প্রবা প্রতিবেদন
প্রকাশ : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৬:২৪ পিএম
ইমরান খান। ছবি : সংগৃহীত
ভোটমুখী পাকিস্তানে একের পর এক মামলায় দণ্ডিত হচ্ছেন দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিশ্বজয়ী ক্রিকেটার ইমরান খান। সবশেষ পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন ৮ ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করার ঘোষণা দেওয়ার দিন গতকাল শনিবার ইমরান খানকে আরেক মামলায় সাত বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। শরিয়াহ আইন লঙ্ঘন করে বুশরা বিবিকে অবৈধভাবে বিয়ে করার অভিযোগে তার স্ত্রীকেও একই মেয়াদে দণ্ডিত করা হয়েছে। উভয়েই এখন কারাবন্দি। অথচ ফুরফুরে আমেজে নির্বাচনের মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন ইমরান খানের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী নওয়াজ শরিফ ও বিলাওয়াল ভুট্টোরা।
রাওয়ালপিন্ডির আদিয়ালা কারাগারে বিশেষ আদালত ইমরান ও বুশরা দম্পতির বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করেন। কারাদণ্ডাদেশের পাশাপাশি তাদের প্রত্যেককে ৫ লাখ রুপি করে জরিমানা করা হয়েছে। রায় ঘোষণার সময় বিশেষ আদালতে উপস্থিত ছিলেন ইমরান খান ও বুশরা।
বুশরা বিবির সাবেক স্বামী খাওয়ার মানেকা এই মামলা করেন। তার অভিযোগÑ ইমরান ও বুশরা প্রতারণার মাধ্যমে অনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করে তার সংসার তছনছ করেছেন। তার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর শরিয়াহ আইন অনুযায়ী নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ইমরানকে বিয়ে করেন, যা শরিয়াহ আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
আদালতে গতকাল শুনানির সময় খাওয়ার মানেকার সঙ্গে বুশরা বিবি ও ইমরান খান উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ে জড়িয়ে পড়েন। খাওয়ার মানেকা অভিযোগ করেন, তার সংসার ধ্বংস করে ফেলেছেন ইমরান খান।
খাওয়ার মানেকা অভিযোগ করেনÑ ২০১৪ সালে ইমরান খানের ডাকা অবস্থান ধর্মঘটের সময় বুশরার সঙ্গে তার অবৈধ সম্পর্ক শুরু হয়। মানেকা তার বাড়ি ধ্বংস করার জন্য ইমরানকে দায়ী করেন। বিচারক কুদরতুল্লাহর সামনেই এই তর্কে জড়িয়ে পড়েন তারা। একপর্যায়ে তুমুল ঝগড়ায় রূপ নেয় মানেকা, খান ও বুশরার তর্ক। উত্তেজনা সত্ত্বেও খাওয়ার মানেকা তার বক্তব্য রেকর্ড করতে সক্ষম হন। বুশরার আইনজীবী উসমান রিয়াজ গুল খাওয়ার মানেকাকে জেরা করেন, যা পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তোল। এ সময় মানেকাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার চেষ্টা করেন রিয়াজ গুল। তাকে আদালত থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দেন গুল।
আদালতে পবিত্র কুরআন শরিফ শপথ করে সাক্ষ্য দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন ইমরান খান; খাওয়ার মানেকাকেও একই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। খাওয়ার যে অভিযোগ করেছেন, তা অস্বীকার করে ইমরান খান বলেন, বিয়ের দিনই বুশরা বিবিকে প্রথম দেখেন তিনি। তবে খাওয়ারও তা প্রত্যাখ্যান করেন। তবে তিনি কুরআন স্পর্শ করে শপথ নিতে আগ্রহ দেখাননি। এ সময় আদালত বলেন, পবিত্র কুরআন স্পর্শ করার পর জেরা করার আর কিছু থাকে না। তাই বিচারক তাতে সম্মতি দেননি।
এজলাসে নাটকীয়তার পর খাওয়ার মানেকা সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, ইমরান-বুশরার সম্পর্ক তার পরিবারের ওপর প্রভাব ফেলেছে। বুশরার বিশ্বাসঘাতকতার কারণে তার একটি মেয়ে বিবাহবিচ্ছেদের মুখোমুখি হয়েছিল; তার একটি ছেলে বিষণ্নতায় ভুগছিল এবং তাকে পুনর্বাসন করতে হয়েছিল।
