প্রবা প্রতিবেদন
প্রকাশ : ৩০ জানুয়ারি ২০২৪ ১৭:৩৩ পিএম
আপডেট : ৩০ জানুয়ারি ২০২৪ ১৮:২৪ পিএম
গাজার সর্বত্র এ ধরনের নতুন কবরস্থান চোখে পড়ছে। ছবি : সংগৃহীত
জর্ডানে নিজেদের তিন সেনা নিহতের প্রতিশোধ নিতে যাবতীয় পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এমন এক সময়ে জর্ডানের ঘটনাটা ঘটল যখন গাজায় যুদ্ধ বন্ধ করতে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল, মিসর ও কাতারের বহুপক্ষীয় আলোচনা একটা বিশেষ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
এ পরিস্থিতিতে জর্ডান হামলার প্রতিশোধ নিতে যুক্তরাষ্ট্র ইরাক ও সিরিয়ায় বড় ধরনের হামলা শুরু করলে তা চলমান শান্তি আলোচনাকে ব্যাহত করতে পারে। কিন্তু প্রতিশোধ নেওয়া ছাড়া ওয়াশিংটনের সামনে বিকল্প কোনো পথও খোলা নেই।
সোমবার (২৯ জানুয়ারি) যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের ওপর হামলা প্রেসিডেন্ট ও আমি কোনোভাবে সহ্য করব না। যুক্তরাষ্ট্র ও তার সেনাদের রক্ষার্থে আমরা প্রয়োজনীয় সবকিছু গ্রহণ করব।
আগের দিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও প্রায় এক ধরনের কথা বলেছেন। সুবিধামতো সময়ে অভিযুক্তদের ওপর হামলা চালানোর কথা বলেছিলেন তিনি।
সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের মুখপাত্র জন কিরবি বলেন, আমরা ইরানের সঙ্গে বা মধ্যপ্রাচ্যে বড় ধরনের কোনো সংঘাত চাই না। কিন্তু যা করার আমরা তা করবই।
হামলার জন্য ইরানকে দায়ী করছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। কিন্তু ইরান তা অস্বীকার করেছে।
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নাসের কানানি যুক্তরাষ্ট্রের দাবি ভিত্তিহীন বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, ইরাকের ইসলামিক রেজিস্ট্যান্সকে হামলার জন্য কোনো অর্ডার দেয়নি তেহরান।
রবিবারের হামলার দায় স্বীকার করে দেওয়া এক বিবৃতিতে ইরাকের ইসলামিক রেজিস্ট্যান্স জানায়, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে সহায়তা দেওয়া বন্ধ না করা পর্যন্ত হামলা চলবে। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থসংশ্লিষ্ট যেকোনো কিছুতে হামলা হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশোধের কোনো হুমকিই আমাদের দমাতে পারবে না।
প্যারিস বৈঠক
গাজায় যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য রবিবার প্যারিসে উচ্চপর্যায়ের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে যুক্তরাষ্ট্র, মিসর, ইসরায়েল ও কাতারের গোয়েন্দাপ্রধানরা অংশ নেন। গোয়েন্দাপ্রধানদের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ও কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আব্দুল রহমান বিন জসিম আল থানিও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
কাতারের প্রধানন্ত্রী বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এ মুহূর্তে প্রতিশোধমূলক হামলা চালালে তা আঞ্চলিক নিরাপত্তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। তবে আমরা আশা করব তা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকবে। তবে যুদ্ধবিরতি আলোচনা সঠিক পথে এগোচ্ছে বলেও জানান তিনি।
আলোচনা শেষে ন্যাটোর পরিচালক জেনস স্টলটেনবার্গসহ এক সংবাদ সম্মেলনে ব্লিঙ্কেন বলেন, আমরা যুদ্ধবিরতির একটি শক্তিশালী রূপকল্প তৈরি করেছি। আশা করি এটা বাস্তবায়িত হবে। এখন বাকিটা হামাসের ওপর নির্ভর করছে।
নতুন যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব
বিভিন্ন সূত্র বলছে, প্যারিসে হামাসকে ছয় মাসের একটি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেওয়ার জন্য পক্ষগুলো সম্মত হয়েছে বলে জানা গেছে। বিনিময়ে হামাসের হাতে থাকা জিম্মিদের আরও একটা অংশকে মুক্তি দেবে হামাস। হামাসের হাতে এখনও প্রায় ১৪০ জন ইসরায়েলি জিম্মি রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
হামাস চায় যুদ্ধবন্ধ
হামাসের হাতে প্যারিস প্রস্তাব পৌঁছেছে। মঙ্গলবার হামাসের রাজনৈতিক শাখার প্রধান ইসমাইল হানিয়া বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, আমরা প্রস্তাবটি ভালোভাবে খতিয়ে দেখছি। তবে গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনাদের সম্পূর্ণ প্রত্যাহার ছাড়া কোনা যুদ্ধবিরতি হবে না।
