ছাত্রলীগ নেতা মিরাজ হত্যা
লক্ষ্মীপুর প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২২ মে ২০২৩ ১৫:০০ পিএম
আপডেট : ২২ মে ২০২৩ ১৬:০৫ পিএম
মিরাজ হত্যা মামলার রায় ঘোষণার পর আদালতে উপস্থিত ১১ আসামি খালাস পেয়ে বেরিয়ে আসছেন। প্রবা ফটো
লক্ষ্মীপুর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মিরাজুল ইসলাম মিরাজ হত্যা মামলার ১২ আসামিকেই খালাস দিয়েছেন আদালত। তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ায় তাদের খালাস দেওয়া হয়। এরপর পরিবার প্রশ্ন তুলেছে, তাহলে মিরাজকে হত্যা করল কে?
সোমবার (২২ মে) দুপুরে জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. রহিবুল ইসলাম এ রায় দেন। রায়ের সময় খালাসপ্রাপ্ত ১১ আসামি আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
রায়ের পর মিরাজের পরিবার প্রশ্ন তুলেছে, তাহলে মিরাজকে হত্যা করল কে?
পরিবারের দাবি, মিরাজ হত্যাকাণ্ডটিকে রাজনৈতিক হিসেবে দেখায় কারও বিচার হয়নি। এমন অবস্থায় বিচারব্যবস্থার প্রতি পরিবারের আস্থা ভঙ্গ হয়েছে বলে জানান তারা।
রায়ের পর হতাশ হয়ে পড়েছেন বাদী মিরাজের বাবা আবুল কালাম ও মিরাজের ভাই রিয়াজ হোসেন।
রিয়াজের দাবি, তার ভাইকে রাজনৈতিক কারণেই হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ থেকে কখনও তাদের কোনো ধরনের সহযোগিতা করা হয়নি। আবার রায়ে সবাইকে খালাস দেওয়া হয়েছে। তাহলে ভাইকে হত্যা করল কে?
লক্ষ্মীপুর জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) জসিম উদ্দিন বলেন, ‘হত্যার ঘটনায় সাক্ষীরা আসামিদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করেনি। আদালতে অভিযোগও প্রমাণিত হয়নি। কোনো আসামি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিও দেয়নি। এতে আদালত আসামিদের মামলা থেকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন।’
জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান পাটওয়ারী হত্যা মামলায় আসামিদের খালাসের ঘটনায় রায়পুর আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের দায়ী করেছেন।
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতাদের সহযোগিতা না থাকার কারণে সাক্ষীরা আদালতে সাক্ষী দিতে ভয় পেয়েছে। যার কারণে সত্যিকারের খুনিরাও বেঁচে গেছে। এ রায় হতাশাজনক। মিরাজ হত্যাকাণ্ড ছিল রাজনৈতিক। কিন্তু স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা তাদের পাশে দাঁড়ায়নি।’
বাদীর আইনজীবী মিজানুর রহমান মুন্সি বলেন, ‘আমরা এ রায়ে সন্তুষ্ট নই, উচ্চ আদালতে আমরা আপিল করব।’
লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও খেলাঘরের জেলা সভাপতি প্রফেসর মো. মাইন উদ্দিন পাঠান বলেন, ‘একটি মামলার বিচার কার্যক্রমে কয়েকটি পক্ষ (বাদী, সাক্ষ্য, পুলিশ বা তদন্তকারী ও বিচারক) থাকে। এ পক্ষগুলো যদি সঠিকভাবে কাজ করে তাহলে সঠিক বিচার পাওয়া সম্ভব। মিরাজকে কেউ না কেউ খুন করেছে। কিন্তু আসামিরা খালাস পেয়ে যাওয়ায় হত্যাকারী শনাক্ত হয়নি। এভাবে আসামিরা খালাস পেয়ে যাওয়াতে মানুষের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। খুনি-সন্ত্রাসীরা উৎসাহ পাবে। বিচারব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়বে, মানুষের মাঝে সন্দেহ তৈরি হবে। সঠিক তদন্ত ও সাক্ষ্যপ্রমাণের মাধ্যমে খুনিদের শনাক্ত করে বিচারের আওতায় আনলে ন্যায্যবিচার পাবে ভুক্তভোগীরা।’
খালাসপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন, তানজিল হায়দার রিয়াজ, জাহাঙ্গীর, নুরে হেলাল মামুন, রিয়াজ, মোস্তফা কামাল, হারুন প্রকাশ ডাল হারুন, জহির সর্দার, রফিক উল্যাহ সোহাগ, রাকিব হোসেন প্রকাশ ওরফে ইয়াবা রাজু, মুসলিম, মাসুদ ও সোহেল।
এর মধ্যে তানজিল শুরু থেকেই পলাতক ছিলেন। রায়ের সময়ও আদালতে উপস্থিত হননি।
আদালত ও এজাহার থেকে জানা গেছে, মিরাজ হত্যা মামলায় একাধিকবার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়েছে। সবশেষ ২০১৬ সালের ৫ মে তদন্ত কর্মকর্তা ও লক্ষ্মীপুর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) উপপরিদর্শক মোজাম্মেল হোসেন আদালতে ১২ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন।
অভিযোগপত্র থেকে জানা গেছে, আসামিদের সঙ্গে মিরাজের ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মিরাজের কাছে তাদের (আসামিদের) ব্যবসার ৩ লাখ টাকা ছিল। ওই টাকা বণ্টন নিয়ে তার সঙ্গে মনোমালিন্য হয়। তাকে হত্যার ২-৩ দিন আগে আসামিরা মামলার বাদী মিরাজের বাবা আবুল কালামের মাছের দোকানে গিয়ে হামলা করে।
এ সময় তারা মিরাজকে খোঁজ করে হুমকি দিয়ে চলে যায়। তখন তারা কালামকে স্থানীয় একটি খাবার হোটেলে ডেকে নিয়ে ভয়ভীতি দেখায়। এর তিন দিনের মাথায় ঘটনার দিন ২০১৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর জহিরের বাড়িতে মিরাজকে ডেকে নিয়ে ব্যবসায়িক কথাবার্তা বলে। পরে কৌশলে মাসুদ ও সোহেলকে পরামর্শ দিয়ে তাকে মোটরসাইকেলে ভূঁইয়ারহাটের দিকে নিয়ে যায়। মাসুদ ও সোহেল তার সঙ্গী হয়। পরে মিরাজের অবস্থান নিশ্চিতের জন্য মাসুদ ও সোহেলের সঙ্গে যোগাযোগ করে অন্য আসামিরা।
ভূঁইয়ারহাট থেকে ফেরার পথে বিকালে কেরোয়া ইউনিয়নের ভাঁটের মসজিদের অদূরে নির্জন এলাকায় পৌঁছলে আসামিরা সংঘবদ্ধভাবে মিরাজকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করে। ঘটনাস্থলে প্রচুর রক্তক্ষরণে মিরাজ মারা যান। তার মাথা, কপাল, বুক ও পাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে কোপানোর চিহ্ন ছিল। মিরাজের সঙ্গে থাকা মাসুদ ও সোহেলকেও আঘাত করা হয়।
পরে ডাক্তারি প্রতিবেদনে বলা হয়, মাসুদ ও সোহলের আঘাত সামান্য ছিল। দীর্ঘ শুনানি ও ১৭ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে আদালত আজ মামলার রায় প্রদান করেন।
মামলা থেকে আরও জানা গেছে, হত্যার ঘটনার সময় লক্ষ্মীপুরসহ দেশব্যাপী বিএনপি-জামায়াত সরকারবিরোধী ব্যাপক সহিংস আন্দোলন করেছিল। হত্যাকাণ্ডের পরদিন জামায়াত নেতা হাফেজ ইউছুফ ও শিবির নেতা পরানসহ ১১ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাতপরিচয় আরও ১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়।
পরে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের অব্যাহতি দেওয়ার জন্য বাদী ২০১৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লক্ষ্মীপুর অতিরিক্ত চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আবেদন করেন।
এ সময় তিনি একটি সম্পূরক এজাহার দেন। এতে রায়পুরের চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী রাজু, হারুনসহ ১০ আসামির নাম উল্লেখ করেন। এজাহারে মিরাজের সঙ্গে থাকা মাসুদ ও সোহেলকেও আসামি করা হয়।
এর আগ ২০২১ সালের ২৬ আগস্ট লক্ষ্মীপুরে তাহের হত্যা, ২০২২ সালের ১৭ আগস্ট ছাত্রলীগ নেতা রুবেল হত্যা, ২০২০ সালের ২৮ জানুয়ারি মোরশেদ হত্যা, ২০২২ সালের ২৪ নভেম্বর মিজান হত্যা মামলার রায়ে অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ায় সব আসামিকেই খালাস দেন আদালত।