আইসিসির গ্রেপ্তারি পরোয়ানা
প্রবা প্রতিবেদন
প্রকাশ : ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ০৯:২৮ এএম
আপডেট : ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ১০:৪৭ এএম
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ছবি : সংগৃহীত
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হওয়ার ঘটনায় মোটেই চিন্তিত নন। বরং ‘আইসিসির সিদ্ধান্তকে বৈধ’ হিসেবে স্বীকৃতি জানাতে অস্বীকার করেছেন। এদিকে আইসিসির রায়কে ‘ইহুদিবিদ্বেষী’ আখ্যায়িত করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। যদিও এই রায়ের প্রতি ‘দায়বদ্ধ’ বলে জানিয়েছে যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফ্রান্স, ইতালি ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
ফিলিস্তিনের গাজায় হত্যাযজ্ঞ পরিচালনার দায়ে আইসিসির রায়ের পর বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ভাগ্যে কী ঘটতে পারে, তা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে চলছে জোর আলোচনা। যদিও এই রায় নেতানিয়াহুকে স্পর্শ করতে পারবে না বলেই মনে করেন অধিকাংশ বিশ্লেষক।
গত বৃহস্পতিবার (২১ নভেম্বর) নেতানিয়াহু ও দেশটির সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)। পাশাপাশি হামাসের সামরিক কমান্ডার মোহাম্মদ দেইফের বিরুদ্ধেও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। যদিও ইসরায়েলের দাবি, গত জুলাই মাসে হামলায় দেইফ মারা গেছেন।
পরোয়ানা জারির আদেশে আইসিসির বিচারকরা বলেছেন, ‘নেতানিয়াহু ও গ্যালান্ট ইচ্ছাকৃতভাবে গাজায় মানুষকে অনাহারে রাখা এবং ফিলিস্তিনিদেরকে নিপীড়নের অপরাধে দায়ী, সেটি বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি আছে।’
আইসিসির রায় ঘোষণার পরপরই এক বিবৃতিতে নেতানিয়াহু বলেন, ‘দ্য হেগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ইহুদিবিদ্বেষী যে সিদ্ধান্তটি নিয়েছে, তা আধুনিক যুগের ড্রেফাস ট্রায়াল। আর এর সমাপ্তিটাও একই হবে। আইসিসির সিদ্ধান্তকে বৈধ বলে স্বীকার করবে না ইসরায়েল।’ ড্রেফাস ট্রায়াল বলতে তিনি এক শতাব্দীরও বেশি সময় আগে ফ্রান্সের আলোচিত একটি ঘটনাকে ইঙ্গিত করেছেন। তখন ফ্রান্সে সেনাবাহিনীর ইহুদি ক্যাপ্টেন আলফ্রেড ড্রেফাসকে অন্যায়ভাবে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। পরে তাকে নির্দোষ ঘোষণা করা হয়।
বিবৃতিতে নেতানিয়াহু আরও বলেন, ‘আইসিসি ইচ্ছাকৃতভাবে আমাদের বিরুদ্ধে গাজাবাসীকে অনাহারে রাখার অভিযোগ করেছে। আমরা গাজার জনগণকে খাওয়ানোর জন্য সাত লাখ টন খাদ্য সরবরাহ করেছি। আমরা গাজার নাগরিকদের ক্ষতির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য লাখ লাখ টেক্সট বার্তা, ফোন কল, লিফলেট পাঠিয়েছি।
এ বিষয়ে সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট বলেছেন, ‘আইসিসি ইসরায়েল রাষ্ট্র ও হামাসের খুনি নেতাদের একই কাতারে দাঁড় করিয়েছে। আর এতে তারা হামাস যোদ্ধাদের শিশু খুন, ধর্ষণ আর বয়স্ক মানুষদের অপহরণের বৈধতা দিয়ে দিয়েছে।’
তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এ গ্রেপ্তারি পরোয়ানাকে ইহুদিবিদ্বেষী হিসেবে আখ্যা দিয়ে এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আইসিসি যা-ই বোঝাক না কেন, ইসরায়েল ও হামাস কোনোভাবেই সমতুল্য নয়। নিরাপত্তাকে হুমকি মোকাবিলার ক্ষেত্রে আমরা সব সময়ই ইসরায়েলের পাশে থাকব।’
এদিকে হামাস দেইফের গ্রেপ্তারি পরোয়ানার কথা উল্লেখ না করলেও নেতানিয়াহু ও গ্যালান্টের বিরুদ্ধে পরোয়ানা নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে। তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাকে ‘ঐতিহাসিক’ এবং ‘নজিরবিহীন’ ঘটনা বলে অভিহিত করেছে।
