হুমায়ূন কবির
প্রকাশ : ২৮ জুলাই ২০২২ ১৯:০৮ পিএম
আপডেট : ২৮ জুলাই ২০২২ ১৯:১৫ পিএম
ফাইল ছবি
ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর মস্কোর ওপর রেকর্ড পরিমাণ নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধ দেওয়া হয়। বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ জ্বালানি রপ্তানিকারক এই দেশটির ওপর পশ্চিমাদের বিধিনিষেধ সর্বত্র জ্বালানি সংকট প্রকট করেছে। তাই দিনে দিনে বাড়ছে তেল-গ্যাসের জন্য হাহাকার। সৃষ্টি হচ্ছে নৈরাজ্য। অনেক দেশে ঘটছে ক্ষমতার পালাবদল। চলমান এই সংকট নিরসনে হন্যে হয়ে জ্বালানি খুুঁজছেন বিশ্ব মোড়ল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। মানবাধিকার রক্ষার ভাবমূর্তি ঝেড়ে ফেলে ‘খুনি’র সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন তিনি।
অথচ মার্কিন নির্বাচনের আগে ইয়েমেন যুদ্ধে সৌদি আরবের ভূমিকার জন্য বারবার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন বাইডেন। সে সময়ে বিশ্বমঞ্চে রিয়াদকে ‘একঘরে’ করে রাখারও হুমকি দিয়েছিলেন। সৌদিতে বিরোধীদের ওপর নির্যাতন, ভিন্নমত দমন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের (এমবিএস) সঙ্গে কখনো দেখা না করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন বাইডেন।
এরই মধ্যে ২০১৮ সালে তুরস্কে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে হত্যায় সরাসরি এমবিএসকে দায়ী করা হয়। পরে যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কের পৃথক তদন্তে ওই হত্যাকাণ্ডের সরাসরি নির্দেশদাতা হিসেবে যুবরাজকে চিহ্নিত করা হয়। এরপরই প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছিলেন, তিনি কখনো যুবরাজের মুখোমুখি হবেন না।
অথচ সেই ‘রক্তমাখা’ হাতে হাত মেলালেন বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসা বাইডেন। এখন হাঁটু গেড়ে তার কাছ থেকে তেল চাইছেন তিনি। এর চার সপ্তাহ আগেও তিনি এমবিএসের দেখা করবেন না বলে জানিয়েছিলেন। এমনকি তার ডেমক্রেটিক পার্টিও তার এমন পদক্ষেপে অখুশি। বাইডেনের এমন কর্মকাণ্ডে বহর্বিশ্বে গুরুত্ব বেড়েছে রিয়াদের।
এমননিতে ইউক্রেন যুদ্ধ চলামান থাকায় জ্বালানি সংকটের মধ্যে সৌদির কদর বেড়েছে সর্বত্র। বিশ্ববাজার পরিস্থিতি অনুকূলে রাখতে তার সঙ্গে দফায় দফায় যোগাযোগ করেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন। বিশেষ করে বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর মস্কো-রিয়াদের কৌশলগত সখ্যতা বেড়েছে। তবে বাইডেনের সাম্প্রতিক জেদ্দা সফর নতুন করে এমবিএসকে বিশ্বে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।
ফলশ্রুতিতে এখন ইউরোপ সফর করছেন মোহাম্মদ বিন সালমান। বুধবার গ্রিসের সঙ্গে জ্বালানি ও সামরিক চুক্তি করেছেন তিনি। এখন প্যারিস সফরে রয়েছেন তিনি। অথচ এতোদিন তাকে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী হিসেবে দেখে আসছিলেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ। স্থানীয় সময় গতকাল বৃহস্পতিবার জ্বালানি ও সামরিক বিষয়ে তাদের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। এর আগে সৌদি যুবরাজ সেখানে পৌঁছালে উষ্ণ অর্ভ্যথনা জানানো হয়। আতিথিয়তায় মুগ্ধ এমবিএস ফরাসি সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।
