যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন
দীপক দেব, যুক্তরাষ্ট্র থেকে
প্রকাশ : ৩১ অক্টোবর ২০২৪ ১৩:৪৬ পিএম
আপডেট : ৩১ অক্টোবর ২০২৪ ১৪:৫৪ পিএম
যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস ও সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। গ্রাফিক্স প্রবা
দরজায় কড়া নাড়ছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। দেশটির পরবর্তী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করতে ভোটাররা আগামী ৫ই নভেম্বর তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। এবারের নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী কমলা হ্যারিসের মধ্যে।
দুই প্রার্থীর বিজয় সম্ভাবনা থেকে সংশ্লিষ্টদের অনেকেই মনে করছেন- অতীতের যেকোনো সময়ের থেকে এবারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। এমনকি দুই রাষ্ট্রপতি সমর্থিত বাংলাদেশি বংশদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা নিজ নিজ প্রার্থীর জয়ের ব্যাপারে দারুণ ভাবে আশাবাদী। তারা আভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক অর্থনীতির পাশাপাশি ভূরাজনীতিকে এর পেছনের কারণ হিসেবে যুক্তি তুলে ধরছেন। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প নাকি কমলা হ্যারিস কে হবেন পরবর্তী রাষ্ট্রপতি তার জন্য শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে এমনটাও মনে করছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য যে প্রার্থী সবথেকে বেশি ভোট পাবেন, তিনিই যে জয়ী হবেন, এমন নিশ্চয়তা নেই। এর কারণ হল ভোটাররা সরাসরি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেন না। ‘ইলেক্টোরাল কলেজ’ নামক এক পদ্ধতিতে হয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন।
ভোটাররা হয় কমলা নয় ট্রাম্পকে ভোট দেবেন। তবে এদের দুজনের মধ্যে কে জয়ী হবেন, সেটা ভোটারদের দেওয়া ভোটে সরাসরি নির্ধারিত হবে না। জাতীয় স্তরের নির্বাচনি লড়াইয়ের বদলে জয়ী-পরাজিত নির্ধারিত হবে একেকটি অঙ্গরাজ্যের নির্বাচনি লড়াইয়ের মাধ্যমে।
যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যের একটিতে জয়ী হওয়ার অর্থ একজন প্রার্থী সেই অঙ্গরাজ্যের সবকয়টি ‘ইলেক্টোরাল কলেজ’ ভোট পেয়ে যাবেন।
ইলেক্টোরাল কলেজের মোট ভোটের সংখ্যা ৫৩৮।
মাইন ও নেব্রাসকা এই দুটো অঙ্গরাজ্য বাদে বাকি সবগুলো রাজ্যের ইলেক্টোরাল ভোট যোগ করে যে প্রার্থী ২৭০টি বা তারও বেশি ভোট পাবেন তিনিই দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন।
এবার কি যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কমলা হ্যারিসকে নারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে পাবে নাকি দ্বিতীয় মেয়াদে জয় পেয়ে ক্ষমতায় বসবে ডোনাল্ড ট্রাম্প তা নিয়ে চলছে নানান হিসাব নিকাশ। বিশেষ করে দুই প্রার্থীর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ও সম্প্রতিক বক্তব্য ও অতীত কর্মকান্ড নিয়ে চলছে শেষ মুহূর্তের সমীকরণ। হোয়াইট হাউজে যাওয়ার দৌড়ে কে এগিয়ে সে বিষয়ে নজর রয়েছে সবার।
নিউইয়র্কে বসবাসরত বাংলাদেশি আমেরিকান, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. আবু জাফর মাহমুদ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে জানিয়েছেন, এই নির্বাচনে আমেরিকায় বসবাসরত বাংলাদেশিদের জন্যই শুধু নয় সব ইমিগ্রান্টদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া আগাম ভোটেও যার প্রতিফলন লক্ষ্য করা গিয়েছে। অতীতের যেকোনো নির্বাচনের চেয়ে এবার ভোটার উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। সেখানে ইমিগ্রান্ট ভোটারদের উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য।
তিনি আরও জানিয়েছেন, নিউইয়র্ক শহরে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ইমিগ্রেন্টদের বসবাস হওয়ার কারণে এই রাজ্যে কমলা হ্যারিসের বিজয়ের সম্ভাবনা অনেক বেশি।
বিশ্লেষকদের মতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি রাজ্য রয়েছে। কিন্তু এগুলোর মধ্যে কিছু কিছু রাজ্যের ভোটাররা প্রায় সবসময় একই দলকে ভোট দেয়। আবার এমন কিছু রাজ্য আছে যেখানে দুই দলের প্রার্থীদেরই জয় পাওয়ার সুযোগ আছে। এগুলো এমন জায়গা যেখানে কেউ এগিয়ে থাকলে নির্বাচনে জয়ী হবে ও পিছিয়ে পড়লে হেরে যাবে। এই রাজ্যগুলো যুদ্ধক্ষেত্র রাজ্য বা সুইং স্টেট হিসাবে পরিচিত।
