× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

প্যারেন্টিং ভাবনা

গতিময় সময়ে সন্তানের বেড়ে ওঠা

নাশমিন নাহীন

প্রকাশ : ০৮ মে ২০২৪ ১২:৩৯ পিএম

আপডেট : ০৮ মে ২০২৪ ১২:৪৮ পিএম

সন্তান লালন-পালনে মূল্যবোধের দৃষ্টিভঙ্গি বদলের সময় এসেছে। শিল্পকর্ম : রফিকুল নবী

সন্তান লালন-পালনে মূল্যবোধের দৃষ্টিভঙ্গি বদলের সময় এসেছে। শিল্পকর্ম : রফিকুল নবী

সন্তান লালনপালনে স্মার্ট প্যারেন্টিং চর্চার বিষয়টি বর্তমানে জনপ্রিয়তা পেলেও বিষয়টির গভীরে গিয়ে চিন্তা ও অনুধাবনের ক্ষেত্রে উদাসীনতার পরিচয় আমরা দিয়ে থাকি। আমাদের দেশে পুরুষের পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও, বাড়ির চৌহদ্দি পেরোলেই সন্তান লালন-পালনে জেন্ডার রোল অপরিবর্তিতই রয়ে যায়। এহেন মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতার গ্যাঁড়াকলে মা-বাবারা প্রগতিশীল ও মূল্যবোধের প্যারেন্টিং ধারণা সমর্থন করলেও বাস্তবে তা পালন করার সুযোগ পান খুব কম।

মা-বাবার আত্মত্যাগ মহিমান্বিত করে শিশুকে অসাধারণ মানুষ হিসেবে বেড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাদের কর্মযজ্ঞ, চিন্তা ও পরিশ্রম সফল করার ক্ষেত্রে মূল্যবোধের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে খুব উচ্চবাচ্য হতে দেখা যায় না। পারিবারিকভাবে দীর্ঘদিনের চর্চিত বিষয়গুলো ঠিক-বেঠিকের যেমন ধার ধারে না তেমন অন্যায্য দাবিগুলো মেটাতে গিয়ে আমরা যে আমাদের শিশুর জন্য একটি বৈষম্যময় ও মূল্যবোধহীন পরিমণ্ডল তৈরি করছি তাও কিন্তু দৃষ্টি এড়িয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের একটি নতুন প্রজন্ম কর্মজীবী মায়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে এবং নতুন শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় স্মার্ট প্যারেন্টিংয়ের কোনো বিকল্প নেই। তাই অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্যারেন্টিং চর্চার ক্ষেত্রে ইতিবাচক মূল্যবোধের দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগের সময় এসেছে। শিশুদের নৈতিক মূল্যবোধ তৈরির ক্ষেত্রে ছোট থেকেই সহায়ক পরিবেশ গড়ে তোলায় মা-বাবাদের অগ্রগণ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে।

দূরদূরান্তের কথা দিয়েই শুরু করা যাক। বিনয়ী আচরণকে পৃথিবীর অনেক দেশেই গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, এদের মধ্যে ডাচরা অন্যতম। সারা বিশ্বে নৈতিক মূল্যবোধের ভিত গঠনে অল্প বয়স থেকে শিশুদের বিনয়ী হওয়ার শিক্ষা দেওয়া হয়। আমাদের মধ্যে একটা প্রচলিত ধারণা সব সময় কাজ করে যে, অতিরিক্ত প্রশংসা করলে মানুষের মধ্যে বিনয়ী আচরণের মূল্যবোধটি নষ্ট হয়ে যায়। এ কারণে শিশুকাল থেকে প্রশংসার বদলে সমালোচনা করা হয় বেশি। 

কিন্তু আমরা সরাসরি সমালোচনা না করে শিশুদের গঠনমূলক পরামর্শ দিতে পারি। কারণ সমালোচনার নেতিবাচক প্রভাব কিন্তু সুদূরপ্রসারী। সারা বিশ্বের কাছে ডাচরা অত্যন্ত বিনয়ী জাতি হিসেবে পরিচিত এবং বিনয় আচরণকে তারা তাদের জাতীয় মূল্যবোধের অংশ বলে মনে করে। শিশুদের ক্ষেত্রে, আমরা যা বলে থাকিÑশিশুটির সমালোচনা না করে কাজের প্রশংসা করা এবং শিশুদের আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য তাদের সামনেই আমরা প্রশংসা করে থাকি। তবে ডাচরা প্রশংসার বিষয়টিকে ভিন্নভাবে দেখে। শিশুদের বিনয়ী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তারা প্রশংসাটা একটু ভিন্নভাবে করে থাকে; যা আজ সারা বিশ্বে প্যারেন্টিং চর্চায় অনুসরণীয়।

