মধ্যপ্রাচ্য সংঘাত
প্রবা প্রতিবেদন
প্রকাশ : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৬:১৬ পিএম
আপডেট : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৬:১৯ পিএম
ইরাকের আল-কাইম শহরে যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় বিধ্বস্ত একটি গাড়ি। ছবি: রয়টার্স
ইরাক ও সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রাণঘাতী বোমা হামলা এবং উভয় দেশে মার্কিন স্থাপনায় ইরানপন্থি প্রতিরোধ গোষ্ঠীর পাল্টা হামলায় চরম সামরিক উত্তেজনা বিরাজ করছে মধ্যপ্রাচ্যে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ‘সন্ত্রাসীদের’ বিরুদ্ধে হামলা শুরু হয়েছে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। বিপরীতে ইরানও প্রয়োজনীয় জবাব দিতে প্রস্তুত বলে হুংকার দিয়েছে। নতুন করে সৃষ্ট এই যুদ্ধের ডামাডোলে ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের জাতিগত নির্মূল অভিযান আরও বীভৎস হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
জর্ডানে তিন সেনা নিহতের প্রতিশোধ নিতে ইরাক ও সিরিয়ায় ইরানের এবং ইরানপন্থি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকা সাতটি এলাকায় গত শুক্রবার রাতে বোমা হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। হাজারো কিলোমিটার দূরে যুক্তরাষ্ট্রের মাটি থেকে বোমারু বিমান উড়িয়ে এনে এবং ১২৫টি যুদ্ধ সরঞ্জাম ব্যবহার করে এই হামলা চালানো হয়েছে। এতে ইরাকে বেসামরিক নাগরিকসহ ১৬ জন নিহত ও ২৬ জন আহত হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পরপরই ইরাক ও সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক স্থাপনায় পাল্টা হামলা চালিয়েছে ইরানপন্থি ইসলামী প্রতিরোধ গোষ্ঠীর সদস্যরা। এসব হামলায় মার্কিন সেনা বা বেসামরিক মানুষ নিহতের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে পাল্টাপাল্টি এসব হামলায় গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত ইরাক-সিরিয়ায় জনজীবন আরও অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে সবকিছু আবার তছনতছ হয়ে যাওয়ার আতঙ্কে ভুগছে দেশ দুটির জনগণ।
ফিলিস্তিনে গণহত্যা অভিযানে ইসরায়েলকে যুক্তরাষ্ট্র সর্বাত্মক মদদ দেওয়ার প্রতিবাদে সিরিয়া সীমান্তে জর্ডানে মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালায় ইরাকভিত্তিক সশস্ত্র গোষ্ঠী ইসলামিক রেসিসট্যান্স মুভমেন্ট। এই গোষ্ঠী ইরানের সমর্থন পায় এবং শিয়াপন্থি। যে কারণে হামলার জন্য সরাসরি ইরানকে দায়ী করেছে ওয়াশিংটন। তবে তেহরান তা প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, ইসলামিক রেসিসট্যান্সকে হামলার নির্দেশ দেওয়া হয়নি, এই অভিযোগ ভিত্তিহীন। তা মানতে নারাজ যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল কমান্ড বলছে, তারা ইরানের ইসলামিক বিপ্লবী গার্ড কুদস ফোর্স এবং সহযোগী অন্যান্য সশস্ত্র বাহিনীর ওপর হামলা করেছে। গত শুক্রবার এক বিবৃতিতে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, ‘আমাদের পাল্টা জবাব আজ শুরু হলো। নির্ধারিত জায়গা ও সময় অনুযায়ী এটি চলতে থাকবে।’ তবে জো বাইডেনের এই পাল্টা হামলায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে। ডেমোক্র্যাটরা এটি সমর্থন করলেও কড়া সমালোচনা করছেন বেশিরভাগ রিপাবলিকান আইনপ্রণেতা।
ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এই অঞ্চলে মার্কিন সেনারা ইরানসমর্থিত গোষ্ঠীর হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। কিন্তু গত সপ্তাহে প্রথমবার তাদের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।
