× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

সিজারের ভয়ে হাসপাতাল বিমুখ নিম্নবিত্ত নারীরা

ফারহানা বহ্নি

প্রকাশ : ০৪ মে ২০২৪ ০৮:৫৫ এএম

আপডেট : ০৪ মে ২০২৪ ০৮:৫৯ এএম

সিজারের ভয়ে হাসপাতাল বিমুখ নিম্নবিত্ত নারীরা

অস্ত্রোপচার (সিজারিয়ান সেকশন বা সি সেকশন) এড়িয়ে স্বাভাবিকভাবে সন্তান জন্ম দিতে চেয়েছিলেন সাফজয়ী নারী ফুটবলার রাজিয়া সুলতানা। কিন্তু বাসায় সন্তান প্রসবের পাঁচ ঘণ্টা পর জীবন থেকেই বিদায় নিলেন তিনি। তার করুণ মৃত্যু দেশের মানুষকে ব্যথিত করেছে। অস্ত্রোপচারে শিশুর জন্ম হলে দ্রুত খেলায় ফিরতে পারবেন না, এই ভয় ছিল রাজিয়ার। ফলে হাসপাতালে যেতে চাননি তিনি। 

শুধু রাজিয়ার ঘটনা নয়, দেশে একদিকে যেমন অস্ত্রোপচারে সন্তান জন্মদানের ঘটনা বাড়ছে। অন্যদিকে শুধু এই অস্ত্রোপচারের ভয়েই হাসপাতালবিমুখ হচ্ছেন নিম্নবিত্ত নারীরা। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সন্তান জন্মদানে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারও বেড়েছে। এক্ষেত্রে অভিযোগের তীর মুনাফালোভী কিছু বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক এবং চিকিৎসকের দিকে।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরে বাঁশবাড়ি বস্তিতে গাদাগাদি করে থাকেন নিম্ন আয়ের মানুষ। সরেজমিন দেখা যায়, সেখানেই আসমা আক্তার তার তিন সন্তান ও স্বামী নিয়ে সংসার পেতেছেন। তার তিন সন্তানেরই জন্ম হয়েছে বাসায় এবং কোনো চিকিৎসকের তত্ত্বাবধান ছাড়াই। তিনি মনে করেন, হাসপাতালে গেলে অযথা খরচ বাড়ে আবার নরমাল ডেলিভারি সম্ভব হয় না। তাছাড়া শ্বশুরবাড়ির লোকজনও মনে করেন বাসায় সন্তান প্রসব করাই ভালো। 

বস্তিতে ঘুরে দেখা যায়, অনেকেরই ধারণা হাসপাতালে গেলেই অস্ত্রোপচারে সন্তানের জন্ম দিতে হবে। এছাড়া হাসপাতালের ওষুধে বাচ্চা বড় কিংবা ওজন বেড়ে যায় বা ইচ্ছাকৃত সিজার করানো হয় বলেও মনে করেন অনেকে। ফলে সন্তানধারণে পুরো সময়ই অনেকে হাসপাতাল বা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন না। 

অন্তঃসত্ত্বা সোহেলি আক্তার এখনও ঠিক করতে পারছেন না কী করবেন। সময়ের সঙ্গে ভয় বাড়ছে। তবে তার মা চান সন্তান বাসাতেই হোক। তিনি বলেন, ‘আমরা তো বাসায় হয়েছি। সিজার হলে শরীরে নানা জটিলতা থাকে। সুস্থ হতেও সমস্যা হয়।’ হাসপাতালে গেলে বাচ্চা সিজারে হতে পারে বলে আশঙ্কা তার।

সিজারে সন্তান জন্ম দিলে দ্রুত কাজে ফিরতে পারবেন না বলে মনে করেন চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা কড়াইল বস্তির বাসিন্দা লিপি। পরিবারের আর্থিক অনটনে অল্প বয়সেই গার্মেন্টসে চাকরি শুরু করেন। স্বামীও একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। সংসারটা দুজনের আয়েই চলে। লিপি বলেন, ‘বাপ-মাকেও টাকা দিতে হয়। কাজ বন্ধ করলে খাব কী। যত তাড়াতাড়ি সুস্থ হওয়া যাবে ততই ভালো। সিজারে বাচ্চা হইলে তো কাম করা যায় না।’ 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রতিবেদন বলছে, দেশের ৬০ শতাংশ গর্ভবতী প্রসবপূর্ব সেবা পান না। দেশে এখনও ৩৩ শতাংশ প্রসব হয় বাড়িতে। বেশিরভাগ মায়ের মৃত্যুর কারণই অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ও সময়মতো হাসপাতালে না নেওয়া।

সিজারিয়ান সেকশন বা সি সেকশন এড়িয়ে যেতে অনেকেই বাসায় সন্তান প্রসব করাতে চান। অস্ত্রোপচারে সন্তান প্রসবে নানারকম জটিলতায় পড়তে হয় বলে মনে করেন নিম্ন আয়ের মানুষেরা। সংক্রমণসহ শারীরিক নানা জটিলতায় পড়তে হয় মায়েদের। চিকিৎসার খরচও বেড়ে যায়। তাদেরই একজন সুরভী, যার স্বামী পেশায় ফুচকা বিক্রেতা। গত বছর সিজারে সন্তান জন্ম দেন তিনি। তারপর এক মাস হাসপাতালে থাকতে হয়। তিনি বলেন, ‘সিজারের সময়ই প্রায় ৩০ হাজার খরচ হয়েছে। ইনফেকশন হওয়ায় আবার অনেক ওষুধ খেতে হচ্ছে। এত টাকার ব্যবস্থা করা কঠিন।’