আইসিসি ঘোষিত গ্রেপ্তারি পরোয়ানার প্রভাব নির্ভর করবে আদালতের ১২৪টি সদস্য রাষ্ট্রের সমর্থনের ওপর। যদিও এই সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে ইসরায়েল বা তার মিত্র যুক্তরাষ্ট্র অন্তর্ভুক্ত নয়। রায়ের বিষয়ে ব্রিটিশ সরকারও বলেছে, তারা আদালতের স্বাধীনতাকে সম্মান করে।
কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো জানিয়েছেন, তিনি এই রায়কে সম্মান জানাবেন। টেলিভিশনের একটি সাক্ষাৎকারে ট্রুডোকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক আদালতের রায়কে তিনি সম্মান জানাবেন। কারণ কানাডা আন্তর্জাতিক আইন মানতে দায়বদ্ধ।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পররাষ্ট্রনীতির প্রধান জোসেপ বরেল ইইউর ২৭টি দেশের প্রধানকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, তারা আন্তর্জাতিক আদালতের রায় মানতে দায়বদ্ধ। আন্তর্জাতিক আদালতের রায় ঘোষণার পরই এই মন্তব্য করেছেন বরেল। এছাড়া মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সিদ্ধান্তে সন্তোষ প্রকাশ করেছে। তুরস্ক, স্পেন, নরওয়ে, সুইডেন ও বেলজিয়াম এই সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক বলেছে।
নেতানিয়াহু ও গ্যালান্টের বিরুদ্ধে আইসিসির ওই পরোয়ানা জারি করার অর্থ হলো, গ্রেপ্তার হলে তাদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে। তবে যতক্ষণ গ্রেপ্তার না হচ্ছেন, ততক্ষণ তাদের বিচার শুরু হচ্ছে না। কেননা নেতানিয়াহু ও গ্যালান্টের অনুপস্থিতিতে তাদের বিচার করার এখতিয়ার এ আদালতের নেই।
গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির খবর প্রকাশ হওয়ার পর লন্ডনের কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবাধিকার আইনের অধ্যাপক ও ব্রিটিশ সোসাইটি ফর মিডল ইস্ট স্টাডিজের ভাইস প্রেসিডেন্ট নেভ গর্ডন আলজাজিরাকে বলেন, আইসিসির কাছে এটি একটি জোরালো মামলা এবং ক্ষুধাকে গাজাবাসীর বিরুদ্ধে ইসরায়েলি নেতাদের অস্ত্র বানানোর বিষয়টি প্রমাণ করা মোটামুটি সোজাই হবে।
তিনি আরও বলেন, ‘প্রায় ২০ বছর ধরে ইসরায়েল ক্ষুধাকে গাজায় অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। আমি মনে করি, ইসরায়েলের নেতাদের বক্তব্য ও দেশটির সামরিক বাহিনীর কর্মকাণ্ডে খাদ্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার অভিপ্রায় স্পষ্ট এবং আমার ধারণা, এটি প্রমাণ করা সহজ হবে।’
এ ছাড়া গাজার ৩৬টি হাসপাতালের সবগুলো ইসরায়েলি বাহিনী নিশানা করেছে বলে উল্লেখ করেন এ অধ্যাপক। আলজাজিরার তথ্য অনুযায়ী, উপত্যকাটিতে প্রায় বিরামহীনভাবে চালানো বোমা হামলায় অ্যাম্বুলেন্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদেরও নিশানা করা হয়েছে। গর্ডন বলেন, এসব প্রমাণ আইসিসির প্রসিকিউটরদের মামলা পরিচালনায় সহায়তা করবে।
আদালতের এ পরোয়ানার ফলাফল বাস্তবে দেখা যেতে পারে। বৃহস্পতিবারের রায়ের আগে নেতানিয়াহু ও গ্যালান্ট যেভাবে বিদেশে ভ্রমণ করেছেন, এখন থেকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এমন সফর করাটা তাদের জন্য কঠিন হয়ে উঠবে। কেননা বিদেশ সফরে গিয়ে গ্রেপ্তার হতে পারেন তারা।
নেতানিয়াহু ও গ্যালান্টের গ্রেপ্তার হওয়ার এমন সম্ভাবনা থাকার কারণ, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রোম সনদে ১২৪টি দেশ স্বাক্ষর করেছে। এসব দেশে সফরে গেলে তাদের গ্রেপ্তার করতে সংশ্লিষ্ট সরকারগুলোর আইনি বাধ্যবাধকতা থাকবে।