পশ্চিমারা দশকের পর দশক ধরে প্রধানত জ্বালানি তেলের স্বার্থে মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে সৌদি রাজপরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। তবে এবারের পরিস্থিতি একেবারে ভিন্ন। বাইডেন ক্ষমতায় এসে বলতে শুরু করেন, বাইরের যে কোনো দেশের সঙ্গে তার সরকারের সম্পর্কের ভিত্তি হবে মানবাধিকার। এরপর সৌদি যুবরাজ তার সঙ্গে কথা বলতে কয়েকবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। সৌদি আরবের কাছে নতুন করে অস্ত্র বিক্রি স্থগিত করেন বাইডেন।
কিন্তু সব উপেক্ষা করে সম্প্রতি জেদ্দার রাজপ্রাসাদে গিয়ে যুবরাজের সঙ্গে মুষ্টিবদ্ধ হাত মেলান (ফিস্ট বাম্প) বাইডেন।
এর কারণ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলেন, বাস্তবতার কাছে মাথা নত করছেন বা মেনে নিচ্ছেন ৭৯ বছরের এই মার্কিন প্রেসিডেন্ট। আর এর পেছনে প্রধানত কাজ করছে ইউক্রেন যুদ্ধ।
কদিন আগে ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় নিজের লেখা এক নিবন্ধে বাইডেন উল্লেখ করেছেন, সৌদি আরবকে ‘ব্ল্যাংক চেক’ দেওয়ার নীতি তিনি বদলে দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু ইউরোপে যুদ্ধের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের এবং সৌদি আরবের গুরুত্ব তিনি অনুধাবন করছেন।
বাইডেন লিখেছেন, ‘রাশিয়ার আগ্রাসনের পাল্টা ব্যবস্থা আমাদের নিতে হবে। চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় আমাদের শক্ত অবস্থান প্রয়োজন। এ কারণে সেসব দেশের সঙ্গে আমাদের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে যারা আমাদের চেষ্টায় সাহায্য করতে পারে। সৌদি আরব তেমন একটি দেশ।’
তিনি বলেন, ‘অশান্ত মধ্যপাচ্যের স্থিতিশীলতার জন্য এবং এই অঞ্চল যেন চীন ও রাশিয়ার প্রভাব বলয়ে ঢুকে না পড়ে- সেজন্য সৌদি আরবের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।’ বিশ্লেষকরা বলছেন, এর পেছনের সবচেয়ে বড় কারণ এখন তেল ফ্যাক্টর।
বাইডেন প্রশাসনের একাংশের মধ্যে বেশ কিছুদিন ধরেই যুবরাজ সালমান এবং সৌদি আরব নিয়ে প্রেসিডেন্টের অবস্থানের পরিণতি নিয়ে অস্বস্তি তৈরি হচ্ছিল। ইউক্রেন সংকটের পর যুক্তরাষ্ট্রের তেলের বাজারে অস্থিরতা দেখা দেওয়ায় সেই অস্বস্তি আরও বেড়ে যায়। বাইডেনও বুঝতে পারছেন বাড়তি সৌদি তেল এখন আমেরিকার জন্য কতটা জরুরি।
যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা মিডল-ইস্ট ইনস্টিটিউটের ভাইস প্রেসিডেন্ট ব্রায়ান কাটুলিস বলেছেন, ‘ছেলেমানুষি কাটিয়ে বাইডেনের প্রশাসন অভিজ্ঞ হতে শুরু করেছে। বিষয়টা এমন নয় যে আপনি এই ব্যক্তিকে (যুবরাজ সালমান) ক্ষমতা থেকে সরাতে পারবেন। ফলে জটিল এই পরিস্থিতি যতটা সম্ভব সামাল দিয়ে নিজের স্বার্থ দেখা। মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার এমন নীতির ভুরিভুরি নজির রয়েছে।’
দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের প্রকাশক ফ্রেড রায়ান এক নিবন্ধে লিখেছেন, “বাইডেন এখন জেদ্দায় হাঁটু গেড়ে 'একঘরে' মানুষটির রক্তে রঞ্জিত হাতে হাত মেলাচ্ছেন।” একই পত্রিকায় খাশোগির বাগদত্তা হাতিস চেনগিজ একটি উপ-সম্পাদকীয়তে প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে উদ্দেশ করে লেখন, ‘আপনি বিরোধীদের নির্যাতন করার জন্য, ইউক্রেনে যুদ্ধাপরাধের জন্য রাশিয়াকে নিন্দা করেন। সৌদি আরবও একই রকম ভয়ংকর মানবাধিকার লঙ্ঘন করে চলেছে। তাদের কেন আপনি ছাড় দিচ্ছেন? তেলের জন্য?’
বাস্তবে তেলের জন্য সৌদি আরবের ডিফ্যাক্টো নেতা মোহাম্মদ বিন সালমানকে সমীহ করছেন বাইডেন-ম্যাখোঁরা। এই জ্বালানিই তার সময় ফিরিয়েছে।