সাইফুল হক মোল্লা দুলু, মধ্যাঞ্চল
প্রকাশ : ০৮ মে ২০২৪ ১৩:১৭ পিএম
কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার দামপাড়া গ্রামে তালপাখা তৈরি করছে নারী উদ্যোগীরা। তাদের তৈরি পাখা সারা দেশে যাচ্ছে। প্রবা ফটো
লোডশেডিংয়ের ভয়াবহতা ও তীব্র গরমে এখন শোভা পাচ্ছে হাতপাখা। বিদ্যুৎ চলে গেলে হাতপাখা নাড়িয়ে কিছুটা প্রশান্তি খুঁজছে মানুষ। তাই হাতপাখার কদর বেড়েছে। আর এ চাহিদা মেটাতে পাখা তৈরির ধুম পড়েছে কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার দামপাড়া গ্রামের পাখাপল্লীতে। পাখার চাহিদা মেটাতে প্রায় ৩০০ পরিবারের কারিগররা সারা দিন কঠোর পরিশ্রম করে জীবনজীবিকা চালিয়ে যাচ্ছে।
একসময় গরমের দিনে হাতপাখাই ছিল সহায়। ঘরে ঘরে ছিল এর কদর। এখন বৈদ্যুতিক পাখা আর এয়ার কন্ডিশনের দাপটে কমেছে হাতপাখার ব্যবহার। তবে এবারের টানা তাপপ্রবাহ আর ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে চাহিদা বেড়েছে হাতে তৈরি পাখার। ব্যস্ততাও বেড়েছে দামপাড়ার হাতপাখা শিল্পীদের।
জানা গেছে, কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার দামপাড়া নোয়ারহাটি, টেকপাড়া ও বর্মণপাড়া হাতপাখার গ্রাম বলে পরিচিত। হাতপাখা তৈরি করেই স্বাবলম্বী অধিকাংশ পরিবার। বাড়ির কাজের পাশাপাশি হাতপাখা তৈরি করে থাকে গ্রামের নারীরা। স্কুলের অবসরে শিশু-কিশোররাও কাজ করে। প্রতি বছরের চৈত্র, বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসে তালপাখার চাহিদা বেড়ে যায়। কেউ বাঁশ আনছে, কেউ বুনছে, কেউ করছে রঙ, আর নারীরা তাতে ফুটিয়ে তুলছে বাহারি রকমের ডিজাইন। তালপাখা, বাঁশের পাখা ও সুতার পাখা তৈরি করে তারা। কারিগররা সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বাড়ির উঠানজুড়ে দল বেঁধে হাতপাখা তৈরির কাজ করে।
গত রবিবার সরেজমিন দামপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, তালপাখা বানানোর জন্য কেউ তালপাতা আনছে, এনে শুকিয়ে নির্দিষ্ট মাপে কেটে নিচ্ছে, কেউ বুনছে, কেউ চক্রাকার ছাঁচের চারদিকে জালি বেত ঘুরিয়ে এর ওপর প্লাস্টিকের রিবন প্যাঁচাচ্ছে, আর নারীরা তাতে ফুটিয়ে তুলছে বাহারি রকমের ডিজাইন। আর এ কাজগুলো করা হচ্ছে বাড়ির উঠানে দল বেঁধে। বাজারে নিয়ে বিক্রি করে পুরুষরা। পাইকারি দরে একটি পাখা বিক্রি হয় ৭০ থেকে ৯০ টাকায়। গরমের দিনে অল্প দামের এ পাখাতেই গ্রামীণ মানুষের আস্থা। তবে এ তিন মাসের তালপাখার বাজার কেন্দ্র করে কারিগরদের ব্যস্ততা থাকে বছরের অন্য সময়ও।
