প্রবা প্রতিবেদন
প্রকাশ : ১৭ মার্চ ২০২৩ ১৭:৪৬ পিএম
আপডেট : ১৭ মার্চ ২০২৩ ১৮:৩৫ পিএম
ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। ছবি : সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের দফায় দফায় নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশের অভ্যন্তরে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এমনিতেই চাপে ছিল ইরান। তার ওপর আঞ্চলিক ‘পরাশক্তি’ সৌদি আরবের সঙ্গে সাত বছর ধরে সব ধরনের কূটনৈতিক সম্পর্কহীনতা দেশটিকে আরও বেশি কোণঠাসা করে রাখে। এ অবস্থায় ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি রিয়াদের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে রয়টার্সের এক বিশ্লেষণে।
রয়টার্সের বিশ্লেষণে বলা হয়, নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতা কাটাতে মরিয়া ছিলেন আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। এজন্য তিনি সব সময় রিয়াদের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের ওপর জোর দিতেন। বিষয়টি বিলম্বিত হওয়ায় একপর্যায়ে তিনি বেশ হতাশ হয়ে পড়েন। তা নিয়ে নিজের ঘনিষ্ঠ টিমের সঙ্গেও কয়েকবার বৈঠক করেন আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি।
মধ্যপ্রাচ্যের অঘোষিত পরাশক্তি সৌদি আরব ঐতিহাসিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র। তা ছাড়া যুগ যুগ ধরে, অন্তত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের সব কলকাঠি ওয়াশিংটনের হাতে। এ অবস্থায় রিয়াদ-তেহরানের মধ্যে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে বেইজিং কীভাবে ঢুকল, তা নিয়ে অনেকের কৌতূহল রয়েছে।
কিন্তু ওয়াকিবহাল মহলে বিষয়টি জলের মতো পরিষ্কার। একই মত শোনা গেছে ইরানি কর্মকর্তাদের মুখে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ইরানি কর্মকর্তা বলেন, ‘সৌদির সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনরে জন্য দুই বছর আগে আমরা কাজ শুরু করি। এ নিয়ে ইরাক ও ওমানে কয়েক দফায় বৈঠক হয়েছে। একটা পর্যায়ে তা থমকে দাঁড়ায়। এ অবস্থায় চীনের প্রসঙ্গটি আসে। চীনকে ডাকার বিষয়ে আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির পূর্ণ সমর্থন ছিল।
‘চীন বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব ও আগ্রহসহকারে নেয়। তারা রিয়াদ ও তেহরানের মধ্যে ব্যবধান কমিয়ে আনতে নানান উদ্যোগ গ্রহণ করে। ওমান ও ইরাক বৈঠকে যেসব বিষয় সমাধান করা যাচ্ছিল না, তা সমাধানের উদ্যোগ নেয় চীন।’ অন্যদিকে রিয়াদ-তেহরানের মধ্যে ওয়াশিংটনের মধ্যস্থতা করার কোনো সম্ভাবনা ছিল না বলেও মন্তব্য করেন ওই কর্মকর্তা।
আলোচনাসংশ্লিষ্ট চীনা কূটনৈতিক ওয়াং দি বলেন, ’আমরা এটা ধরে নিয়েই এগোই যে, উভয় পক্ষের সব মতবিরোধ রাতারাতি মিটমাট করা যাবে না। তবে মৌলিক কিছু বিষয়ে সম্মতি সম্ভব। উভয় পক্ষ ঠিক তেমন কিছু বিষয়ে একমত হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, উভয় পক্ষের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে আন্তরিকতা ছিল।’
শির সৌদি সফর
গত ডিসেম্বরে রিয়াদ সফর করেন চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। সফরে তিনি ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে রিয়াদ-তেহরানের মধ্যে চুক্তির মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা রাখার আগ্রহ প্রকাশ করেন স্বয়ং শি। সালমান তাতে আন্তরিকভাবে সাড়া দেন।
