নুসরাত খন্দকার
প্রকাশ : ০৭ মে ২০২৪ ১৮:৩৪ পিএম
মডেল : দেবাশীষ রঞ্জন ও বিথী রানী; মেকআপ : শোভন মেকওভার; ছবি : ফারহান ফয়সাল
একই সঙ্গে সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্যের বিষয় আমাদের একজন রবীন্দ্রনাথ আছেন। সৌভাগ্যÑ তিনি কবিতা, গান, সাহিত্য, শিক্ষা, দর্শনসহ বিবিধ ক্ষেত্রে বাংলা ও বাঙালির একটা মান তৈরি করে দিয়েছেন। আর দুর্ভাগ্য- শত বছর পেরিয়ে গেলেও আমরা এখনও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৌঁছে দেওয়া সেই মানরেখাকে অতিক্রম করতে পারছি না। সাহিত্য ছাড়াও আমাদের রাষ্ট্রভাবনা, দর্শন, শিক্ষা রবীন্দ্র প্রভাব বলয়ে আবর্তিত। এমনকি আমাদের দৈনন্দিন জীবনাচরণ- হাসি-আনন্দ, দুঃখ-বেদনার মানসপটে রবীন্দ্রনাথ আপন মহিমায় ভাস্বর।
ছোটবেলায় মায়ের কাছে জাতীয় সংগীতের একটা শব্দের অর্থ জানতে গিয়ে সেই যে চোখে জল এলো, তা এখনও বয়ে বেড়াই। ‘মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা আমি নয়নজলে ভাসি।’
আচ্ছা, বদন মানে কি?- স্কুল অ্যাসেম্বলিতে জাতীয় সংগীত গাইতে গাইতে হঠাৎ জাগা প্রশ্নটা বাড়ি ফিরে মাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘মুখ’। পরক্ষণেই মা তার দুই হাতের তালুর ভেতরে আমার মুখটা নিয়ে বলেন, ‘পুরোটা মুখ’। আর মলিন অর্থ? ম্লান, শুকনো, দুঃখে ভার। মায়ের মুখ মলিন হলে আমার চোখে তো পানি আসবেই। সেই থেকে যখন যেখানেই জাতীয় সংগীত বাজে, আমার চোখ সজল হয়। পরে দেখেছি, শুনেছি, পড়েছি আমার মতো অনেকেরই হয়। কারও প্রকাশ্যে, কারওবা গোপনে। কিন্তু হয়, আর এভাবেই গানের সুরে, চোখের চোখের জলে রবীন্দ্রনাথ ঢুকে পড়েন আমাদের হৃদয়ে।
ঘুম থেকে উঠে আলো ঝলমলে একটা দিনের সূচনা দেখলে মনের অজান্তেই কখন যেন মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, ‘আজি এ প্রভাতে রবির কর/ কেমনে পশিল প্রাণের পর/ কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাত পাখির গান-’ কিংবা গুনগুনিয়ে সুর তুলি, ‘এ দিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার?/ আজি প্রাতের সূর্য ওঠা সফল হল কার?।’
আবার যখন সংকটে, সংকোচে দুঃসময় দানা বেঁধে আসে, তখন আমাদের কণ্ঠে আপনাতেই বেজে ওঠে-‘সঙ্কোচেরও বিহ্বলতা নিজেরই অপমান।’ কিংবা স্বগতোক্তির মতো উচ্চারিত হয়, ‘তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,/ এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।’ প্রকৃতি বন্দনা বা নিজেকে সমর্পণে রবীন্দ্রনাথ ছাড়া উপায় কি বলুন। এত কাছের, এত আপন করে আর কে ছুঁয়ে যায় সমগ্র তনু-মন?
রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা ও সংকটের প্রতিনিধিত্ব করে। তার লেখার অন্তর্গত ভাবনা সমাজকে নতুন করে বিবেচনার সুযোগ দেয়। তারুণ্যকে প্রেরণা দেয় নতুন করে বাঁচার। সেখানে কবি গেয়ে ওঠেন, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে।’ আমরাও আশায় বুক বেঁধে পা বাড়াই অজানায়।
রবীন্দ্রনাথের কবিতা বা গানের স্বতঃস্ফূর্ত স্রোতধারা মানবজাতির সম্পর্ক; প্রকৃতির সাথে সম্পর্ক, ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কে গিয়ে মেশে। স্পর্শ করে আমাদের শেকড়ে। নতুন পথ পা বাড়িয়ে গেয়ে উঠি, ‘চেনাশোনার কোন বাইরে/ যেখানে পথ নাই নাই রে/ সেখানে অকারণে যায় ছুটে।।’ সেখানে প্রকৃতির উপমায় ব্যক্তি বা সামষ্টিক চাওয়া লীন হয়ে যায়। তাই তো নানা সময়, নানা ধারার বাধার পরেও রবীন্দ্রনাথের গান, কবিতা আমাদের জীবন ও সংস্কৃতির অংশ হিসেবে রয়ে গেছে; হয়েছে বাংলা সংস্কৃতির অবিচ্ছিন্ন অংশ। বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন, আত্মবিশ্বাস তৈরিতে শক্তি জুগিয়েছে।
সংখ্যার দিক থেকেও রবীন্দ্রনাথের লেখা বিস্তার দিগন্তছোঁয়া। এই সৃষ্টিপ্রাচুর্যের মধ্যেই প্রতিফলিত রয়েছে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সৃজনকৌশল এবং ব্যক্তিজীবনের নানামাত্রিক ঘোর। জাগে স্বপ্ন, ‘দূরে বহুদূরে/ স্বপ্নলোকে উজ্জয়িনীপুরে/খুঁজিতে গেছিনু কবে শিপ্রানদীপাড়ে/মোর পূর্বজনমের প্রথমা প্রিয়ারে।’ সমাজে নারী-পুরুষ সম্পর্ক, প্রেম, ভালোবাসা, বিচ্ছেদ; পার্থিব নানা সুখ-দুঃখ-কষ্ট। রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রবীন্দ্রসাহিত্যে অন্তর্নিহিত রহস্যময় আলোকরশ্মি তার সৃষ্টির গভীরতা নির্দেশক। এজন্য রবীন্দ্রসাহিত্য পাঠে পাঠক যেমন অমেয় রসের সন্ধান পান; তেমনি গবেষকরা খুঁজে পান নতুনতর মৌলতথ্য। আর আমরা কবির পঙক্তিই কবিকে নিবেদন করে বলি, ‘আমার জীবনপাত্র উচ্ছলিয়া মাধুরী করেছ দান—/তুমি জান নাই, তুমি জান নাই,/তুমি জান নাই তার মূল্যের পরিমাণ।’
বাঙালির চিন্তা, চেতনা, মনন ও রুচির সৃষ্টিশীলতা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দর্শন, তত্ত্বীয় সত্তা প্রকাশে বাংলাসাহিত্য সংস্কৃতির প্রত্যেক পরতে পরতে রবীন্দ্রনাথ রেখেছেন অবিস্মরণীয় ভূমিকা। তার কাজের মাধ্যমে বাঙালি সংস্কৃতি খুঁজে পেয়েছে নতুন আলোর রেখা। যে আলোর রেখা এখনও সম্প্রসারিত। যা বাংলার মানুষের মানসিক বিকাশকে ঋদ্ধ করেছে। তাই তো ২৫ বৈশাখ এলেই মন আপন মনে গেয়ে ওঠে-
‘হে নূতন
দেখা দিক আর-বার
জন্মের প্রথম শুভক্ষণ
তোমার প্রকাশ হোক
কুহেলিকা করি উদঘাটন
সূর্যের মতন
তোমার প্রকাশ হোক
কুহেলিকা করি উদঘাটন
সূর্যের মতন।’