খাওয়ার মানেকা আরও অভিযোগ করেন, বুশরার বোন মরিয়মের মাধ্যমে ইমরান খান তাদের জীবনে প্রবেশ করেন। কান্নায় ভেঙে পড়ে তিনি জানান, এ নিয়ে বছরের পর বছর নীরব ছিলেন, কিন্তু এখন তিনি তার সন্তানদের জন্য কথা বলতে চান।
শরিয়াহ মোতাবেক পোশাক পরিধান করেন বুশরা বিবি। এতদিন মামলার বিষয়গুলো নিয়ে তিনি কোনো কথা বলেননি, মিডিয়াকে পাশ কাটিয়ে গেছেন। তবে গতকাল আদিয়ালা কারাগারে প্রথমবারের মতো সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন বুশরা বিবি। তিনি দাবি করেন, তাকে অপমান করার যে চক্রান্ত, তার-ই শিকার হয়েছেন তিনি। তার বাড়িটি একটি কারাগারে পরিণত করা হয়েছে। তবে তিনি চাপের কাছে নতি স্বীকার করবেন না। এসব মামলাকে তিনি ইমরান খান ও তার দল পিটিআইকে দুর্বল করার অপচেষ্টা হিসেবে মনে করেন।
বুশরা বিবি আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবেও পরিচিত। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার বিষয়ে তিনি জোর দিয়ে বলেন, ধার্মিকতা চেহারা দিয়ে পরিমাপ করা হয় না। পথে যতই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া হোক, তিনি তা মোকাবিলা করবেন।
‘সম্মানহানির জন্য সাজা দেওয়া হলেও কারও সঙ্গে আঁতাত করব না’
সাজা ঘোষণার পর ইমরান খানও সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি এসব মামলা ও সাজাকে তার সম্মানহানি করা ও তাকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার অপচেষ্টা হিসেবে বর্ণনা করেন। এ সময় জোর দিয়ে বলেন, ক্ষমতার সঙ্গে কোনো আঁতাত করব না। তিনি বলেন, তোশাখানা মামলায় তাকে যে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, তা রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যবহারের দায়ে অভিযুক্ত অন্য কোনো রাজনীতিবিদকে দেওয়া হয়নি। আর বেআইনিভাবে বিয়ে করার মামলাটি তাকে উপহাস ও অপমান করার জন্য করা হয়েছিল।
পিটিআই প্রতিষ্ঠাতা ইমরান খান বলেন, তার বিরুদ্ধে প্রায় ২০০টি মামলা করা হয়েছে; দেশের ইতিহাসে এতগুলো মামলা কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে হয়নি। তিনি বলেন, ‘আমি এখনও বলছি, ক্ষমতার সঙ্গে আঁতাত করিনি এবং করবও না। আঁতাত করার চেয়ে আমি মরে যাব, সেই ভালো।
পিএমএল-এনের প্রধান নওয়াজ শরিফ এবং তার ভাই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের কথা টেনে ইমরান খান বলেন, বড় শরিফ (নওয়াজ) সুপ্রিম কোর্টের রায়ে নির্বাচন ও রাষ্ট্রীয় পদে অযোগ্য ঘোষিত হয়েছিলেন অথচ তার সব মামলা খারিজ করে দেওয়া হয়েছে। একইভাবে শাহবাজের বিরুদ্ধেও গুরুতর অভিযোগে মামলা ছিল, সেটিও খারিজ হয়ে গেছে।
ইমরান খান আরও বলেন, দেশে বিদেশি শক্তি ৪০০টি ড্রোন হামলা চালিয়েছে কিন্তু কেউ কথা বলেনি। সেই দাস (নওয়াজ শরিফ) বিদেশ থেকে ফিরে এসে তাদের ছুড়ে ফেলার চেষ্টা করছেন।
ইমরানের বিরুদ্ধে আরও যত দণ্ড
গত ৩১ জানুয়ারি রাষ্ট্রীয় উপহারসামগ্রী কম মূল্যে কিনে নেওয়ার অভিযোগে করা (তোশাখানা) মামলায় ইমরান ও বুশরাকে ১৪ বছর করে কারাদণ্ড দেন বিশেষ একটি আদালত। তার এক দিন আগে ৩০ জানুয়ারি রাষ্ট্রীয় গোপন নথি ফাঁসের মামলায় ইমরান খানের ১০ বছরের জেল হয়। একই মামলায় ইমরান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কুরেশিকেও ১০ বছরের জেল দেন আদালত। এরও আগে গত বছরের ৫ আগস্ট তোশাখানা দুর্নীতি নিয়ে পৃথক একটি মামলায় ইমরান খানকে ৩ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।