সাভারের বাসিন্দা মরিয়ম বেগম বলেন, ছোট সন্তানের জন্মের পর বাসায় অশান্তি। বড়টা স্বাভাবিক হলেও পরেরটা সিজারে। ইনফেকশন ধরা পড়লে দীর্ঘদিন হাসপাতালে থাকতে হয়। অনেক টাকাও খরচ হয়। গার্মেন্টসে চাকরি করতেন, আবার যে কাজে ফিরবেন সে অবস্থাও নেই। সংসার এখন কেমন করে চলবে?

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ১০০ জনের মধ্যে ১৫ থেকে ২০টি শিশু সিজারে জন্ম নেওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলাদেশে গড়ে ১০০ জনের মধ্যে ৫১ প্রসূতি শিশুর জন্ম দিচ্ছেন অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে। সম্প্রতি বিবিএস জরিপেও বলা হয়েছে, বাংলাদেশে এক বছরে অস্ত্রোপচারে সন্তান প্রসব বেড়েছে ৯ শতাংশের বেশি। ২০২২ সালে ৪১ দশমিক ৪ থাকলেও ২০২৩ সালে অস্ত্রোপচারে সন্তান প্রসব বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ দশমিক ৭ শতাংশে। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে দেশে স্বাভাবিক প্রসবের হার ৫৮ দশমিক ৬ থাকলেও, ২০২৩ সালে হয়েছে ৪৯ দশমিক ৩। ২০২৩ সালে শহরে অস্ত্রোপচারে ৫৯ দশমিক ১ শতাংশ শিশুর জন্ম হয়েছে, যা আগের বছর ছিল ৫৩ শতাংশ। অবশ্য ২০২২ সালে বাড়িতে ৪২ দশমিক ৩১ শতাংশ শিশু জন্ম নিলেও, ২০২৩ সালে নেমে ৩২ দশমিক ৭৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

দেশে উদ্বেগজনক হারে সিজারে শিশু জন্ম নেওয়ার পেছনে চিকিৎসক ও রোগী দুপক্ষেরই অসচেতনতা রয়েছে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী। তিনি বলেন, সিজারে জন্ম নেওয়া শিশুদের ক্ষেত্রে সিজার অডিট করা উচিত। কোনো রকম কারণ ছাড়াই যদি সিজার করা হয় তবে সে ডাক্তারকে জবাবদিহির জায়গায় নিয়ে আসতে হবে। আর এ কারণসহ ব্যাখ্যা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েও পাঠাতে হবে। 

বেশি বয়সে মা হওয়া এবং বাল্যবিবাহ সিজারে শিশু জন্মের হার বৃদ্ধির একটি কারণ বলে জানান তিনি। এছাড়া অদক্ষ ডাক্তাররা দ্রুততার জন্য অস্ত্রোপচারে সন্তান প্রসব করান। অনেক মা-ই সিজারে সন্তান জন্ম দিতে চান স্বাভাবিক প্রসবে কষ্ট হবে ভেবে। অদক্ষ ডাক্তাররাও এর জন্য দায়ী।’

তিনি আরও বলেন, অপ্রয়োজনে সিজারে সন্তান জন্ম দিলে মায়ের নানারকম সমস্যা হয়। কাটাছেঁড়া করে বাচ্চা বের করা মানে হচ্ছে সেটা স্বাভাবিক না। এতে শারীরিক জটিলতা হবেই। অপ্রয়োজনীয় এই অস্ত্রোপচার কমিয়ে আনা জরুরি।

গত বছর এপ্রিলে প্রকাশিত বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপে (২০২২) দেখা গেছে, অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের বড় অংশ হচ্ছে বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালে। শিশু জন্মে যত অস্ত্রোপচার হচ্ছে, তার ৮৪ শতাংশ হচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। সরকারি হাসপাতালে হচ্ছে ১৪ শতাংশ। বাকি ২ শতাংশ এনজিও পরিচালিত কিছু স্বাস্থ্যকেন্দ্রে।

স্বাভাবিক প্রসবের জন্য প্রসূতিকে কাউন্সেলিং করা হয় না বলে মনে করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের অধ্যাপক ডা. রেজাউল করিম কাজল। তিনি বলেন, অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতালে এ নীতিমালা মানা হয় না। অস্ত্রোপচারে সন্তান প্রসব কমে গেলে ঢাকার বাইরের ৫০ শতাংশ ক্লিনিক বন্ধ হয়ে যাবে। আবার কোনো কোনো অন্তঃসত্ত্বার স্বজনের চাপেও হাসপাতাল সিজার করতে বাধ্য হয়। তাছাড়া স্বাভাবিক প্রসবের জন্য সরকারি হাসপাতালে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের জায়গা এখনও তৈরি হয়নি।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা