মো. ইমরানুর রহমান
প্রকাশ : ০৫ নভেম্বর ২০২২ ১১:৩৩ এএম
আপডেট : ০৫ নভেম্বর ২০২২ ১১:৩৬ এএম
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। ছবি: সংগৃহীত
ইরানে নৈতিকতা পুলিশের হেফাজতে কুর্দি তরুণী মাহসা আমিনির মৃত্যুর ঘটনায় পোশাকের স্বাধীনতার দাবিতে বিক্ষোভ শুরু হয় ইরানে। এরই মধ্যে তা রূপ নিয়েছে সরকার বিরোধী বিক্ষোভে। প্রথম দিকে এই বিক্ষোভকে দাঙ্গা বললেও এখন সুর বদলেছেন দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি।
ইরান ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলমান বিক্ষোভের সপ্তম সপ্তাহে এসে এই বিক্ষোভকে শত্রুদের দ্বারা পরিচালিত হাইব্রিড যুদ্ধ হিসেবে উল্লেখ করেছেন সর্বোচ্চ নেতা।
গত বুধবার ছাত্র দিবস উপলক্ষে দেয়া এক বিবৃতিতে খামেনি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের নিয়ে বলেছেন, তারা আমাদেরই সন্তান। আমার তাদেরকে কিছু বলার নেই।
বরাবরের মতোই ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ করে নিরাপত্তা বাহিনীকে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। তিনি জোর দিয়ে বলছেন, চলমান বিক্ষোভ আমেরিকা, ইউরোপ ও ইসরায়েলের চক্রান্তের ফল।
এরই মধ্যে ইরানি কর্তৃপক্ষ বিক্ষোভ দমনে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে। আটকদের বিচারও শুরু করেছে। ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর বাসিজ মিলিশিয়া বলেছে, নিজ স্ত্রী-সন্তানও ইরানের শাসকের বিরুদ্ধে হলে, তারা তাদেরও মাথা কাটতেও দ্বিধা করবে না।
এতোকিছুর পরেও কার্যত ইরানের শাসক আলি খামেনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন বলে মনে করেন ইরানি বিশ্লেষক মেহদি মাহদি আজাদ।
তিনি ইরান ইন্টারন্যাশন্যালকে বলেন, ‘চার দশকের মধ্যে এই প্রথমবার আলি খামেনি ও তার সরকার বিক্ষোভের ৪৫ দিনে এসেও তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। কারণ তারা শুধু বিক্ষোভই মোকাবিলা করছে না, আমরা যা দেখছি তা একটি সামাজিক বিপ্লব, যা সরকারের পক্ষে মানা সম্ভব নয়। সরকারের জন্য এটি মেনে নেয়া কঠিন যে অধিকাংশ ইরানি বাধ্যতামূলক হিজাবের বিধান মানতে চাইছে না।’
শিক্ষার্থী দিবসে খামেনির আসলে এর বাইরে আর কিছু বলার নেই বলেন মনে করেন মাহদি আজাদ।
তার দাবি, আমরা যতটা কল্পনা করতে পারি, ইসলামি প্রজাতন্ত্রের কাঠামো এর থেকেও দুর্বল হয়ে গেছে।
আজাদের মতে, এরই মধ্যে একাকি হয়ে গেছেন খামেনি। তারই এক সময়ের প্রেসিডেন্ট মধ্যপন্থি রক্ষণশীল হাসান রুহানি ও পপুলিস্ট নেতা মাহমুদ আহমেদানিজাদ তাকে সমর্থন করে একটি কথাও বলেননি। সংস্কারপন্থিরাও তাকে সমর্থন করছে না। একই সময়ে, ইরানিরাও তাকে আর পছন্দ করছে না। দেশের বিভিন্ন অংশে চলা বিক্ষোভের স্লোগান শুনলেই তা স্পষ্ট হবে।
দেশের অনেক রক্ষণশীল নেতাও তার থেকে দূরে থাকছেন। অনেকেই এখন খামেনির সঙ্গে জড়িয়ে নিজেকে বিতর্কিত করতে চাইছেন না।
আরেক ইরানি বিশ্লেষক আলান তোফিঘি বলেন, ‘আপনি যেমনটা দেখতে পাচ্ছেন, বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশী বর্বরতা। এটি পুরোপুরি যুদ্ধের মতো দেখাচ্ছে, যেখানে খামেনি সরাসরি জনগণের মুখোমুখি হচ্ছেন। মাথায় গুলি করে কে নিজের দেশবাসীকে মারতে পারে? যারা এসব দেখবে, তারা খামেনিকে হিটলারের মতো বিশ্বের সবচেয়ে বড় অপরাধীদের পাশে রাখবে।’