ডাচরা মনে করে শিশুর প্রশংসা করা মানে এই নয় যে, আমরা আমাদের সন্তানদের সব সময়ই প্রশংসা করব, সব ইতিবাচক কাজের প্রশংসা করব। ডাচ মা-বাবারা শিশুদের সরাসরি প্রশংসা না করে বরং ভালো কাজটি নিরন্তর চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। ডাচ মা-বাবারা সব সময়ই শিশুদের পরিশ্রমের মাধ্যমে কোনো কিছু অর্জনের প্রতি উৎসাহিত করে থাকেন। ছোট থেকেই ডাচ শিশুরা জানে, তাদের পরিশ্রমের মাধ্যমে সবকিছু অর্জন করতে হবে। তাই দেশটির পারিবারিক পরিমণ্ডলে শিশুর সামনে অতিরিক্ত প্রশংসার স্তুতিবাক্য ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখা হয়। পরিশ্রম করা, কাজটিতে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে লেগে থাকার পরামর্শকে ডাচ শিশুরা অনুপ্রেরণাদায়ক মনে করে।

তাই ডাচ মা-বাবারা শিশুর আঁকা ছবি দেখলে কেবল ছবিটির প্রশংসা না করে শিশুকে সেই ছবিটি নিয়ে নানাবিধ প্রশ্ন করেন, ছবিটি নিয়ে কথা বলতে এবং ভাবতে উৎসাহিত করেন এবং ছবিটি আঁকার জন্য শিশুটিকে ধন্যবাদ জানানো হয়। শিশুর অতিরিক্ত প্রশংসা না করে কাজটিতে আরও ভালো করার জন্য তাদের উৎসাহিত করা হয়। শিশুকে কাজের প্রতি মনোযোগী হওয়ার পরামর্শের পাশাপাশি বিনয়ের সঙ্গে বোঝানো হয়, তাকে সফল হতে হলে আরও পরিশ্রম করতে হবে। তাদের প্রতি মা-বাবার এ ধরনের আচরণ শিশুকে অনুপ্রেরণা প্রদানের পাশাপাশি সহনশীল ও ধৈর্যশীল হতে সাহায্য করে। সাম্প্রতিক গবেষণায় এটি প্রমাণিত হয়েছে যে, আমরা আমাদের শিশুদের যেভাবে প্রশংসা করি তার ওপর ভিত্তি করে তাদের সহনশীলতার মাত্রা গড়ে ওঠে এবং অতিরিক্ত ও অপ্রয়োজনীয় প্রশংসা শিশুদের মধ্যে সহনশীলতা তৈরি হতে বাধা দেয়।

অনুরূপভাবে জাপানিজ মা-বাবারা শিশুদের ধৈর্য ও সহনশীলতার মূল্যবোধটি ভালোভাবে রপ্ত করতে সাহায্য করে থাকেন। যেকোনো কাজে লেগে থাকার প্রবণতা তৈরিতে জাপানিজ মা-বাবারা শিশুদের অনুপ্রাণিত করেন। তাই প্রশংসা ও সমালোচনার থেকে যেকোনো কাজে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করার ব্যাপারে জাপানিজরা বেশি আগ্রহী। আর এ ধরনের প্যারেন্টিং চর্চাকে জাপানিজ ভাষায় বলা হয় ‘মেনবোকু’। এজন্য শিশুদের ছোট থেকে বয়োজ্যেষ্ঠদের সংস্পর্শে রাখা হয় যাতে তাদের প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার আলোকে শিশুরা নিজেদের জীবন সাজানোর ক্ষেত্রে অনুপ্রাণিত হতে পারে। বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনকে জাপানে উচ্চমাত্রার মূল্যবোধ হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং শিশুরা ছোট থেকেই এ মূল্যবোধটি ধারণ করতে শেখে।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে শিশুদের সামনেই তাদের অগাধ প্রশংসা করা হয়। সে দেশের অভিভাবকরা মনে করেন, সরাসরি প্রশংসা শিশুদের আত্মবিশ্বাস ও আত্মোন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। শিশুকে যদি তার স্মার্টনেস ও বুদ্ধিমত্তার জন্য প্রশংসা করা হয় তাহলে তার মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি হয় এবং নতুন কিছু শেখার প্রেরণা দেয়। এ বিপরীতধর্মী চর্চা দেশটিতে দীর্ঘদিন ধরে হয়ে আসছে এবং অনেক ক্ষেত্রে এটি শিশুর নৈতিক চরিত্র গঠনে ইতিবাচক ভূমিকাও পালন করে এসেছে। কিন্তু তিন দশকের গবেষণার ভিত্তিতে স্টেনফোর্ডের মনোবিজ্ঞানী ক্যারল এস. ডিউইক সরাসরি এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন।