দামপাড়ায় গিয়ে দেখা যায় বাড়ির সামনে গাছের ছায়ায় বসে অনু নামে এক যুবক বাবা-মাকে নিয়ে কাজ করছেন। অনু নিজে কারিগর। একই সঙ্গে তালপাতার পাখার পাইকারি ব্যবসাও করেন। তিনি জানান, ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, থেকে পাইকাররা আসেন। বিভিন্ন ওরস, মেলায় এসব পাখা বিক্রি করেন তারা। অনু আরও বলেন, প্রতি ঘরে এক মৌসুমে কমপক্ষে ২ লাখ তালপাতার পাখা তৈরি করা হয়। আর ডাঁটা পাখা আরও এক-দেড় লাখ পিস করা হয়। অর্থের মূল্যে একেকটি ঘরে প্রতি সিজনে অন্তত ৫ লাখ টাকা আয় হয়। খরচ অর্ধেক। বাকিটা লাভ।
গ্রামের পপি সূত্রধর (৯২) বলেন, ‘৭০ বছর ধরে আমরা হাতপাখা তৈরির কাজ করতাছি। তালপাখা বানানো হয়। গাছ থেকে তালপাতা এনে শুকিয়ে নির্দিষ্ট মাপে কেটে নিতে হয়। এরপর বেতির মতো করে এগুলো দিয়ে বুনন করে ছাঁচ তৈরি করা হয়। চক্রাকার ছাঁচের চারদিকে জালি বেত ঘুরিয়ে এর ওপর প্লাস্টিকের রিবন প্যাঁচানো হয়। পাখার হাতল বানানো হয় মোড়ল বাঁশ কেটে ফালি করে। এরপর সেলাই করা হয় নাইলন সুতা দিয়ে। হাতলে প্লাস্টিকের সুরু পাইপ কেটে চুঙ্গি দেওয়া হয়। এভাবেই তৈরি হয় হাতপাখা।’
হাতপাখার কারিগর লক্ষ্মীরানী বলেন, ‘সংসারের কাজের পাশাপাশি হাতপাখা তৈরি করি। এভাবে আমাদের কিছু আয় হয়। এতে সংসারে উন্নতি হয়েছে। আমরা মহিলারা পাখা বানাই আর পুরুষরা সে পাখা বিক্রি করে। আমরা এ গ্রামের সবাই এ পেশার সঙ্গে জড়িত।’
ক্রেতা শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘একদিকে গরম অন্যদিকে ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে জীবন অতিষ্ঠ। হাতপাখার দাম কিছুটা বেড়েছে। আগে ৫০-৬০ টাকায় পাওয়া যেত। এখন ৮০ থেকে ১০০ টাকায় কিনতে হয়। তবে হাতপাখায় স্বস্তি পাওয়া যায়।’
হাতপাখা কারিগর ললিতা রায় (৯৮) বলেন, ‘৭০ বছর ধরে এ গ্রামে তালপাখা তৈরি হচ্ছে। ১৬ বছর বয়সে আমার বিয়ে হয়। শাশুড়ির হাত ধরে তালপাখা তৈরির কাজ শিখেছি। ’৭১ সালে এ গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ করে। তহন আমাদের অনেকের স্বামীরে মাইরা ফালায়। আমরা বিপদে পইড়া যাই। তহন কী করে চলব। এ কাজ করেই আমরার সংসার চালায়া যাইতাছি। এখন আমার পুতের বউ, নাতিরাও এ কাজ করে।’
লক্ষ্মীরানী নামে আরেক কারিগর বলেন, ‘এ হাতপাখা তৈরি করেই আমাদের সংসার চলে। অনেকেই আগের থেকে এ কাজ করতাছে, আমি ৪৫ বছর ধইরা করতাছি। আমার এক মেয়ে বিয়ে দিয়েছি। দুই মেয়ে পড়ালোখার পাশাপাশি আমার কাজে সহযোগিতা করছে। এদের নিয়ে অনেকটাই ভালো আছি।’
