প্রবা প্রতিবেদন
প্রকাশ : ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ০৯:১৫ এএম
আপডেট : ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ১০:৪৬ এএম
গৌতম আদানি। ছবি : সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ের পর আদানির উচ্ছ্বাসপূর্ণ অভিনন্দনের পর ধারণা ছিল ভারতের গ্রিন এনার্জি খাতের ব্যবসার অগ্রগতি হবে। এরই মধ্যে গত বুধবার (২০ নভেম্বর) যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের এক আদালতের সৌর প্রকল্প আদায়ে ঘুষ ও দুর্নীতির অভিযোগে গৌতম আদানি ও তার ভাইয়ের ছেলে সাগর আদানির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পরপরই দেশ-বিদেশে আদানি গ্রুপের ব্যবসা বিপর্যয়ের মুখে পড়ে।
মুখ্যত গৌতম আদানির সৌর প্রকল্প বা ভারতের গ্রিন এনার্জি খাতের সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে এই পরোয়ানা বড় বিপর্যয় বলা চলে। গ্রেপ্তারি পরোয়ানার পর কেনিয়া, চীন, যুক্তরাষ্ট্র এমনকি আরও কয়েকটি রাষ্ট্রে ভারতের এনার্জি খাতের ব্যবসায় বিপর্যয়ের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। আদানির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর ভারতের ভূরাজনৈতিক, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনাসহ ভারতীয় ব্যবসারও ক্ষতি হবে বলে জানিয়েছে টাইমস অব ইন্ডিয়া।
অভিযোগে বিপর্যস্ত আদানি
মোদির ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত গুজরাটের এই ভূমিপুত্রের বিরুদ্ধে দেশের সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের বরাদ্দ পাওয়ার জন্য সরকারি কর্মকর্তাদের ২ হাজার ২৩৭ কোটি টাকা ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ এসেছে। গত এক বছরে একাধিকবার তার গায়ে দুর্নীতির কালির ছিটা পড়েছে। ২০২৩ সালে শেয়ার জালিয়াতির অভিযোগ এনে রিপোর্ট করে হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ। সেখানে গৌতম আদানির বিরুদ্ধে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারদর ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানোর কথা উল্লেখ করেছিল সংশ্লিষ্ট সংস্থাটি। হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের ওই রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসতেই হু-হু করে পড়তে থাকে আদানিদের যাবতীয় সংস্থার স্টকের দাম। মুহূর্তে শেয়ারবাজার থেকে উবে যায় তাদের ১০ হাজার কোটি টাকা। তবে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের দায়েরকৃত মামলার পর শেয়ারদর ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানোর কোনো প্রমাণ মেলেনি বলে উল্লেখ করা হয়। ধীরে ধীরে স্টকমার্কেটে আদানি গোষ্ঠীর সংস্থাগুলোর দর চড়তে শুরু করে। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন গৌতম আদানিও।
সুপ্রিম কোর্টে সেবির রিপোর্ট দাখিলে ক্লিনশিট পান শিল্পপতি আদানি। তার সংস্থা ‘আদানি পোর্টস’-এর বিরুদ্ধে হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ যে অভিযোগ এনেছিল, তা ভিত্তিহীন বলে জানিয়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্রের তদন্তকারী সংস্থা। আদানিদের টাকা সরানোর পেছনে সেবির চেয়ারম্যান মাধবী পুরী বুচের হাত রয়েছে বলে দাবি করে বসে এই মার্কিন সংস্থা। সেবির প্রধানের বিরুদ্ধে হিন্ডেনবার্গের ওই অভিযোগে অবশ্য আদানিদের তেমন কোনো ব্যবসায়িক লোকসান হয়নি। কিন্তু লোকসানের খবর এখানেই শেষ নয়।
কেনিয়ায় ধাক্কা আদানির ব্যবসা
কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবির জোমো কেনিয়াট্টা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর চুক্তিভিত্তিক অধিগ্রহণের কথা বলেছিল আদানি শিল্পগোষ্ঠী। কিন্তু চলতি বছরের অক্টোবরে চুক্তি বাস্তবায়নে সাময়িক স্থগিতাদেশ জারি করেন দেশটির স্থানীয় এক আদালত। কেনিয়া সরকারের দাবি, বিমানবন্দর বিক্রি করা হচ্ছে না। শুধু তা-ই নয়, বিমানবন্দর সংস্কার চুক্তির ব্যাপারে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়নি। এটি আসলে একটা সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ। বিমানবন্দর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব কার হাতে থাকবে তা-ও চূড়ান্ত নয়। ৩০ বছরের মেয়াদে আদানি এয়ারপোর্টের সঙ্গে ১৫ হাজার ৫২৬ কোটি টাকার চুক্তি করেছিল কেনিয়া সরকার। এবার আদানির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর গত বৃহস্পতিবার পূর্ব আফ্রিকার দেশটির প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম রুটো গৌতম আদানির সঙ্গে হওয়া দুটি বড় চুক্তি বাতিল করার ঘোষণা দেন। আদানি গ্রুপ কেনিয়ার প্রধান বিমানবন্দরে এক দশমিক ৮৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা করেছিল। চুক্তি অনুযায়ী, তারা সেটি ৩০ বছরের জন্য পরিচালনা করবে। এ ছাড়া দেশটির বিদ্যুৎ লাইন নির্মাণের জন্য জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ৭৩৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও একটি চুক্তি ছিল।
সক্রিয় হতে পারে যুক্তরাষ্ট্র
যুক্তরাষ্ট্রের ভারতীয় বংশোদ্ভূত আইনজীবী রবি বাত্রা সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে বলেছেন, ‘অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির জন্য সক্রিয় হতে পারেন অ্যাটর্নি জেনারেল ব্রেয়ন পিস।’ যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে ‘প্রমাণসহ অভিযোগপত্র’ (ইনডিক্টমেন্ট) জমা পড়েছে গত বৃহস্পতিবার। ঘুষ দেওয়ার অভিযোগে গৌতম আদানি এবং তার ভাইপো সাগরের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির খবরও প্রকাশিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে। তার জেরে ‘প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠ’ শিল্পপতি এবং তার সহযোগীদের ‘ভবিষ্যৎ’ নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা জল্পনা। এই পরিস্থিতিতে অ্যাটর্নি জেনারেল ব্রেয়ন পিস আদালতে অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারের জন্য সক্রিয় হতে পারেন বলে আইনজীবীদের একাংশের ধারণা। যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী, ভারতীয় নাগরিক গৌতম, সাগরদের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকরের দায়িত্ব বিদেশবিষয়ক আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার। তাদের দায়িত্ব হস্তান্তরের ভার অ্যাটর্নি জেনারেলের। যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, ইতোমধ্যেই সেই দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তুতি শুরু করেছেন নিউইয়র্কের ইস্টার্ন ডিসট্রিক্ট আদালতের সরকারি কৌঁসুলিরা। সেই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে আদানির প্রত্যর্পণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশ দপ্তরের দ্বারস্থ হতে পারে বিদেশবিষয়ক আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা।
পশ্চিমা বিশ্বে ফান্ড রাইজিং এখন কঠিন
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম বিজনেস টুডে জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির এক ঘণ্টার ব্যবধানে যুক্তরাষ্ট্রে করা ৬০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বণ্ড ইস্যু স্থগিত করা হয়। আর এই স্থগিতাদেশের ফলে আদানি গোষ্ঠীর মার্কেট ভ্যালু ২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার কমেছে। এসকেআই ক্যাপিটালের ম্যানেজিং ডিরেক্টর নরেন্দার ওয়াধা জানান, ‘আদানির ওপর অভিযোগ আসার পর গোষ্ঠীটি বৈশ্বিক বাজারে পুঁজি আনার ক্ষেত্রে এখন বড় বাধার মুখে পড়ছে। তা ছাড়া আস্তে আস্তে অনেকেই শেয়ারবাজার থেকে তাদের বিনিয়োগ উত্তোলন করে নিচ্ছে। এক্ষেত্রে আদানি গোষ্ঠী কিছুটা রক্ষণশীল অবস্থানে থেকে ক্ষয়ক্ষতি কমানোর চেষ্টা করছে বলে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানাচ্ছে না। কিন্তু আন্তর্জাতিক পরিসরে নিজেদের ব্যবসা সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে তারা।’ তবে অনেকেই বলছেন, আদানি গোষ্ঠী যুক্তরাষ্ট্র বাদে অন্য অংশ থেকে তাদের বিনিয়োগ ও পুঁজি লগ্নি করতে পারবেন। তবে এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্কের প্রভাবও বিচার করতে হবে। এমন একসময়ে এই রায় ভারতের ফরেইন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট (এফডিআই) আদায়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভারতের নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে বিপর্যয়
