রাজবংশী রায়
প্রকাশ : ০১ অক্টোবর ২০২২ ১৫:০৫ পিএম
আপডেট : ০১ অক্টোবর ২০২২ ১৬:৫৮ পিএম
প্রতীকী ছবি : সংগৃহীত
সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক তেদ্রোস আধানম গ্যাব্রিয়েসুস করোনাভাইরাসের নতুন সংক্রমণের সংখ্যা সারা বিশ্বে নাটকীয়ভাবে হ্রাস পেয়েছে বলে জানান। ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘কোভিড-১৯ মহামারির ইতি টানতে বিশ্ব এর চেয়ে ভালো অবস্থানে আর কখনোই ছিল না। কিন্তু আমরা এখনো সেখানে পৌঁছাইনি। কিন্তু শেষ দেখা যাচ্ছে।’
গত ১৪ সেপ্টেম্বর তার দেওয়া বক্তব্যের ছয় দিনের মাথায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সে দেশের এক সংবাদমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র করোনা মহামারির সেই ভয়াল অধ্যায় পেরিয়ে এসেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজের প্রধান অ্যান্থনি ফাউসি ও বিরোধী রাজনৈতিক দল রিপাবলিকান পার্টির নেতারা বাইডেনের বক্তব্যের সমালোচনা করেন।
করোনাভাইরাস নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রধানের বক্তব্যের উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে। এক মাস ধরে সংক্রমণ বাড়ছে। চলতি বছরের ১ সেপ্টেম্বর থেকে নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ৫ শতাংশের ওপরে চলে যায়। আর এখন তা ১৫ শতাংশ ছুঁইছুঁই। করোনাভাইরাস নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দিকনির্দেশনা অনুযায়ী নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ৫ শতাংশের বেশি টানা ১৪ দিন থাকলে তা মহামারি হিসেবে বিবেচিত হবে। কিন্তু টানা এক মাসের বেশি সময় ধরে শনাক্তের হার ৫ শতাংশের বেশি রয়েছে বাংলাদেশে। সে হিসেবে বাংলাদেশে এখনো করোনাভাইরাস মহামারি চলছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গত এক মাসের রোগতাত্ত্বিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। আর গত এক সপ্তাহে মৃত্যুহারও বাড়তে শুরু করেছে। নমুনা পরীক্ষা, শনাক্ত, সুস্থতা ও মৃত্যু— এ চার সূচক বিবেচনায় নিয়ে আগের সপ্তাহের তুলনায় পরিবর্তনগুলো রোগতাত্ত্বিক পর্যালোচনায় স্থান পায়। এ হিসেবে ৪ সেপ্টেম্বর করা ৩৫তম রোগতাত্ত্বিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, আগের সপ্তাহের তুলনায় নমুনা পরীক্ষা বৃদ্ধি পায় ১৫ দশমিক ৬ শতাংশ। শনাক্তের হার বাড়ে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। এর বিপরীতে সুস্থতা হ্রাস পায় ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। একই সঙ্গে মৃত্যুও হ্রাস পায় ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ। ১১ সেপ্টেম্বর করা ৩৬তম রোগতাত্ত্বিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, নমুনা পরীক্ষা আগের সপ্তাহের তুলনায় শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ হ্রাস পায়। আর শনাক্তের হার ৪৭ দশমিক ২ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। সুস্থতা বাড়ে ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ। তবে মৃত্যুহার অপরিবর্তিত থাকে। ১৮ সেপ্টেম্বর করা ৩৭তম রোগতাত্ত্বিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, আগের সপ্তাহের তুলনায় নমুনা পরীক্ষা ৩ দশমিক ৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। শনাক্তের হার বাড়ে ২৮ দশমিক ৩ শতাংশ। সুস্থতাও বাড়ে ২৬ দশমিক ৭ শতাংশ। আর মৃত্যু হ্রাস পায় ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ। ২৫ সেপ্টেম্বর করা ৩৮তম রোগতাত্ত্বিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, নমুনা পরীক্ষা আগের সপ্তাহের তুলনায় ১০ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়েছে। আর শনাক্তের হার বাড়ে ৪৯ দশমিক ৫ শতাংশ। সুস্থতা বাড়ে ২০ দশমিক ৮ শতাংশ। কিন্তু মৃত্যু বাড়ে ১৮০ শতাংশ। চলতি সপ্তাহের রোগতাত্ত্বিক পর্যালোচনা আগামীকাল সোমবার প্রকাশ করা হবে।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতি সম্পর্কে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে করোনা মাহামারি শেষ হয়েছে বলে প্রেসিডেন্ট বাইডেন যে বক্তব্য দিয়েছেন তা সে দেশের সিডিসি খারিজ করে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংক্রমণ বাড়ছে। তারা টিকাকরণ ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। কোনো কোনো দেশে শীতকালে সংক্রমণ বাড়ে। তারা সেই সংক্রমণ মোকাবেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাংলাদেশে এক মাস ধরে সংক্রমণ বাড়ছে। ১ সেপ্টেম্বর শনাক্তের হার ৫ শতাংশ অতিক্রম করে। আর দুই সপ্তাহ ধরে শনাক্তের হার ১০ শতাংশের ওপরে রয়েছে। একই সঙ্গে মৃত্যুও বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রধানের বক্তব্যের সঙ্গে এ চিত্র মিলছে না। সুতরাং করোনা মহামারি শেষের পথে রয়েছে— এটি এখনই বলা যাবে না বলে মনে করেন তিনি।
টিকা ও স্বাস্থ্যবিধির ওপর গুরুত্ব দিতে হবে— মত বিশেষজ্ঞদের : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, করোনাভাইরাসের ওমিক্রনের চলমান উপধরনটি ততটা বিপজ্জনক নয়। আক্রান্তের অধিকাংশের সাধারণ ঠান্ডাজ্বরের মতোই কিছু উপসর্গ দেখা দেবে। সংক্রমণ কমবেশি ওঠানামা করবে। এর পরও সতর্ক থাকা প্রয়োজন। এ ভাইরাসকে সার্ভিল্যান্সের মধ্যে রাখা দরকার। কারণ নতুন কোনো বিপজ্জনক মিউটেশনে মোড় নেয় কি না দেখতে হবে। তবে টিকা নিতে হবে। একই সঙ্গে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। অন্যথায় পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, করোনাভাইরাস একেবারে নির্মূল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। এটা কোথাও বাড়বে, আবার কোথাও কমবে। করোনার পরিপূর্ণ আচরণ বুঝতে আরও সময় লাগবে। ২০২০ সাল থেকে একটি বিষয় লক্ষ্য করা গেছে, তা হলো করোনার ধরন পরিবর্তন। ইন্ডিয়ান ভ্য়ারিয়েন্ট ছিল বিপজ্জনক। এরপর ওমিক্রন ধরন এলেও সেটি ততটা বিপজ্জনক হয়নি। ওমিক্রনের কয়েকটি উপধরন শনাক্ত হলেও সেগুলোও বিপজ্জনক রূপ ধারণ করেনি। কিন্তু যাদের কোমরবিডিটি আছে এবং একই সঙ্গে বয়স্ক তাদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। সেই সঙ্গে নিয়মিত জিনোম সিকোয়েন্সিং করে ভাইরাসটি নজরদারিতে রাখতে হবে। এর মধ্য দিয়ে নতুন কোনো ধরন এলে তা শনাক্ত হবে এবং সে অনুযায়ী আগে থেকে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা যাবে। তবে টিকাকরণ ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। খারাপ কোনো ভ্যারিয়েন্ট তৈরি হচ্ছে কি না সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
প্রবা/টিকে/জেও/