এই মার্কিন মনোবিজ্ঞানীর গবেষণা অনুযায়ী, শিশুকে আমরা তার সহজাত মেধা ও বুদ্ধিমত্তার জন্য যদি সব সময় প্রশংসা করে থাকি তাহলে তাদের মধ্যে কাজ করার স্পৃহা কমে যায়; যা শিশুকে আরও ভালো অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার মনোভাব তৈরিতে বাধা দেয়। সব সময় প্রশংসা পাওয়া শিশুদের মধ্যে ঝুঁকি নিয়ে নতুন কিছু করার প্রবণতা থাকে না। তারা তাদের ‘স্মার্ট’ খেতাবটি ধরে রাখতে বেশি সচেতন থাকে এবং সফল হওয়ার জন্য সবচেয়ে সহজ পথটি বেছে নেয়। তাদের মনমানসিকতা একটি গণ্ডিতে আটকে থাকে। 

অন্যদিকে যে শিশুদের আরও এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রতিনিয়ত উৎসাহিত করা হয় এবং নিজেকে গড়ে তোলার জন্য আরও পরিশ্রম করতে বলা হয়, তারা সামনে এগিয়ে যায়। এরা সফলতার জন্য সবচেয়ে কঠিন, সৃজনশীল পথটি বেছে নিতে চায়। ডিউইকের রিসার্চে আরও বেরিয়ে আসে যে, এ ধরনের সৃজনশীল শিশুদের গ্রোথ মাইন্ডসেটের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন বলা হয়। এ গোত্রের শিশুদের শেখার প্রতি আগ্রহ থাকে অনেক। এরা অন্যের কাছ থেকে নিজেদের প্রশংসা শোনার থেকে কাজের মাধ্যমে নতুন কিছু শেখার প্রতি বেশি আগ্রহী হয়। এ ধরনের শিশুরা তাদের ব্যর্থতাকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে এবং চেষ্টার মাধ্যমে পরবর্তীতে তাদের সীমাবদ্ধতাগুলো কাটিয়ে তুলে সফলতা অর্জনের জন্য ক্রমাগত চেষ্টা করে থাকে।

জীবনব্যাপী সফলতা অর্জনের মূল চাবিকাঠি হিসেবে গবেষকরা গ্রোথ মাইন্ডসেটকে বিবেচনা করে থাকেন। কেউ যদি সব বাধাবিপত্তি থাকা সত্ত্বেও প্রতিনিয়ত শেখার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যায় তাহলে সে হচ্ছে প্রকৃত স্মার্ট ও বুদ্ধিমান। গ্রোথ মাইন্ডসেটের শিশুরা প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালিয়ে যাওয়াকে নিজের বুদ্ধিমত্তার বহিঃপ্রকাশ মনে করে। এ ধরনের শিশুরা মনে করে, মেধা ও বুদ্ধিমত্তা হলো সেটাই যা প্রতিনিয়ত চর্চা ও কাজের মাধ্যমে অর্জন করা যায়। তাই মা-বাবা হিসেবে শিশুর মেধার বিকাশে তাকে প্রতিনিয়ত নতুন কিছু শেখার সুযোগ দিতে হবে, প্রতিটি কাজে তাকে শেখার বিষয়ে উৎসাহ দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ও নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ তথা মানব সৃষ্টির প্রতি মমত্ববোধ জাগ্রতকরণের জন্য অক্লান্তভাবে শিশুর সঙ্গে কাজ করে যাওয়াই হবে মা-বাবার মূল ব্রত। আর এ প্রচেষ্টাই হবে শিশুর প্রতি সবচেয়ে ফলপ্রসূ ও কার্যকর বিনিয়োগ; যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।

লেখক : ইসিডি প্র্যাকটিশনার ও প্যারেন্টিং কোচ, ব্র্যাক আইইডি, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা