আরমান হেকিম
প্রকাশ : ২৪ জুন ২০২৫ ১০:৩৫ এএম
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার উত্তেজনা সামরিক সংঘাতে রূপ নেওয়ার পর বৈশ্বিক অর্থনীতি নতুন করে অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হয়েছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জ্বালানি সরবরাহ, শ্রমবাজার এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যপথে অচলাবস্থার ঝুঁকি তৈরি হওয়ায় বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতি বহুমুখী চাপে পড়তে পারে।
বিশ্ব জ্বালানি বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান পথ হরমুজ প্রণালী কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। প্রতিদিন এ প্রণালী দিয়ে গড়ে দুই কোটির বেশি ব্যারেল তেল রপ্তানি হতো, সেখানে এখন ট্যাংকার চলাচল থমকে গেছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে বৈশ্বিক তেলের বাজারেÑ মূল্য লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে, আর শেয়ারবাজার ও আমদানিনির্ভর দেশগুলোর অর্থনীতিতে নেমে এসেছে অস্থিরতা। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, হরমুজের স্থবিরতা দীর্ঘ হলে তা বিশ্ব মুদ্রাস্ফীতি ও জ্বালানি সংকট আরও ঘনীভূত করবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিও বহুমুখী চাপের মুখে পড়তে পারেÑ বিশেষ করে জ্বালানি খাতে সরবরাহ ব্যাঘাত, রেমিট্যান্স প্রবাহে ভাটা, রপ্তানিতে বিলম্ব, মূল্যস্ফীতির চাপ এবং কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে।
জ্বালানি সরবরাহ ও বাজারে অস্থিরতা
বাংলাদেশ জ্বালানি আমদানিনির্ভর দেশ। বিশেষ করে কাতার ও ওমান থেকে এলএনজি এবং সৌদি আরব ও আরব আমিরাত থেকে অপরিশোধিত তেল আসে মূলত হরমুজ প্রণালী হয়ে। ইরান যদি এই পথ বন্ধ করে দেয় বা যুদ্ধের কারণে রুটে অস্থিরতা দেখা দেয়, তবে বাংলাদেশের এলএনজি আমদানি ব্যাহত হবে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বাড়বে, শিল্প খাতে গ্যাস সরবরাহ সংকুচিত হবে, কৃষি ও পরিবহন খাতে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে।
রয়টার্সের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ইরান কৌশলগতভাবে হরমুজ প্রণালীতে জাহাজ চলাচলে বাধা দিলে ব্রেন্ট তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি কমপক্ষে ১০০ ডলার পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। তবে আপাতত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে। গতকাল ব্রেন্ট তেলের দাম ২ দশমিক ৭ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৯ দশমিক ১২ ডলার আর যুক্তরাষ্ট্রের অপরিশোধিত তেলের দাম ২ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৭৫ দশমিক ৯৮ ডলার। অন্যদিকে স্বর্ণের দাম সামান্য শূন্য দশমিক ১ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে প্রতি আউন্স ৩ হাজার ৩৬৩ ডলারে।
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ সম্প্রতি বলেছেন, যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে এর চাপ আমাদের অর্থনীতিতেও পড়বে। তবে এখনও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণাধীন এবং জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর কোনো তাড়াহুড়া করা হচ্ছে না। বাণিজ্যে কোনো তাৎক্ষণিক প্রভাব আছে কি না জানতে চাইলে তিনি জানান, এখন পর্যন্ত বাণিজ্যে কোনো সমস্যা দেখা দেয়নি।
রেমিট্যান্স প্রবাহে সম্ভাব্য ধাক্কা
ইরান বা ইসরায়েল কেউই বাংলাদেশ থেকে সরাসরি অভিবাসী শ্রমিক নেয় না। তবে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ যেমন সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতারÑ এই অঞ্চলের যেকোনো অস্থিরতায় সরাসরি প্রভাবিত হয়। এই দেশগুলোতে লাখ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করেন। বিষয়টি বিশ্লেষণ করে অর্থনীতিবিদ মাসরুর আরেফিন বলেন, এসব দেশে পর্যটন ও অন্যান্য সেবা খাতে যুদ্ধের ধাক্কা অনিবার্যভাবে সেখানে বসবাসরত বাংলাদেশি শ্রমিকদের জীবিকাকে প্রভাবিত করবে। স্বল্পমেয়াদে প্রবাসী বাংলাদেশিরা তাদের বর্তমান চাকরি হয়তো হারাবেন না, তবে নতুন কর্মী নেওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে রেমিট্যান্সের প্রবাহ হ্রাস পাবে, যা লেনদেনের ভারসাম্যের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে।
তিনি বলেন, যদি এ সংঘাত এক বছর বা তার বেশি সময় ধরে চলে, তাহলে বাংলাদেশিরা তাদের চাকরি হারাতে শুরু করতে পারেন।
ব্যবসা-বাণিজ্যে সরবরাহ শৃঙ্খল বিঘ্ন
ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের কারণে বিশ্ববাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ রুটে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের আকাশসীমায় বিমান চলাচল সীমিত হওয়ায় পণ্য পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, অনেক কাঁচামাল মধ্যপ্রাচ্য হয়ে আসে। যুদ্ধের কারণে বিকল্প রুট ব্যবহার করতে হলে পরিবহন ব্যয় ও সময় উভয়ই বাড়বে, যা সরাসরি উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটাবে। ফলে দেশীয় শিল্প ও রপ্তানি খাত চাপে পড়বে।
বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে জ্বালানির দাম কমেছিল, তবে চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতিতে তা ধরে রাখা কঠিন হতে পারে। আন্তর্জাতিক পরিবহন ব্যবস্থা বিঘ্নিত হলে আমদানি-রপ্তানি ব্যয় ও সময় বেড়ে যাবে, যার অভিঘাত পড়বে ব্যবসায়িক পরিকল্পনায়।
মূল্যস্ফীতি বাড়ার আশঙ্কা
জ্বালানি খাতে অস্থিরতা, রেমিট্যান্স প্রবাহে ভাটা এবং সরবরাহ চেইনে বিঘ্নÑ এই তিনটির সমন্বিত প্রভাব পড়বে মূল্যস্ফীতিতে। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়লে শিল্প ও কৃষিতে উৎপাদন খরচ বাড়বে। সেখান থেকে পণ্য ও পরিষেবা খাতে দাম বাড়বে, যার ফলে ভোক্তারা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। বিশেষ করে ভোজ্য তেল, চিনির মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় আমদানিনির্ভর পণ্যের দামে প্রভাব পড়বে।
ড. ফাহমিদা বলেন, জ্বালানি ও কাঁচামালের দাম বাড়লে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাবে, যার চাপ সরাসরি দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর ওপর পড়বে।
তৈরি পোশাক খাতে অস্বস্তি
তৈরি পোশাক খাত বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস। বিজিএমইএর নবনির্বাচিত সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেছেন, চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতি রপ্তানির পরিবহন, উৎপাদন পরিকল্পনা এবং ক্রেতাদের আচরণে প্রভাব ফেলছে। বিশেষ করে যদি সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়, তাহলে অর্ডার বাতিল, মূল্যছাড় বা পেমেন্ট বিলম্বের মতো চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে। এই খাতে পণ্য সরবরাহ সময়মতো না করতে পারলে, বাংলাদেশের বাজার হারানোর ঝুঁকি বাড়বে।
কর্মসংস্থান হুমকিতে, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত
মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ পরিস্থিতি আরও বিস্তৃত হলে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো নতুন করে কর্মী নিয়োগ স্থগিত করতে পারে, বিমানের ফ্লাইট কমিয়ে দিতে পারে। এতে করে বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিদের ফিরে আসার আশঙ্কা যেমন তৈরি হবে, তেমনি নতুন শ্রমিকদের যেতে না পারায় দেশের অভ্যন্তরীণ বেকারত্বও বাড়বে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে গ্লোবাল ভোক্তা আস্থা ও বিনিয়োগ হ্রাস পাবে। ফলে সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির গতি কমে যাবে।
ইরান ও ইসরায়েলে রপ্তানির অবস্থান
বাংলাদেশের সঙ্গে ইসরায়েলের সরাসরি কূটনৈতিক বা বাণিজ্যিক সম্পর্ক না থাকলেও, তৃতীয় দেশের মাধ্যমে কিছু পণ্য রপ্তানি হয়ে থাকে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো ইপিবির তথ্য বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ইসরায়েলে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয়েছে ১২ লাখ ডলারের পণ্য। আগের বছর ছিল ৫ লাখ ডলার। এর আগেও ওঠানামা ছিল। ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছিল সর্বোচ্চ ৬৩ লাখ ডলার। প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল। তবে এসব পণ্য সাধারণত সিঙ্গাপুর, তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশে পুনঃরপ্তানির মাধ্যমে গন্তব্যে যায়। সরাসরি রপ্তানি না হওয়ায় প্রকৃত পরিমাণ আড়ালে থেকে যায়।
অন্যদিকে ইরানের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ছিল ১৫ কোটি ৮৬ লাখ ডলার। আগের বছরে ছিল ১৫ কোটি ৬৭ লাখ। পেছনের বছরগুলোতেও রপ্তানিতে ওঠানামা ছিল; ২০১৯-২০ সালে রপ্তানি ছিল ১৭ কোটি ৮১ লাখ, ২০২০-২১ সালে ১৮ কোটি ৪৪ লাখ, ২০২১-২২ সালে ১৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার। প্রধান রপ্তানি পণ্য কাঁচাপাট ও পাটজাত সামগ্রী।
তবে ইরানেও ব্যাংকিং নিষেধাজ্ঞা ও আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে সরাসরি বাণিজ্যে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অনেক সময় পণ্য বার্টার ট্রেড বা তৃতীয় দেশের মাধ্যমে রপ্তানি করতে হয়, ফলে রপ্তানির ধারাবাহিকতা বজায় রাখা কঠিন।