পুলিশি সহিংসতা
সাইফ বাবলু
প্রকাশ : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৭:৪৪ পিএম
আপডেট : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৮:০৫ পিএম
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন ও একেএম শহীদুল হককে বুধবার সকালে সিএমএম আদালতে নেওয়া হয়। প্রবা ফটো
সাবেক আইজিপি একেএম শহীদুল হক, বেনজীর আহমেদ, চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন আমলেই পেশাদারত্ব হারায় বলে মনে করছেন খোদ পুলিশ সদস্যরাই। তাদের মতে, শেখ হাসিনার সরকারের আস্থাভাজন হতে এই উচ্চাভিলাষী কর্মকর্তারা বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের দমন-পীড়ন, মিথ্যা মামলা-হামলা ও গুমের রাজত্ব কায়েম করেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে একটি বলয় গড়ে তুলে বিপুল সম্পদের মালিক বনে গেছেন তারা। ব্যক্তিস্বার্থে পুলিশ বাহিনীর পেশাদারত্ব ধ্বংসের জন্য এসব কর্মকর্তা নানা অপকর্মেও জড়িয়েছেন।
গতকাল হত্যা মামলায় পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন ও একেএম শহীদুল হকের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে মুদি দোকানদার আবু সায়েদ হত্যা মামলায় মামুনকে ৮ দিনের এবং নিউমার্কেটের ব্যবসায়ী আবদুল ওয়াদুদ হত্যা মামলায় শহীদুল হকের ৭ দিনের রিমান্ড দেন আদালত। গতকাল বুধবার সকাল পৌনে ৭টার দিকে তাদের আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। এরপর ৭টা ২০ মিনিটে তাদের আদালতে তোলা হয়। রিমান্ড আবেদনের শুনানি শেষে ঢাকার মহানগর হাকিম আখতারুজ্জামান তাদের এই রিমান্ডের আদেশ দেন।
সাবেক প্রধানমন্ত্রীর আস্থাভাজন হওয়ায় চাকরির বয়সসীমা শেষ হলেও বারবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন এই কর্মকর্তারা। কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলনের সময় তৎকালীন সরকারের আস্থায় থাকতে প্রাণঘাতী গুলির নির্দেশের মাস্টারমাইন্ড ছিলেন সদ্য চাকরিচ্যুত আইজিপি আব্দুল্লাহ আল মামুন। সাবেক এই তিন আইজিপির আমলেই পুলিশের মধ্যে বৈষম্য ও দুর্নীতি চরমে ওঠে। গতকাল এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সাবেক আইজিপি শহীদুল হকের বিরুদ্ধে সাতটি মামলা হয়। যার মধ্যে চারটি মামলা হয় যাত্রাবাড়ীতে। এ ছাড়া বেনজীরের বিরুদ্ধে উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি মামলা হয়। সদ্য চাকরিচ্যুত আইজিপি আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে ৩৬টি মামলা হয়েছে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে।
রিমান্ডে শহীদুল হক
গতকাল আদালতে প্রথমে শহীদুল হকের রিমান্ড শুনানি হয়। রিমান্ডের আবেদনে বলা হয়, নিউমার্কেটের ব্যবসায়ী আবদুল ওয়াদুদ হত্যা মামলায় তার জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। যার রহস্য উদ্ঘাটনে তাকে রিমান্ডে নেওয়া প্রয়োজন। রিমান্ডের আবেদন নাকচ করে শহীদুল হকের জামিন চান তার আইনজীবী মোরশেদ হোসেন শাহীন। শুনানির এক পর্যায়ে এ আইনজীবী আদালতকে বলেন, ‘তিনি ২০১৮ সালে পুলিশের চাকরি থেকে অবসরে যান। এরপর সরকারি আর কোনো লাভজনক পদে থাকেননি। তিনি বাংলাদেশ পুলিশের অভাবনীয় উন্নয়ন সাধন করেন এবং জনগণের ভরসার জায়গায় নিয়ে যান। তাকে সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগে এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।’ তিনি শহীদুল হকের রিমান্ড বাতিল ও জামিন চেয়ে আবেদন করেন।
এসময় আদালতের কাছে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন সাবেক আইজিপি শহীদুল হক। তিনি বলেন, ‘আমি পুলিশকে জনগণের কাছে নিয়ে গিয়েছি। আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের কোনোটাই সত্য নয়।’ আদালত শহীদুল হকের বক্তব্য শুনে তার সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
আব্দুল্লাহ আল মামুনের রিমান্ড
আদালতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে মুদি দোকানি আবু সায়েদ হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) আবদুল্লাহ আল মামুনকে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদনে বলা হয়, ‘শেখ হাসিনা শক্ত হাতে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। মামলার আরেক আসামি ওবায়দুল কাদের গণমাধ্যমে আন্দোলন দমনের নির্দেশ দেন। মামলার ৩ নম্বর আসামি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ অন্যরা ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে অধীনস্থ পুলিশ সদস্যদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। মামলার ৫ নম্বর আসামি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল পুলিশকে ছাত্র-জনতার মিছিলে গুলি করার নির্দেশ দেন। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী ও পুলিশ কর্মকর্তার নির্দেশে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।’
আসামি পক্ষের আইনজীবীরা আদালতকে বলেন, ‘আসামি মামুন চাকরিরত অবস্থায় পদাধিকার বলে সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তিনি সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী পুলিশকে কমান্ড করেছেন। তার ব্যক্তিগত কোনো পদক্ষেপ পুলিশের কাছে ন্যস্ত হয়নি। তাকে যদি মামলা দিতেই হয় সেক্ষেত্রে এসব হত্যা মামলা দেওয়া অনুচিত। তিনি চাকরি জীবনে কোনো অনিয়ম করে থাকলে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা হতে পারে। আন্দোলন চলাকালে গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনায় করা এসব মামলায় তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ নেই। তাকে হয়রানি করতেই এই মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে।’
এসময় আদালতে কোনো কথা বলেননি সদ্য সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। তিনি আদালতের এজলাস কক্ষের কাঠগড়ায় ঠায় দাঁড়িয়ে আইনজীবীদের বক্তব্য শুনতে থাকেন। আদালত শুনানি শেষে এ মামলায় তার আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
গতকাল সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে রিমান্ড আদেশ শেষে ডিবির একটি গাড়িতে সাবেক দুই আইজিপিকে সিএমএম আদালত থেকে নিয়ে যাওয়া হয় ডিবি কার্যালয়ে।
যেভাবে গ্রেপ্তার দুই সাবেক আইজিপি
গত মঙ্গলবার মধ্যরাতে শহীদুল হককে রাজধানীর উত্তরার ১৬ নম্বর সেক্টর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন সেনা হেফাজতে ছিলেন। তার বিরুদ্ধে মামলা হওয়ায় তিনি সেনা হেফাজতে থাকা অবস্থায় আত্মসমর্পণের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। রাতে তাকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়। তারপর তাদের দুজনকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কার্যালয়ে নেওয়া হয়। সারা রাত তারা ডিবি হেফাজতে ছিলেন।
ফাউন্ডেশনের নামে হাতিয়েছেন শতকোটি টাকা
আইজিপি হওয়ার পরপরই বাবা-মায়ের নামে ফাউন্ডেশন খোলেন সাবেক আইজিপি শহীদুল হক। এ ফাউন্ডেশনে নজরানার নামে ঘুষ নেওয়ার প্রথা চালু করেন তিনি। খোদ পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছ থেকেই মজিদ-জরিনা ফাউন্ডেশনের নামে শতকোটি টাকা আদায় করেন শহীদুল হক। শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার নরকলিকাতা গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ। আইজিপি থাকার সময় তিনি মিরপুর শহীদ স্মৃতি পুলিশ কলেজ থেকেও ক্ষমতার অপব্যবহার করে কোটি কোটি টাকা লোপাট করে মজিদ-জরিনা ফাউন্ডেশনে নিয়ে যান। তার ছোট ভাই ইসমাইল হক জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও নড়িয়া উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, আইজিপির দায়িত্বে থাকার সময় শহীদুল হক তার ছোট ভাইয়ের নির্বাচনে প্রচারের জন্য পুলিশ সদস্যদের দায়িত্ব দিয়েছিলেন।
বেনজীর আহমেদ আধুনিক পুলিশ বাহিনী গড়ার প্রত্যয় নিয়ে ঘুষ বাণিজ্যের অর্থে হাতিয়েছেন শতকোটি টাকা, গড়েছেন সম্পদের পাহাড়।
সংক্ষিপ্ত তথ্যপঞ্জি
সাবেক আইজিপি একেএম শহীদুল হক ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর আইজিপি হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত এ পদে ছিলেন। আইজিপি পদে পদোন্নতি পাওয়ার আগে তিনি সচিব পদমর্যাদায় বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (প্রশাসন ও অপারেশন) হিসেবেও কর্মরত ছিলেন।
২০১৮ সালের জানুয়ারিতে অবসরে যাওয়ার পর শহীদুল হক দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে শরীয়তপুর-১ আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন ফরম কিনেছিলেন। তবে মনোনয়ন পাননি।
এদিকে, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর আইজিপি হিসেবে দায়িত্ব পান। চাকরির স্বাভাবিক মেয়াদ অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ১১ জানুয়ারি তার অবসরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ২০২৩ সালের ১২ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ১১ জুলাই পর্যন্ত তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয় সরকার। এরপর ৫ জুলাই শুক্রবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের চুক্তি ও বৈদেশিক শাখা চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ এক বছর বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর তিনি আত্মগোপনে চলে যান। গত ৭ আগস্ট তাকে অবসরে পাঠানো হয়।