স্কুল শিক্ষার্থী লিয়াচন্দ্র দেবনাথ বলে, ‘পড়াশোনার পাশাপাশি পাখা তৈরির কাজ করি। গরমে স্কুল বন্ধ, সেজন্য আমাদের মা-পিসিদের সঙ্গে বসে আমরা পাখা তৈরি করি; যা আয় হয় তা দিয়ে আমাদের হাতখরচের টাকা হয়ে যায়।’
গ্রামে তালপাখা তৈরির কাজটা করেন মূলত নারীরা। পুরুষরা শুধু সরঞ্জাম এনে দেন। বাড়ির শিশুরা উঠানে বসে নারীদের হাতপাখা তৈরির কাজে সহযোগিতা করে। পাকিস্তান আমল থেকে এখানকার কারিগররা হাতপাখা তৈরি করে জীবিকা চালিয়ে যাচ্ছে। এ গ্রামগুলোয় কিশোর-তরুণরা পাখা তৈরির পেশা বেছে নিচ্ছে।
ক্রেতা নুর ইসলাম বলেন, ‘গরম আর লোডশেডিং দুটোতেই মানুষ অতিষ্ঠ। লোডশেডিংয়ে চার্জার ফ্যানও কাজ করে না। সেজন্য হাতপাখাই এখন ভরসা। হাতপাখার বাতাস অনেক ঠান্ডা।’
তালপাখা তৈরির কারিগর ও বিক্রেতা পলাশ সরকার বলেন, ‘আমরা বাপদাদার আমল থেকে হাতপাখা তৈরির কাজ করছি। গরম কম হোক আর বেশি, এটা আমাদের পেশা। ব্যবসা আর টুকটাক কৃষির পাশাপাশি আমাদের গ্রামের সবাই এ পেশায় জড়িত। সবাই আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় আমরা পাখাগুলো পাঠাই।’
দামপাড়া গ্রামের ইতিহাস জানতে চাইলে প্রায় ৯০ বছর বয়সি চন্দ্র দেবনাথ বলেন, ‘গল্প আর কী বলব! বাপদাদারা বানিয়েছে। আমরাও বানাচ্ছি। আগে একটা পাখা বিক্রি হয়েছে ২ আনা, ৪ আনায়। এখন বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়। ৬ হাজার টাকা পাইকারি দর।’
হাতপাখা বিক্রেতা গোপাল রায় জানান, প্রতি বছর গরমে বিভিন্ন হাটবাজারে হাতপাখা বিক্রি করেন তিনি। এ বছর বেশি বিক্রি হয়েছে। লোডশেডিং আর প্রচণ্ড গরমের কারণে শহর-গ্রাম সর্বত্রই হাতপাখার কদর। তবে শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিং বেশি হওয়ায় গ্রামগঞ্জে হাতপাখার কদর বেশি। গরমের কারণে বেড়েছে হাতপাখার চাহিদা। বাজারে নানা ধরনের হাতপাখার বিক্রি বেড়েছে। যেমন তালপাতার পাখা, রঙিন সুতার পাখা, রঙিন কাপড়ের পাখা মিলছে ১০০-১২০ টাকায়।
কিশোরগঞ্জ জেলা বিসিক কার্যালয়ের সহকারী মহাব্যবস্থাপক কর্মকর্তা মোহাম্মদ রাকিবুর রহমান খাঁন বলেন, ‘নিকলী উপজেলার দামপাড়া নোয়ারহাটি, টেকপাড়া ও বর্মণপাড়া গ্রামের সব পরিবার তালপাতা দিয়ে হাতপাখা তৈরি করে। এটা একটা কুটিরশিল্প। এখন যে গরম এ সময় হাতপাখার চাহিদা অনেক। তাদের মূলধনের প্রয়োজন হলে আমাদের সরকারি সহায়তা নিয়ে তাদের পাশে আছি। এর আগেও আমরা সেখানে ঋণ দিয়েছি। এ ছাড়া আমাদের নীতিমালার মধ্যে থেকে যতটুকু সম্ভব করা হবে।’