নরেন্দ্র মোদি ২০৩০ সাল নাগাদ ভারতের নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে ৫০ শতাংশ বৈদেশিক বিনিয়োগ অর্জনের লক্ষ্য নিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে আদানি গোষ্ঠীর ব্যবসা ছিল তার প্রধান অবলম্বন। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বেই যখন তার মূল বেসরকারি অবলম্বন প্রশ্নবিদ্ধ, তখন বিনিয়োগের পথও বন্ধ। স্বাধীন পুঁজিবাজার বিশ্লেষক নিমিস মহেশ্বরী রয়টার্সকে জানান, ‘শুধু আন্তর্জাতিক নয়, ভারতের বাজারেই বিনিয়োগকারীরা এখন বাজারের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। তারা এই খাতে স্বচ্ছতা ও বিনিয়োগের অর্থ লগ্নির নিশ্চয়তা দাবি করবে।’
অন্যদিকে আদানির গ্রুপের এই বিপর্যয়ের ফলে সোলার ও বায়ুনির্ভর শক্তি উৎপাদন প্রজেক্টে বিনিয়োগ সংগ্রহ করার কাজটি দীর্ঘায়িত হবে। ব্যয়ও বাড়বে। ইতোমধ্যে ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কনগ্লুমারেট বেদান্ত রিসোর্সেস তাদের বিনিয়োগ করা বন্ডগুলোকে উত্তোলন বা সমন্বয় করার চেষ্টা করছে। প্রশ্ন উঠেছে ভারতের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কর্তাদের ওপরও। কঠোর নজরদারির প্রতিশ্রুতি থাকার পরও এমন দুর্নীতির খবরে ভারতীয়রাও বিনিয়োগে পিছিয়ে যাবে। তা ছাড়া বৈশ্বিক বাজারে ভারতের নবায়নযোগ্য শক্তি বাণিজ্য নাজুক অবস্থায়।
লাভ হতে পারে বাংলাদেশের
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দুকে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর ড. ইজাজ হোসেন বলেছেন, গৌতম আদানির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানার বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য লাভজনক হবে। তিনি আরও বলেন, আদানি ও শেখ হাসিনা সরকারের মধ্যে হওয়া জ্বালানি চুক্তি প্রথম থেকেই বিতর্কিত ছিল। কারণ হাসিনার আমলে হওয়া অন্য চুক্তির মতো এটিও কোনো টেন্ডার ছাড়া হয়। তা সত্ত্বেও অন্তর্বর্তী সরকার আদানির প্রতি ইতিবাচক পদক্ষেপ ও আলোচনা চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু আদানির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের এই অভিযোগের পর আলোচনার জায়গা খুব সম্ভবত কমে যাবে। ফলে বিদ্যুতের দাম পুনর্নির্ধারণে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তীব্র চাপে পড়বে আদানি গ্রুপ।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এ ব্যাপারে যোগাযোগ করেছিল দ্য হিন্দু। কিন্তু তারা কোনো মন্তব্য করেনি। তবে দেশটির কর্মকর্তারা বলেছেন, জি-টু-জি চুক্তির আওতায় বাংলাদেশে এখনও বিদ্যুৎ সরবরাহ করছেন তারা। কিন্তু আদানির মতো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি নিয়ে তারা প্রয়োজন না হলে হস্তক্ষেপ করবেন না। বুয়েটের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. ইজাজ বলেছেন, আদানি বাংলাদেশকে চুক্তির প্রস্তাবে জানায়Ñ তারা অস্ট্রেলিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা এনে সেগুলো দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে বাংলাদেশে পাঠাবে। যেহেতু বাংলাদেশে গভীর সমুদ্রবন্দর নেই তাই বিষয়টির যৌক্তিকতা ছিল। একসময় এ চুক্তির সমালোচকরা বলেন, আদানি ভারত সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি পেলেও বাংলাদেশের সঙ্গে ভাগাভাগি করেনি।
বিদ্যুতের যে দাম আদানি নির্ধারণ করেছে, সেটি নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক ছিল। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড আদানির কাছে বিদ্যুতের দাম পুনর্মূল্যায়ন করার জন্য একটি চিঠি দেয়। সম্প্রতি আদালতের আদানির সঙ্গে চুক্তি তদন্তের নির্দেশ দেওয়ায় বাংলাদেশ এখন পুরো চুক্তি পর্যালোচনা করতে পারবে।
সূত্র : টাইমস অব ইন্ডিয়া, বিজনেস টুডে, রয়টার্স, দ্য মিন্ট, দ্য হিন্দু