এদিকে চলমান বিক্ষোভের মধ্যেই অক্টোবরের শুরুর দিকে দেশটির বিচার বিভাগের প্রধান, কট্টরপন্থি হিসেবে পরিচিত গোলাম-হোসেইন মোহসেনি এজেই বলেছেন, কোনো ভুল করে থাকলে তারা সংশোধনে যেতে প্রস্তুত।
নারীর পোশাকের স্বাধীনতার দাবিতে চলমান আন্দোলন সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে শব্দচয়নের ক্ষেত্রে সে সময় খুবই সতর্ক ছিলেন এজেই।
ইরানের বিচার বিভাগের প্রধান বলেছিলেন, ‘আমি প্রস্তুত। চলুন কথা বলি, আমরা যদি ভুল করে থাকি, সেগুলো সংশোধন করতে পারি।’
বিক্ষোভ বা আন্দোলন বিষয়ে ইরান সরকারের দায়িত্বশীল কারো এমন বক্তব্য নজিরবিহীন।
চলমান ইস্যুতে কথা বলার অনুমতিপ্রাপ্ত ধর্মীয় নেতারা সংস্কারবাদী দৈনিক ইতেমাদকে বলেছেন, কর্মকর্তাদের (সরকারি) বাবার মতো আচরণ করতে হবে এবং তাদের সন্তানদের বুঝতে হবে।
অন্যদিকে সংস্কারপন্থি ব্যক্তিত্ব জালাল জালালিজাদেহ রক্ষণশীল সংবাদমাধ্যম নামহ নিউজকে এক সাক্ষাৎকারে সরকারকে দ্রুত জনগণের সঙ্গে সংলাপ শুরু করার আহ্বান জানিয়েছেন।
যা চাইছেন ইরানিরা
ইতেমাদ পত্রিকা ইরানি সমাজবিজ্ঞানী আসিফ বায়াতকে উদ্ধৃত করে বলেছে, ‘বর্তমান বিক্ষোভে জনগণ তাদের স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেতে চায়, যা ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পরপরই কেড়ে নেয়া হয়েছিল। নৈতিকতা পুলিশ তখন থেকে লাখ লাখ নারীকে রাস্তায় অপমান করে আসছে।'
প্রায় এক দশক আগে হওয়া আরব বসন্তের কথা তুলে ধরে আসিফ বায়াত বলেন, ‘ইরানে সরকার ও সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মধ্যে ব্যবধান তিউনিশিয়া বা মিসরের মতো অন্য যেকোনো জায়গার চেয়ে বেশি।’
তিনি ইরানে চলমান বিক্ষোভকে একটি সর্বব্যাপী আন্দোলন হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যেখানে সামাজিক শ্রেণি ও জাতি নির্বিশেষে সব ইরানি একত্রিত হয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘তিউনিশিয়া ও মিসরের জনগণের মতো ইরানের জনগণও চায় সরকার তাদের মর্যাদার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করুক।’
বায়াতের মতে, ইরানের আন্দোলনের সঙ্গে অন্য আরব দেশের আন্দোলনের মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। আর তা হলো, ইরানে কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের নেতৃত্ব দিচ্ছেন নারীরা।
ইরানি আইনপ্রণেতা আবৌজার নাদিমি বলেন, সমাজের চাহিদা অনুযায়ী সংস্কার (শাসন পদ্ধতি) করা উচিত।
একই সঙ্গে নাদিমি স্বীকারও করেছেন, যে ধরণের সংস্কারের কথা তিনি ভাবছেন, ইরানের বর্তমান সংবিধানের আলোকে এ ধরনের পরিবর্তনের সুযোগ নেই।
এর আগে কুর্দি নারী মাহসা আমিনিকে গত ১৩ সেপ্টেম্বর তেহরানের ‘নৈতিকতা পুলিশ’ গ্রেপ্তার করে। ইরানের দক্ষিণাঞ্চল থেকে তেহরানে ঘুরতে আসা মাহসাকে একটি মেট্রো স্টেশন থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি সঠিকভাবে হিজাব করেননি।
পুলিশ হেফাজতে থাকার সময়েই মাহসা অসুস্থ হয়ে পড়েন, এরপর তিনি কোমায় চলে যান। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ১৬ সেপ্টেম্বর তার মৃত্যু হয়। পুলিশ মাহসাকে হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করলেও পরিবারের অভিযোগ গ্রেপ্তারের পর তাকে পেটানো হয়।