আমেরিকান নির্বাচনে রিপাবলিকান দুর্গ বলে পরিচিত অঙ্গরাজ্যগুলোকে বলা হয় ‘রেড স্টেট’ বা ‘লাল রাজ্য’ আর ডেমোক্র্যাটদের প্রাধান্য পাওয়া স্টেটগুলোকে বলা হয় ‘ব্লু স্টেট’ বা ‘নীল রাজ্য’। ফলে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীরা নির্দিষ্ট কিছু ‘সুইং স্টেট’এর দিকে নজর দেন যেখানে ভোট কোন পার্টির পক্ষে যাবে, তা নির্দিষ্ট করে বোঝা যায় না। আর এ ক্ষেত্রে দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলো বড় প্রভাব রাখে। এ বছর এমন রাজ্য রয়েছে সাতটি। এগুলো হলো : পেনসিলভানিয়া (১৯টি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট), মিশিগান (১৫টি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট), অ্যারিজোনা (১১টি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট), উইসকনসিন (১০টি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট), নেভাডা (৬টি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট), জর্জিয়া ও নর্থ ক্যারোলাইনা। ট্রাম্প ও কমলা দুইজনকেই এই সাত অঙ্গরাজ্যে গুরুত্ব সহকারে প্রচার চালাতে দেখা গেছে।
বাংলাদেশি আমেরিকান রিপাবলিকান অ্যালায়েন্স ইউএসএ এর চেয়ারম্যান নাসির খান পল প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘সময় বদলেছে। একটা সময় ছিল ইমিগ্রেন্টরা ডেমোক্রেটদের সমর্থন করত, এখন সেই অবস্থা নেই। তরুণ বাংলাদেশি আমেরিকানদের বড় একটা অংশ ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতিকে সমর্থন করে। অবৈধ ইমিগ্রেন্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার যে ঘোষণা ডোনাল্ড ট্রাম দিয়েছে তাতে পুরোপুরি একমত নতুন প্রজন্ম। এছাড়া ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগের শাসনামলে পৃথিবীতে কোথাও নতুন করে যুদ্ধ হয়নি। তাই পুরো পৃথিবীতে যুদ্ধ বন্ধের জন্য ট্রাম্পের মতো নেতাকেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবে সবাই। পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি কমিয়ে অর্থনৈতিক চাকা সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ট্রাম্পের কোন বিকল্প নেই। এই কাজে ডেমোক্র্যাটরা ব্যর্থ হয়েছে যা এরই মধ্যে আমেরিকার নাগরিকরা বুঝতে পেরেছে। তাই এবারের নির্বাচনে ট্রাম্পের জয়ের সম্ভাবনাই বেশি।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণার শেষ দিকে কমলা হ্যারিস ও ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি ভোটারদের উদ্দেশ্যে তাদের সমাপনী বক্তব্য প্রদান করেছেন।দুই পক্ষকে একে অপরের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণ পর্যন্ত করতে দেখা গেছে।
অনেক বিষয়ের পাশাপাশি কমলা হ্যারিস তার সমাপনী বক্তব্যে গর্ভপাতের অধিকার রক্ষারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘মানুষ তাদের নিজের শরীরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মৌলিক স্বাধীনতা রাখে।’ এর আগে বক্তব্যের শুরুতেই কমালা হ্যারিস বলেছিলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘আমেরিকার নারীদের গর্ভধারণ করতে বাধ্য করবেন…আপনারা প্রজেক্ট ২০২৫ গুগল করুন।’ কিন্তু ট্রাম্প এই ধরনের কিছু করার পরিকল্পনা করছেন এমন কোনও প্রমাণ এখনও মেলেনি। তবে অনেকেই মনে করছেন এই বক্তব্যের কারণে উল্লেখ্যযোগ্য সংখ্যক নারী ভোটাররা কমলা হ্যারিসের প্রতি সমর্থন জানাবেন।
অন্যদিকে একই সময়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প পেনসিলভেনিয়ার অ্যালেন্টাউনে একটি প্রচারণা সমাবেশে ভোটারদেরকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘চার বছর আগের তুলনায় আপনি কি এখন ভালো অবস্থায় আছেন?’ এরপর একে একে তিনি তার নির্বাচনি প্রতিশ্রুতিগুলো পুনরাবৃত্তি করেন। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে– মূল্যস্ফীতি কমানো ও যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসীদের ‘অনুপ্রবেশ বন্ধ করা’।
সমাপনী বক্তব্যের পর রাজনীতি বিশ্লেষক ইয়োসি মেকেলবার্গ বলেছেন, ‘এই বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ব্যক্তিগত আক্রোশ ও অপমানের মধ্য দিয়ে চলছে। দেশের উন্নয়নে গঠনমূলক কথাবার্তা হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু দুই প্রার্থী যেন একে অপরকে দুই প্রান্তে ফেলে দিতে চেয়েছেন। অথচ তাদের বক্তব্যের মূল স্তম্ভ হওয়া উচিত ছিল গণতন্ত্র।’