প্রবা প্রতিবেদন
প্রকাশ : ১৮ জানুয়ারি ২০২৪ ০১:০৮ এএম
ছবি : সংগৃহীত
দুই দিনে তিন দেশে ইরানের আকস্মিক হামলা ঘিরে নতুন করে সামরিক উত্তেজনা তৈরি হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে। সোমবার ইরাক, সিরিয়া এবং মঙ্গলবার গভীর রাতে পাকিস্তানে হামলা চালায় দেশটি। তেহরানের দাবি, ইরাক ও সিরিয়ায় ইসরায়েলের দুর্ষর্ধ গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের কার্যালয়ে এবং কুর্দিদের ঘাঁটিতে হামলা করে ‘শত্রু স্থাপনা’ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ওই দুই হামলায় চারজন নিহত হন বলে সংশ্লিষ্ট দেশ দুটি জানায়। আর পাকিস্তানে আস্তানা গাড়া নিষিদ্ধ জঙ্গিগোষ্ঠী ইরানবিরোধী তৎপরতায় সক্রিয় ‘জইশ আল-আদল’কে লক্ষ করে হামলা চালানো হয়েছে। এ ঘটনায় দুই শিশু নিহত হয়েছে। এ ঘটনায় পাকিস্তান ও ইরানের কূটনৈতিক সম্পর্ক তলানিতে টেকেছে। এভাবে সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করে বিনা উস্কানিতে হামলা চালানোর কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ইসলামাবাদ। তারা তেহরানকে সাফ জানিয়ে দিয়েছেÑ এমন কর্মকাণ্ডের জন্য তেহরানকে গুরুতর পরিণতি ভোগ করতে হতে পারে।
বুধবার (১৭ জানুয়ারি) সকালে পাকিস্তান জানিয়েছে, মঙ্গলবার রাতে পাকিস্তানের ভূখণ্ডে ‘বিধিবহির্ভূতভাবে’ বিমান হামলা চালিয়েছে ইরান। এতে দুই শিশু নিহত ও তিনজন আহত হয়েছে।
এর পরপরই পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মুমতাজ জারা বেলুচ প্রেসি ব্রিফিংয়ে জানান, ইরান থেকে তাদের রাষ্ট্রদূতে ডেকে পাঠানো হয়েছে। একই সঙ্গে পাকিস্তানে নিযুক্ত ইরানের রাষ্ট্রদূত, যিনি বর্তমানে তেহরানে আছেন, অনির্দিষ্টকালের জন্য তিনিও ইসলামাবাদে ফিরতে পারবে না। এ ছাড়া দুই দেশের মধ্যে নির্ধারিত সব রাষ্ট্রীয় সফর বাতিল করা হয়েছে। তবে ইরানি রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করা হয়েছে কিনা, তা স্পষ্ট করেননি মুমতাজ জারা।
এখন প্রশ্ন উঠেছেÑ হঠাৎ পাকিস্তানের ভূখণ্ডে কেন হামলা চালাল ইরান? মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি আগে থেকেই উত্তপ্ত। এর মধ্যে কী এমন ঘটল যে, তেহরান প্রতিবেশী দেশের ওপর হামলা চালিয়ে বসল?
২০১২ সালে জইশ আল-আদল প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ইরানে কালো তালিকাভুক্ত একটি ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠন। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ইরানের মাটিতে বেশ কয়েকটি হামলার পেছনে জইশ আল-আদলকে দায়ী করা হয়।
কয়েক দিন ধরে ইরাক ও সিরিয়ার ভূখণ্ডে হামলা চালাচ্ছে ইরান। তেহরানের দাবি, ‘ইরানবিরোধী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর’ বিরুদ্ধে এসব হামলা চালানো হচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, ইরাক ও সিরিয়ার পর একই কারণে পাকিস্তানের ভূখণ্ডে ইরান এই হামলা চালাল।
যদিও ‘বিনা উস্কানিতে আকাশসীমা লঙ্ঘনের’ ঘটনায় ক্ষোভ জানাতে ইসলামাবাদে নিযুক্ত ইরানের শীর্ষ কূটনীতিককে তলব করেছে পাকিস্তান সরকার। এমন হামলাকে ‘সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য’ বলে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে।
হামলার পর থেকে বিষয়টি নিয়ে ইরান সরকার পুরোপুরি নিশ্চুপ। তবে ইরানের রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যম নূর জানিয়েছে, পাকিস্তানের ভূখণ্ডে হামলা চালিয়ে জঙ্গিগোষ্ঠী জইশ আল-আদলের সদর দপ্তর ধ্বংস করা হয়েছে।
সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, সম্প্রতি ‘সন্ত্রাসীদের’ স্থাপনা ও তাদের ‘গোয়েন্দা সদর দপ্তরে’ হামলা চালাচ্ছে ইরান। এ জন্য সিরিয়া ও ইরাকের কুর্দিস্তানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানের ভূখণ্ডে হামলা চালানো হয়েছে।
