিন ডিসমৃদ্ধ খাবার বলতে সেরকম কিছু নেই। মাছে অল্প পরিমাণে ভিটামিন ডি থাকে। কিন্তু সবজি বা অন্যান্য খাবারে প্রায় থাকে না বললেই চলে। ফলে খাবারের মাধ্যমে পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি শরীরে পৌঁছায় না। এ ছাড়া যারা রোদে বা সূর্যের আলোয় কম থাকেন তাদের মধ্যে ভিটামিন ডির অভাব দেখা যায়। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, আমাদের দেশে রোদের প্রকোপ যথেষ্ট বেশি। তা সত্ত্বেও ভিটামিন ডির অভাবজনিত সমস্যা দেখা দিচ্ছে কেন? আসলে আমাদের ত্বকে ভিটামিন ডির প্রিকারসার (এক বিশেষ ধরনের কেমিক্যাল কম্পাউন্ড) থাকে। রোদের সংস্পর্শে এলে তা সক্রিয় হয়ে ওঠে। এরপর লিভার এবং কিডনিতে আরও বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তা শরীরে শোষিত হয়। এখানে আরও একটি বিষয় রয়েছে। যাদের ত্বকে পিগমেন্টেশন বেশি, অর্থাৎ ত্বকের রং শ্যামলা তাদের ক্ষেত্রে ভিটামিন ডি শোষণের এ প্রক্রিয়াটি অনেক কম কার্যকর। ফলে রোদে দাঁড়িয়ে থাকলেই যে ভিটামিন ডি শরীরে পৌঁছবে তা নয়। নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের দেশগুলোয় যারা ভিটামিন ডির অভাবে ভোগেন দেখা গেছে তাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষই অন্য দেশ থেকে সেই দেশে এসেছেন। অথবা বয়স্ক মানুষ যারা খুব বেশি বাইরে বের হন না। আমাদের দেশের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা এক নয়। এর পেছনে জিনগত কারণ কিছুটা দায়ী হতে পারে।
সমস্যাটা কি নতুন?
ভিটামিন ডির অভাবজনিত সমস্যা কিন্তু নতুন নয়। রোদে কম বেরোনো বা সারাক্ষণ এসিতে থাকার ফলে ভিটামিন ডির অভাব বেশি দেখা দিচ্ছে। ব্যাপারটা কিন্তু এত সরল নয়। সূর্যের আলোর মাধ্যমে ভিটামিন ডির অভাব পূরণ করতে চাইলে দুপুর ১২টার সময় (যে সময় সূর্যরশ্মি সরাসরি আলো দেয়) যতটা সম্ভব ত্বক অনাবৃত রেখে অন্তত আধঘণ্টা কাটাতে হয়। এটা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। তা ছাড়া আজ থেকে ১০ বছর আগে ভিটামিন ডির মাত্রা পরীক্ষা করার এত প্রচলন বা সুযোগ ছিল না। ফলে ঘাটতি থাকলেও তা সামনে আসত কম। তাই বলা যায়, ভিটামিন ডির অভাব আগেও ছিল। কিন্তু এখন সচেতনতা অনেক বেড়েছে। ফলে সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু করা যাচ্ছে।
লক্ষণ
ভিটামিন ডির ঘাটতির প্রধান লক্ষণ তিনটি। পেশির দুর্বলতা, সারাক্ষণ ক্লান্ত লাগা এবং ঘন ঘন মাসল ক্র্যাম্প। এ তিনটি সমস্যা যাদের রয়েছে সাধারণত দেখা গেছে এরা ভিটামিন ডির অভাবজনিত সমস্যায় ভুগছেন। এ ছাড়া ভিটামিন ডির অভাব থেকে হাড়ের ব্যথা হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তবে আর্থ্রাইটিস বা অন্যান্য রোগের জন্য যে হাড়ের ব্যথা হয় তার ধরন ভিটামিন ডির অভাবজনিত হাড়ের ব্যথা থেকে ভিন্ন। এর অভাবে প্রধানত পেশির ব্যথা হয়। অনেক সময় মনে হতে পারে কোনো একটা হাড়ের মধ্যে হয়তো ব্যথা হচ্ছে। এ ধরনের লক্ষণ দেখে বুঝতে হবে তা ভিটামিন ডির অভাবের কারণে হতে পারে। তবে জয়েন্ট পেন বা গাঁটে ব্যথার সঙ্গে কিন্তু ভিটামিন ডির কোনো সম্পর্ক নেই।
চিকিৎসা
ভিটামিন ডির ফুড সোর্স কম, তেমনই পর্যাপ্ত পরিমাণে রোদ লাগানোও সমস্যা। তাই ভিটামিন ডির অভাব পূরণে প্রধান চিকিৎসা সাপ্লিমেন্টস গ্রহণ। আগে ভিটামিন ডি ইনজেকশনের মাধ্যমে এ ঘাটতি পূরণ করা হতো। বর্তমানে ওরাল সাপ্লিমেন্টস হয়েছে। এগুলো যথেষ্ট কার্যকর। তবে ভিটামিন সাপ্লিমেন্টস খাওয়ার নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। অভাব ঠিক কতটা তার ওপর কতদিন ওষুধ খাবেন তা নির্ভর করে। সাধারণ ক্ষেত্রে ৬০ হাজার মাত্রার ওষুধ রোগীকে দেওয়া হয়। প্রথম দিকে সপ্তাহে একবার করে এরপর মাসে একবার করে সাপ্লিমেন্টস খেতে হয়। কতদিন খেতে হবে তা ডাক্তারই ঠিক করে দেন।
সাবধানতা
ভিটামিন ডির অভাবজনিত চিকিৎসায় একটু বেশি মাত্রার সাপ্লিমেন্ট দেওয়া হয়। তাই সঠিক নিয়ম মেনে ওষুধ খাওয়া দরকার। অতিরিক্ত মাত্রায় ভিটামিন ডি শরীরে পৌঁছলে তার থেকে কিন্তু টক্সিসিটি হতে পারে। এ ধরনের টক্সিসিটির সমস্যা দেখা দেয় মূলত দুটি কারণে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় রোগী ওষুধ ঠিক নিয়মে খাননি। সাধারণত ভিটামিন ডির সাপ্লিমেন্ট প্রাথমিকভাবে সপ্তাহে এক দিন করে খেতে বলা হয়। অনেকেই ভাবেন ভিটামিন মানেই তা রোজ খাওয়া যেতে পারে। এর ফলে ওভারডোজ হয়ে যায়। যার থেকে টক্সিসিটি দেখা দেয়। দ্বিতীয়ত, অনেক সময় ডাক্তার রোগীর লক্ষণ দেখে পরীক্ষা না করেই ভিটামিন ডির সাপ্লিমেন্ট প্রেসক্রাইব করেন। ঘাটতি না থাকলেও ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট খেলে তার থেকে টক্সিসিটি হতে পারে। এর থেকে নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। মুড সুইং, ঝিমিয়ে পড়া, আচরণে অস্বাভাবিকতা এ ক্ষেত্রে বেশ কমন। ভিটামিন ডি ক্যালশিয়াম অ্যাবজর্বেশনে সাহায্য করে। তাই এ ভিটামিন বেড়ে গেলে শরীরে ক্যালশিয়ামের পরিমাণও বেড়ে যায়। অতিরিক্ত ক্যালশিয়াম কিডনির কার্যকারিতার ওপর প্রভাব ফেলে। তাই সবসময় ভিটামিন ডির পরীক্ষা করিয়ে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে নিয়ম মেনে ওষুধ খান। তা হলেই সুস্থ থাকবেন।