পরে ওমান ও ইরাক আলোচনার কিছু সংক্ষিপ্তসার চীনা কর্মকর্তাদের কাছে হস্তান্তর করে রিয়াদ। তা ছাড়া সম্ভাব্য চুক্তির একটি খসড়াও চীনের কাছে হস্তান্তর করে সৌদি আরব।
রাইসির বেইজিং সফর
এ অবস্থায় গত ফেব্রুয়ারিতে বেইজিং সফর করেন ইরানি প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি। সফরে শির সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেন তিনি। এতে মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও রাজনীতিসহ নানান বিষয়ে গভীর আলোচনা হয়।
বৈঠকে রাইসিকে রিয়াদের প্রস্তাবের একটি কপি হস্তান্তর করেন শি। পরবর্তীতে ইরান তাতে ইতিবাচক সাড়া দেয়।
হুতিকে অস্ত্র দেবে না ইরান
ইয়েমেনে বিদ্রোহী হুতিদের অস্ত্র না দিতে সম্মত হয়েছে ইরান। চীনের মধ্যস্থতায় গত সপ্তাহে করা সৌদি আরব ও ইরানের ঐতিহাসিক চুক্তির মধ্যে তেহরান এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সৌদি ও যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের বরাতে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের (ডব্লিউএসজে) এক প্রতিবেদনে এমন দাবি করা হয়েছে।
আরব নিউজ জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের এক সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ডব্লিউএসজেকে বলেন, সৌদি ও ইরানের চুক্তির ফলে ইয়েমেনে শান্তি ফেরার বড় সুযোগ তৈরি হয়েছে। গত সপ্তাহে করা চুক্তি সফল করার জন্য ইয়েমেনের হুতিদের অস্ত্র সরবরাহ না করারটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটা ইরানের জন্য অগ্নিপরীক্ষা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক সৌদি কর্মকর্তা বলেন, জাতিসংঘের বিধান মেনে ইরান হুতিদের অস্ত্র দেওয়া থেকে বিরত থাকবে বলে আশা করে সৌদি আরব। এতে করে সৌদি আরবে হামলা ও নতুন অঞ্চল দখলে নেওয়ার ক্ষমতা হারাবে হুতি।
২০১৪ সাল থেকে সৌদি সমর্থনপুষ্ট সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে ইয়েমেনের শিয়া ধর্মাবলম্বী হুতিরা। এরা শিয়া হলেও ঠিক ইরানের সংখ্যাগরিষ্ঠ শিয়াদের থেকে তারা নানান দিক থেকে আলাদা। সে যাই হোক, গৃহযুদ্ধের শুরু থেকে হুতিদের ক্ষেপণাস্ত্রসহ নানান ধরনের অস্ত্র দিয়ে আসছে ইরান। এসব অস্ত্র দিয়ে সৌদি আরবের তেল স্থাপনাসহ নানান গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোয় হামলা চালানো হয়েছে।
হুতিদের অস্ত্র দেওয়ার বাইরে আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তার ও অন্য অসংখ্য ইস্যুতে রিয়াদ-তেহরানের মধ্যে সাপে-নেওলে সম্পর্ক। এ অবস্থায় এক শিয়া ধর্মীয় নেতার ফাঁসি কার্যকর করায় সাত বছর আগে সৌদি আরবের সঙ্গে সব ধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে ইরান। জবাবে সৌদি আরবও একই পদক্ষেপ নেয়। এরপর থেকে বৈরী দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক ক্রমশ খারাপ হতে থাকে।
এ অবস্থায় চুপিসারে দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর গত সপ্তাহে রিয়াদ-তেহরানের মধ্যে সম্পর্ক ফের স্থাপনের বিশেষ কৃতিত্ব দেখায় বেইজিং। এটা মধ্যপ্রাচ্যে চীনের সার্বিক তৎপরতা বাড়ার লক্ষণ।
চীনের মধ্যস্থতায় রিয়াদ-তেহরানের চুক্তিকে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সব শক্তি সতর্কতার সঙ্গে স্বাগত জানিয়েছে।
সূত্র : রয়টার্স