ইরানের এসব হামলা আগে থেকে উত্তপ্ত মধ্যপ্রাচ্যকে নানা সংকটের মুখোমুখি দাঁড় করাতে পারে। তিন মাসের বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনের গাজায় নির্বিচার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। অসহায় ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতিশীল ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা লোহিত সাগরে পশ্চিমা বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা চালাচ্ছে। এর জেরে ইয়েমেনে পাল্টা হামলা চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য।
এখন নিজেদের ভূখণ্ডে ইরানের হামলার পর পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে বিবৃতি দিয়েছে তাতে কোথায় হামলা হয়েছে সে সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। তবে পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম বলছে, হামলা হয়েছে ইরানের সীমান্তবর্তী বেলুচিস্তান প্রদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পাঞ্জগুরের পাশে। বেলুচিস্তান প্রদেশের সঙ্গে ইরানের প্রায় এক হাজার কিলোমিটারের সীমান্ত রয়েছে।
হামলার কয়েক ঘণ্টা আগে পাকিস্তানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী আনোয়ারুল হক কাকার ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির-আবদুল্লাহিয়ানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। কাকার এখন বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের সম্মেলনে অংশ নিতে সুইজারল্যান্ডের দাভোসে রয়েছেন। সেখানেই সম্মেলনের এক ফাঁকে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি।
ইরান আগেও পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গিদের বিরুদ্ধে আন্তঃসীমান্ত অভিযান চালিয়েছে। কিন্তু এবারের মতো কোনো অভিযানের কথা মনে করতে পারছি না।
ওয়াশিংটনভিত্তিক উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, এই বৈঠকের রেশ না কাটতে হামলার খবর সামনে এসেছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। এর পরিণাম গুরুতর হতে পারে।’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘হামলার ঘটনায় দুই নিষ্পাপ শিশু নিহত হওয়ার পাশাপাশি তিন মেয়ে আহত হয়েছে।’
আনুষ্ঠানিক বিবৃতি প্রকাশের পরপরই ইসলামাবাদে নিযুক্ত ইরানের শীর্ষ কূটনীতিককে তলব করে পাকিস্তান সরকার।
এর আগে গতকাল রাতে ইরানের নূর সংবাদমাধ্যমের এক্স (সাবেক টুইটার) অ্যাকাউন্টে একটি পোস্ট দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, ‘মিনিটখানেক আগে পাকিস্তানের ভূখণ্ডে তথাকথিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠী জইশ আল-আদলের দুটি গুরুত্বপূর্ণ সদর দপ্তরে হামলা চালানো হয়েছে। রকেট ও ড্রোন হামলায় এসব সদর দপ্তর ধ্বংস হয়ে গেছে।’
গত বছরের ডিসেম্বরে ইরানের রাস্কে একটি পুলিশ স্টেশনে হামলার ঘটনা ঘটে। এতে ইরানের অন্তত ১১ পুলিশ সদস্য প্রাণ হারান। ওই হামলার দায়িত্ব স্বীকার করে নিয়েছিল জইশ আল-আদল। জাতিসংঘের দৃষ্টিতেও জইশ আল-আদল একটি সন্ত্রাসী সংগঠন।
ইরান ও পাকিস্তান জঙ্গিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার জন্য প্রায়ই পরস্পরকে দোষারোপ করে থাকে। বলা হয়ে থাকে, একটি দেশে ঘাঁটি তৈরি করে জঙ্গিরা অন্য ভূখণ্ডে হামলা চালায়। তবে এসব ঘটনায় দুপক্ষের সরকারি বাহিনীগুলোর জড়িত হওয়ার ঘটনা বিরল।
এ বিষয়ে এক্স বার্তায় ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংকট্যাংক উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ‘ইরান আগেও পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গিদের বিরুদ্ধে আন্তঃসীমান্ত অভিযান চালিয়েছে। কিন্তু এবারের মতো কোনো অভিযানের কথা মনে করতে পারছি না।’
সতর্ক করে কুগেলম্যান আরও বলেন, এটা পাকিস্তান ও ইরানের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে ডোবাতে পারে। এমনকি সবচেয়ে ভালো সময়েও এটা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে গুরুতর সংকট তৈরি করতে পারে। সূত্র : আলজাজিরা, এএফপি ও রয়টার্স