বিবিসির তথ্যচিত্র নিয়ে কড়া প্রতিক্রিয়া
প্রবা প্রতিবেদন
প্রকাশ : ২৭ জানুয়ারি ২০২৩ ১১:৪২ এএম
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
ঘটনাস্থল মঙ্গলবার রাতে দিল্লির জেএনইউ ক্যাম্পাস। সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে একদল ছাত্রছাত্রী বড়পর্দায় নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে বিবিসির আলোচিত তথ্যচিত্রটি দেখানোর ব্যবস্থা করেছিল, সেটি দেখার জন্য জমায়েতও হয়েছিল বিশাল।
জেএনইউ কর্তৃপক্ষ এরপরই ছাত্র সংগঠনের অফিসে বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট কানেকশন ছিন্ন করে দেয়। অন্ধকারের মধ্যেই শত শত ছাত্রী কিউ আর কোড শেয়ার করে নিজেদের মোবাইল বা ল্যাপটপে ডকুমেন্টারিটি দেখতে শুরু করেন– এরই মধ্যে শুরু হয়ে যায় বিরুদ্ধ মতাবলম্বী ছাত্রগোষ্ঠীর পাথরবৃষ্টি। ক্যাম্পাসে ঢুকে দিল্লি পুলিশ নির্বিচারে লাঠিচার্জ করে।
গভীর রাতে জেএনইউতে সেই মারধর ও ধস্তাধস্তির পুনরাবৃত্তি দেখা গেল এদিন রাজধানীর আর একটি নামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়াতেও। আর সেখানেও উপলক্ষ ছিল একই-বিবিসির তথ্যচিত্রটি দেখানো।
জামিয়াতেও কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে বামপন্থি ছাত্রদের একটি সংগঠন বড়পর্দায় ডকুমেন্টারিটি দেখানোর ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু দুপুরে দাঙ্গা পুলিশ ক্যাম্পাসে ঢুকে তাদের সেই আয়োজন তছনছ করে দেয়। পূর্ব দিল্লিতে জামিয়ার ক্যাম্পাস রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে, ডজনখানেক ছাত্রকে পুলিশ তুলেও নিয়ে যায়।
এর আগে গত আটচল্লিশ ঘণ্টায় তেলেঙ্গানার হায়দরাবাদ ইউনিভার্সিটি, কেরালার কোচি ইউনিভার্সিটিসহ আরও বহু প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীরা এই ডকুমেন্টারির প্রথম পর্বটি প্রকাশ্যে দেখানোর ব্যবস্থা করেছে।
কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ (বিশ্ববিদ্যালয়) বা যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতেও এই তথ্যচিত্রের স্ক্রিনিং হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে এবং সর্বত্রই আয়োজক ছাত্রগোষ্ঠীগুলো এটা পরিষ্কার করে দিয়েছে সরকারি সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই তাদের এই পদক্ষেপ।
বস্তুত তিন বছর আগে বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন ক্যাম্পাসে যেরকম স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ দেখা গিয়েছিল, অনেকটা একই ধরনের দৃশ্য যেন আবার দেখা যাচ্ছে ভারতের নানা প্রান্তেÑ যদিও প্রতিবাদের বিষয়টা এখানে ভিন্ন। আর এখানেই এই প্রশ্নটা বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে, বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র বলে যারা নিজেদের দাবি করে থাকে সেই শক্তিশালী ভারত কেন বিবিসির মাত্র আটান্ন মিনিটের (প্রথম পর্ব) একটা তথ্যচিত্রে এত কঠোর প্রতিক্রিয়া জানাল? আর কেনই বা ইউটিউব বা টুইটারকে নির্দেশ দিয়ে তারা এই তথ্যচিত্রের সব লিঙ্ক ব্লক করতে বলল?
ভারতের বর্ষীয়ান সম্পাদক ও দ্য হিন্দু পত্রিকাগোষ্ঠীর প্রধান এন রাম মনে করেন, সত্যিকারের পরিণত একটি সরকার হলে তারা এই ধরনের একটি তথ্যচিত্রে ‘নো কমেন্টস’ বলেই জবাব সারত এবং পুরোপুরি উপেক্ষা করত।
বাস্তবে কিন্তু দেখা গেছে ভারত সরকার এটিকে ‘প্রোপাগান্ডা পিস’ বলে বর্ণনা করেছে এবং এতে ঔপনিবেশিক মানসিকতার পরিচয় প্রকাশ পাচ্ছে বলেও মন্তব্য করেছে। দেশের আইনমন্ত্রী পর্যন্ত কটাক্ষ করে বলেছেন, ‘বিবিসিকে কেউ কেউ দেশের সুপ্রিম কোর্টেরও ঊর্ধ্বে মনে করেন।’
এন রাম এজন্যই বলছেন, ‘এই যে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে সরকার যাকে বলে একেবারে “গন ব্যালিস্টিক” (যেন ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে), এটাই একেবারে আত্মঘাতী পদক্ষেপ হয়েছে। সরকার নিজেদের জালে নিজেরাই বল ঢুকিয়েছে।’
বিরোধী তৃণমূল কংগ্রেসের এমপি মহুয়া মৈত্র, যিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় লাগাতার বিবিসির তথ্যচিত্রর লিঙ্ক শেয়ার করে চলেছেন, তিনিও মনে করেন ভারতে তথ্যচিত্রটি আটকাতে গিয়েই সরকার এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদকে উস্কে দিয়েছে। বিবিসিকে মৈত্র বলছিলেন, ‘ডকুমেন্টারিটা ভালো, খারাপ বা কুৎসিত হতে পারেÑ কিন্তু সেটা আমরা ঠিক করব, যারা দেখছি। সরকার কোন সাহসে বলে কোনটা আমরা দেখব বা কোনটা দেখব না?’
তথ্যচিত্রের কনটেন্টে সরকারের ‘ভয় পাওয়ার মতো বিষয়’ আছে বলেই তারা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে এটির লিঙ্ক ব্লক করতে চাইছেÑ তা নিয়েও মহুয়া মৈত্রর কোনো সন্দেহ নেই।
ভারতের আরেক বর্ষীয়ান সাংবাদিক তাভলিন সিং টুইটারে (পরিচালক শেখর কাপুরকে উদ্দেশ করে) লিখেছেন, ‘বিবিসির একটা ডকুমেন্টারি যদি ভারতকে ডিস্টেবিলাইজ (অস্থিতিশীল) করতে পারে, তাহলে ভারতের পরাশক্তি হয়ে ওঠার স্বপ্ন না-দেখাই ভালো।’ সেই তাভলিন সিং-ও বিবিসিকে বলছিলেন, ‘পুরো ঘটনাক্রম দেখে আমার মনে হয়েছে এই ডকুমেন্টারিতে যে অস্বস্তিকর প্রশ্নগুলো তোলা হয়েছে সেগুলোর সামনে দাঁড়ানোর মতো সৎ সাহস এদেশে ক্ষমতাসীনদের নেই। আর সে কারণেই তারা মিডিয়ার কণ্ঠরোধ করতে উঠেপড়ে লেগেছে।’