আগের দিন সোমবার লেবাননের বৈরুতে হামাসের মুখপাত্র ওসামা হামদান বলেন, আমরা এখনও কোনো প্রস্তাব পাইনি। তবে আমরা যুদ্ধ সম্পূর্ণ বন্ধ চাই। কোনো জিম্মি হস্তান্তরের আগে গাজা থেকে ইসরায়েলের সব সেনা প্রত্যাহার করতে হবে।
ওয়াশিংটনে কাতারি প্রধানমন্ত্রী
যুদ্ধবিরতি নিয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা করতে প্যারিস থেকে ওয়াশিংটনে গেছেন কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আব্দুল রহমান বিন জসিম আল থানি। তিনি সেখানে ব্লিঙ্কেনসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন।
মিসরে ইসরায়েলি নিরাপত্তাপ্রধান
ইসরায়েলের নিরাপত্তা সংস্থারপ্রধান রনেন বার সোমবার মিসরের কায়রো সফর করেছেন। তিনি মিসরের গোয়েন্দাপ্রধান আব্বাস কামেলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তারা আগের দিন রবিবার প্যারিস বৈঠকেও ছিলেন। কিন্তু সোমবারের বৈঠকে তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন।
বিভিন্ন প্রতিবেদন বলছে, এ দিন তারা গাজার মিসর সীমান্তের ফিলাডেলফি করিডোর বা জোন নিয়ে আলোচনা করেছেন। ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ জোনটিত অভিযান চালাতে চায় ইসরায়েল। পরবর্তীতে সেটা তারা আবার দখলেও নিতে চায়।
জোনটি ১৯৬৫ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এখন তারা এটির ফের দখল নিতে চায়। কিন্তু এতে হামাস, ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের বড় ধরনের আপত্তি থাকবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ এতে করে গাজার সব দিকে ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে।
হাসপাতালে অভিযান
ইসরায়েল পশ্চিম তীরের ইবনে সিনা হাসপাতালে মঙ্গলবার ভোরে অভিযান চালিয়ে তিনজনকে হত্যা করেছে। এটা নিয়ে সারা বিশ্বে সমালোচনা হচ্ছে।
তহবিল নিয়ে ক্ষোভ
ইসরায়েলের অভিযোগ, জাতিসংঘের ত্রাণ বিভাগের প্রায় ১৯০ জন কর্মী হামাসকে ৭ অক্টোবরের হামলায় সহায়তা করেছে। এ অভিযোগের ভিত্তিতে গাজায় ত্রাণ সহায়তা বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র কয়েকটি দেশ।
জাতিসংঘের মহাসবিচ আন্তোনিও গুতেরেস তহবিল বন্ধের সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক বলে মন্তব্য করেছেন। এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিষ্ঠুর বলেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তিনি। অন্যদিকে ইসরায়েলের অভিযোগ খতিয়ে দেখারও নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
তথ্যমতে, ইসরায়েলের হামলায় গাজায় জাতিসংঘের ত্রাণ বিভাগের অন্তত ১৬০ কর্মী নিহত হয়েছে।
উত্তপ্ত রণাঙ্গন
যুদ্ধবিরতি বা বন্ধের জন্য যখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুমুল আলোচনা চলছে, ঠিক তখন রণাঙ্গনে নতুন উদ্যমে হামলা ও পাল্টা হামলা চলছে। গাজা সিটির পশ্চিম অঞ্চল থেকে সব মানুষকে অন্যত্র সরিয়ে যেতে নির্দেশ দিয়েছে ইসরায়েল। দক্ষিণের খান ইউনিসে তুমুল যুদ্ধ হচ্ছে।
সোমাবার হামাস উত্তর গাজায় ঢুকে হামলা চালিয়েছে। অথচ গাজার এ অংশটা সম্পূর্ণ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে বলে দাবি করেছিল ইসরায়েল।
একই দিন গাজা থেকে ইসরায়েলে ফের রকেট হামলা চালানা হয়েছে। এসব প্রমাণ করে যুদ্ধ ইসরায়েলের পরিকল্পনা অনুযায়ী চলছে না।
সোমবার পর্যন্ত গাজায় ২৬ হাজার ৭৫১ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ৬৫ হাজার ৩৮৭ জন। গাজায় ৯০ শতাংশ মানুষ স্থানচ্যুত হয়েছে। ৮০ শতাংশ বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে।
৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় হামাস। এতে প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত হয়। আহত হয় ৫ হাজার। হামাস ধরে নিয়ে আসে প্রায় ২৪০ জন। নভেম্বরের শেষের দিকে তিন দফায় সাত দিনের চুক্তিতে কিছু বন্দিকে মুক্তি দিয়েছে হামাস।
সূত্র : রয়টার্স, গার্ডিয়ান, আনাদোলু, আলজাজিরা