প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২০:০০ পিএম
আপডেট : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২০:৩০ পিএম
আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন সংশোধনের জন্য ৮টি প্রস্তাব তুলে ধরেছে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগ। এর মধ্যে নতুন ৫টি ধারা-উপধারা সংযোজনের পাশাপাশি আরও ৩টি ধারা সংশোধন করার প্রস্তাব করা হয়। তবে এই সংশোধনের বিষয়ে নানা মত-দ্বিমত পোষণ করেছেন দেশের আইন সংশ্লিষ্ট অংশীজনরা।
আইন মন্ত্রণালয় বলছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধন নিয়ে কথা চলছে। তবে এই সংশোধনীগুলো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে আরও আলোচনা করে আইনটির চূড়ান্ত সংশোধনী আনা হবে।
সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) বিচার প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ সংশোধন বিষয়ক মতবিনিময় সভায় তারা এসব কথা বলেন। মতবিনিময় সভার আয়োজন করে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগ।
মতবিনিময় সভায় ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩’ সময়োপযোগী করার লক্ষ্যে প্রস্তাবিত খসড়া সংশোধনী উপস্থাপন করা হয়। প্রস্তাবিত খসড়া সংশোধনীতে ৪এ, ১৩এ ও ২০এ নামে ৩টি নতুন ধারা এবং ৩(৩) ও ১২(২) নামে ২টি নতুন উপধারা যুক্ত করা হয়। এছাড়া ধারা ৩(২)(এ), ৪(২) ও ১৯ ধারায় সংশোধন আনার প্রস্তাব করা হয়।
সংশোধনের প্রস্তাবগুলো হলো- আইনটির ধারা-৩ ধারায় সংশোধনীর মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধের সংজ্ঞায় একটি ব্যাপক ও সিস্টেমেটিক আক্রমনের অংশ হিসেবে গুম, লিঙ্গভিত্তিক সহিসংতা, যৌন দাসত্ব, জোরপূর্বক যৌনকর্ম, জোরপূর্বক গর্ভধারণ ইত্যাদি অন্তভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবিত সংশোধনীর কারণে জেন্ডার ও কালচারাল গ্রাউন্ডেও যদি কোনো সিভিলিয়ানের ওপর ব্যাপক ও সিস্টেমেটিক আক্রমণ করা হয় তাহলে তা মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে, যা পূর্বের আইনে ছিল না। ৩(৩) ধারায় সংশোধনীর ফলে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ ইত্যাদি অপরাধের দায় বা লায়াবিলিটি নির্ধারণ করতে ট্রাইব্যুনাল রোম স্ট্যাটিউটের ধারা ৯ অনুযায়ী গৃহীত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC) এর Elements of Crime বিবেচনা করার সুযোগ পাবে। ধারা-৪ (২) এ সংশোধনীর ফলে এ আইনের অধীনে অপরাধ হতে পারে এটি জানা সত্ত্বেও যদি কোনো সংস্থা, সংগঠন, দল, সংঘবদ্ধ চক্র বা সত্ত্বার নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তি যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয় তাকেও বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হবে, যা বর্তমান বিধান অনুসারে সম্ভব নয়।
এছাড়াও চতু্র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যের ভিডিও স্ট্রিমিং বা ওডিও-ভিজ্যুয়াল রেকর্ডিংয়ের সুযোগ রাখা হয়েছে। এ সংশোধনীর বুনিয়াদে বিচার কার্যের স্বচ্ছতা নিশ্চিতে ট্রাইব্যুনাল চাইলে শুনানি সরাসরি সম্প্রচার করতে পারবে। পঞ্চম সংশোধনী প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে অভিযুক্ত চাইলে তার পক্ষে বিদেশী আইনজীবী নিয়োগ করতে পারবে। ষষ্ঠ সংশোধনী বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতাকে ত্বরান্বিত করবে। এ সংশোধনীর অধীনে ট্রাইব্যুনালের অনুমতি সাপেক্ষে দেশি-বিদেশী পর্যবেক্ষক আদালতের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে পারবে। সপ্তম সংশোধনীর মাধ্যমে প্রায় সকল রকম ডিজিটাল সাক্ষ্যকে এবং ডিজিটাল পদ্ধতিতে সাক্ষ্যগ্রহণ পক্রিয়াকে অন্তভুক্ত করা হয়েছে। অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে কোনো রাজনৈতিক দল যদি এ আইনের অধীন কোনো অপরাধ করে তাহলে সে দলকে ১০ বছর পর্যন্ত নিষিদ্ধ করার বিধান রাখা হয়েছে।
‘প্রতিশোধ নয়, সুবিচারের জন্য অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করতে চাই’
মতবিনিময় সভায় অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘গত জুলাই হত্যাকাণ্ডে জনগণ নিজ চোখে দেখেছেন একটি বৃদ্ধ প্রজন্ম দেশের একটি তরুণ প্রজন্মকে উন্মত্তভাবে খুনের নেশায় মেতেছিল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধন নিয়ে কথা চলছে। আমাদের বুকের ভিতর যত কষ্ট থাক, যত হতাশা থাক, যত ক্ষোভ থাক- এই খুনের বিচার অবশ্যই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। আমরা প্রতিশোধ বা প্রতিহিংসার বিচার করতে চাই না, আমরা সুবিচার নিশ্চিত করতে চাই।’
আসিফ নজরুল বলেন, ‘অতীতে দেখেছি, এদেশে বিচারের নামে কি ধরনের অবিচার হয়েছে। আমরা বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের কাছে ও আন্তর্জাতিক বিশ্বের কাছে গ্রহণযোগ্য বিচার নিশ্চিত করার চেষ্টা করব।’
তিনি আরও বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমকে সচল করার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে প্রসিকিউশন ও ইনভেস্টিগেশন টিম গঠন করা হয়েছে। এখন আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বোর্ডকে (ট্রাইব্যুনাল) পুনর্গঠন করা। আমরা এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছি। আমাদের সংস্কার কার্যক্রম এখানেই থেমে থাকবে না। যারা এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তাদের সবার মতামত নিয়ে এই আইন সংশোধন করা হবে।’