রয়টার্স জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার বিশ্বাসÑ যে ড্রোন দিয়ে হামলা চালানো হয়, তা ইরানের তৈরি। অভিযোগ আছেÑ ইরাক ও সিরিয়ায় ইরানসমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর অসংখ্য ঘাঁটি, অস্ত্র কোষাগার ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে, যেসব জায়গা থেকে গত ৭ অক্টোবরের পর হতে এই অঞ্চলে থাকা মার্কিন ঘাঁটিগুলোর ওপর ১৭০টিরও বেশি হামলার ঘটনা ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলগুলোকেই এখন লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে।
স্থানীয় সময় গত শুক্রবার দুপুরের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি থেকে দূরপাল্লার বোমারু বিমান উড়ে যেতে দেখা যায়। এর আগে পর্যন্ত ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশের পক্ষ থেকেই বলা হয়ে আসছিল, তারা কেউ-ই যুদ্ধে জড়াতে চায় না। তবে রবিবারের হামলার পর থেকে ধারণা করা হচ্ছিল, যেকোনো সময় যুক্তরাষ্ট্র পাল্টা হামলায় যেতে পারে। প্রেসিডেন্ট বাইডেন সম্ভাব্য হামলার পরিকল্পনাও প্রকাশ করেন। তবে সরাসরি ইরানের মাটিতে বা লোহিত সাগরে থাকা ইরানের কোনো যুদ্ধজাহাজে হামলা করেনি যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন সিরিয়া ও ইরাক মিলিয়ে ৮৫টি লক্ষ্যবস্তুতে হামলার কথা নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, ‘মার্কিন বাহিনীর ওপর হামলা আমি সহ্য করব না। যুক্তরাষ্ট্র, আমাদের বাহিনী ও আমাদের স্বার্থরক্ষায় যা যা করতে হয় সবই করবে।’
মোট সাতটি অঞ্চলে এই হামলাগুলো হয়েছে, যার চারটি সিরিয়ায় ও তিনটি ইরাকে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় কাউন্সিলের মুখপাত্র জন কিরবি জানিয়েছেন, ‘এটা কেবল তাদের পাল্টা হামলার প্রথম পর্ব।’ তিনি আরও জানান গত ২৮ জানুয়ারির পর থেকে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কোনো ধরনের যোগাযোগ হয়নি।
কিছুদিন ধরেই এই পাল্টা হামলা হতে পারে বলে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তারবার্তা পাঠানো হচ্ছিল। যাতে করে আসলে ইরান ও তার সহযোগীদের বড় ধরনের হতাহতের ঘটনা এড়ানোর সুযোগ দিয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনে এর তীব্র সমালোচনা শুরু হয়েছে। কংগ্রেসম্যান বায়রন ড্যানিয়েলস অনলাইনে লিখেছেন, ‘এই হামলা সেদিনই হওয়া উচিত ছিল, যেদিন আমাদের কর্মী মারা যায়।’
অনেক সামরিক বিশেষজ্ঞেরও মতো যুক্তরাষ্ট্র পাল্টা হামলা করতে অনেক দেরি করে ফেলেছে। যদিও পেন্টাগন বলছে আবহাওয়ার জন্য তাদের দেরি করতে হয়েছে। বিবিসিকে অ্যারাবিয়ান গালফ স্টেটস ইনস্টিটিউট অব ওয়াশিংটনের ফেলো হুসেইন ইবিশ বলেন, ‘তবে এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র আসলে ইঙ্গিত দিচ্ছে যে তারা ইরানে কোনো হামলা করবে না।’
বিবিসির কূটনৈতিক সংবাদদাতা পল অ্যাডামস বলছেন, হোয়াইট হাউস এই হামলায় একটা বার্তা দিতে চেয়েছেÑ ইরান ও তার সহযোগীদের সতর্কবার্তা দিয়ে বলছে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সামরিক ব্যক্তি মারা গেলে ছেড়ে দেওয়া হবে না।
ইরান আগেই জানিয়েছিল তাদের ওপর বা তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট যেকোনো কিছুর ওপর হামলা হলে তার কড়া জবাব দেওয়া হবে। এখন সামনের দিনগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইডেন ইরানের মাটিতে হামলা না করে ইরানের ব্যক্তি বা মিত্রদের ওপর হামলা বাড়াতে চান কি না, এবং তা সংঘাত আরও বাড়িয়ে দেবে কি না; সেটাই দেখার বিষয়।
চলতি সপ্তাহে মধ্যপ্রাচ্য ভ্রমণের কথা আছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের। ৪ থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি তিনি সৌদি আরব, মিসর, কাতার, ইসরায়েল ও পশ্চিততীর সফর করবেন। গত ৭ অক্টোবরের পর এই অঞ্চলে এটি তার পঞ্চম সফর।
সূত্র : বিবিসি ও আলজাজিরা