শিল্প, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়বিষয়ক উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেন, ‘এত রক্তের পর এই বিজয়টি একটি আসার জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। বিজয় কমপ্লিট হয় যখন মানুষ জাস্টিস পায়। এই জাস্টিস নিশ্চিতের জন্য আমরা আরও তিনটি আইন যাচাই করেছিলাম। সমস্ত দিক বিবেচনা করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল আইনেই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বিচার নিশ্চিত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এজন্য আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আইনটির দুর্বল দিকগুলো খুঁজে বের করে সংশোধন করা হবে। আইনটি সংশোধনে সাধারণ মানুষের মতামতের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। আমরা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে চাই।’
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন, সমবায় এবং ভূমি মন্ত্রণালয় বিষয়ক উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ বলেন, ‘সকলের মতামত নিয়ে আমরা একটি শক্তিশালী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল আইন করতে চাই। আজকে যে সিদ্ধান্ত হবে তা কিন্তু চূড়ান্ত নয়। আরও আলোচনা ও কনসাল্টেন্সি করে আইনটি চূড়ান্ত করা হবে।’
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমি চাই সকলের মতামতের ভিত্তিতে এই আইনকে এমনভাবে করা হোক, যার মাধ্যমে ভিকটিম এবং আসামি ন্যায়বিচার পাবে। এই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বিচার করতে গিয়ে কোনো আসামি যাতে ইনজাস্টিসের শিকার না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। জাতীয় প্রত্যাশা একটা জাস্টিস করা, প্রতিশোধ নেওয়া নয়। এই জাস্টিস করার জন্য আমরা সকলে সমর্থন চাই।’
আলোচনা সভায় নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘এই গণআন্দোলন, গণবিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থান যেটা বলি না কেন, তা থেকে কিছু সুস্পষ্ট বার্তা আমরা পেয়েছি। একটা হল, যারা অন্যায় করেছে তাদের বিচার হওয়া এবং সর্বশেষ শাস্তি নিশ্চিত করা অপরটি হলো রাষ্ট্র সংস্কারের বার্তা।’
তিনি আরও বলেন, ‘গত সরকারের আমলে যারা আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। আমাদের নির্বাচনকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিয়েছে। গত তিনটি নির্বাচনে আমরা ভোট দিতে পারিনি। এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে যারা ধ্বংস করে দিয়েছে তাদেরও বিচার হওয়া উচিত।’
সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, ‘এই আইন যত সুন্দর হোক, তার কার্যবিধিটা কি? এটা কি ফৌজদারী কার্যবিধি অনুযায়ী হবে, না ভিন্ন কোনো কার্যবিধি অনুযায়ী হবে? যদি বাংলাদেশের প্রচলিত ফৌজদারী কার্যবিধি অনুযায়ী হয় তাহলে এটাতে আমার প্রশ্ন আছে। আমি বারবার যেটা বলেছি, সিপাহী বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে যে আইনগুলো হয়েছিল, সেই আইনগুলো বাতিল না করে আমাদের এই আইনগুলো করা অবান্তর। যে আইনগুলো গণবিরোধী, সেই আইনগুলো সরিয়ে দেওয়া উচিত।’
আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘এই ট্রাইব্যুনালে বিদেশি বিচারপতি রাখার সুযোগ রাখা উচিত। কারণ, আমরা জানি এই আন্দোলনে কি ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তার বিচার হওয়া উচিত। আন্তর্জাতিক বিচারক বিচার বিশ্লেষণ করে একটি রায় দিবে। সেই রায় সকলের মধ্যে গ্রহণযোগ্য হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রস্তাবিত সংশোধনী আইনে রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়েছে। এটা ঠিক হবে না। কারণ সাম্প্রতিককালে কোনো দেশেই কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। এখন বাংলাদেশে কোনো দলকে নিষিদ্ধ করলে অন্য মতাদর্শের কিছু মানুষ তৃপ্তি পাবে।’
আইনটির প্রস্তাবিত সংশোধনী নিয়ে আলোচনায় আরো অংশ নেন বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, আইন ও বিচার বিভাগের সচিব মো. গোলাম রব্বানী, লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের সচিব (চলতি দায়িত্ব) ড. হাফিজ আহমেদ চৌধুরী, সাবেক জেলা ও দায়রা জজ ইকতেদার আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান ও অধ্যাপক নাজমুজ্জামান ভূঁইয়া, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. বেগম আসমা সিদ্দীকা, রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী, লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের যুগ্ম-সচিব (ড্রাফটিং) মো. রফিকুল হাসান, ঢাকাস্থ জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী অফিসের কর্মকর্তা জাহিদ হোসেন, সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান, আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, সোস্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্ট ড. জাহেদুর রহমান, সাংবাদিক সাঈদ আব্দুল্লাহ, সানজিদা ইসলাম, শরিফ ভূঁইয়া প্রমুখ।