আরমান হেকিম
প্রকাশ : ১৯ জুন ২০২৫ ০৮:৪৫ এএম
আপডেট : ১৯ জুন ২০২৫ ০৮:৫৮ এএম
দেশজুড়ে আবারও করোনা সংক্রমণ বাড়ছে। রাজধানীর বেশ কয়েকটি হাসপাতালে করোনা রোগী ভর্তির সংখ্যা হঠাৎ করে বেড়েছে। চিকিৎসকরা সতর্কবার্তা দিচ্ছেন। নতুন ঢেউ মোকাবিলায় জেলা পর্যায়ের হাসপাতাল প্রস্তুত নয়। অথচ এমন পরিস্থিতির জন্য পাঁচ বছর আগে যে ৬ হাজার ৩৮৭ কোটি টাকার ‘কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স ও প্যানডেমিক প্রিপারেডনেস’ প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল, তার বাস্তব চিত্র উদ্বেগজনক। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ পর্যায়ে এসে দাঁড়ালেও ৫০ জেলার জন্য পরিকল্পিত আইসিইউ, পেডিয়াট্রিক আইসিইউ, অবস-আইসিইউ কিংবা আইসোলেশন ইউনিটের সিংহভাগই অধরা থেকে গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতাধীন এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতি ৭৬ শতাংশ হলেও মূল অবকাঠামো নির্মাণ ও সেবাদানকেন্দ্রিক কাজ হয়েছে নগণ্য। সূত্র জানায়, ৫০টি জেনারেল হাসপাতালে মোট ৫০০টি আইসিইউ বেড স্থাপনের লক্ষ্য থাকলেও চালু হয়েছে মাত্র ১৩টি জেলার আইসিইউ। ১৬টি মেডিকেল কলেজ ও বিশেষায়িত হাসপাতালে পেডিয়াট্রিক আইসিইউ, ১৫টি হাসপাতালে অবস-আইসিইউ এবং ৫০টি জেনারেল হাসপাতালে ২০ শয্যার আইসোলেশন ইউনিট তৈরির কোনো বাস্তব অগ্রগতি নেই।
পরিকল্পনা কমিশনের আওতাধীন বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) হালনাগাদ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। বিশ্বব্যাংক ও এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংকের অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য ছিল করোনা ও ভবিষ্যতের সংক্রামক রোগ মোকাবিলায় দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে প্রস্তুত করা। বাস্তবতা হচ্ছেÑ এখনও জেলা হাসপাতালগুলোর অনেক আইসিইউ কাগজে থাকলেও বাস্তবে নেই, যেটুকু আছে সেটিও অচল।
উদাহরণ হিসেবে আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউ চালু হলেও সেখানে পর্যাপ্ত টেকনিশিয়ান, এক্স-রে মেশিন, পালস অক্সিমিটার, ভেন্টিলেটর সেন্সর নেই। যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালের আইসিইউ স্থাপন করা হলেও সেটি চালু করা যাচ্ছে না, কারণ ভবনের চতুর্থ তলায় আইসিইউ হলেও সেখানে কোনো লিফট নেই। টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে ২০২১ সালে আইসিইউ উদ্বোধন হলেও সেটি ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকেই বন্ধ। বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ চালু হলেও নেই নিজস্ব ডাক্তার, নেই স্ট্যান্ডবাই জেনারেটর, নেই রক্তের গ্যাস বিশ্লেষণের (এবিজি) যন্ত্র।
স্বাস্থ্য খাতসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, প্রকল্পটি শেষ হলেও প্রস্তাবিত অবকাঠামোগত সুবিধার বড় অংশ অপূর্ণ থেকে যাবে। এমনকি যে ৭৬ শতাংশ কাজ হয়েছে তার বেশিরভাগই ভোগ্যপণ্য, সুরক্ষাসামগ্রী ও কনসামেবল পণ্য ক্রয়সংক্রান্ত। রাজস্ব খাতে বরাদ্দ ৪ হাজার ৬৮৬ কোটি টাকার ৮৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ ব্যয় হলেও মূলধন খাতে ১ হাজার ৭০১ কোটি টাকার বিপরীতে খরচ হয়েছে মাত্র ৪০ দশমিক ৯৩ শতাংশ। অর্থাৎ নির্মাণ ও স্থায়ী অবকাঠামো খাতে খরচ কার্যত সীমিত।
আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গণপূর্ত অধিদপ্তরের দেরি, এলসি জটিলতা, ডলার সংকট, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়েছে। প্রকল্পটিতে ৭৬টি অডিট আপত্তি রয়েছে। ৪৬৫ কোটি টাকার অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। অযোগ্য ঠিকাদার নির্বাচন, দরপত্র নিয়ম ভঙ্গ, ট্যাক্স-ভ্যাট কর্তনে অনিয়ম, জরিমানা আদায় না করা, নিম্নমানের যন্ত্রপাতি গ্রহণসহ নানা অভিযোগ আছে।
আইএমইডি প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সাবেক প্রকল্প পরিচালকরা অনিয়মের বিষয়ে গণমাধ্যমের প্রশ্ন, দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধান ও মামলার চাপ সামলাতে গিয়ে প্রকল্পের মূল কাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। এতে প্রকল্পের কাজের স্বাভাবিক গতি নষ্ট হয়।
সূত্র জানায়, এই প্রকল্পে পাঁচ বছরে সাতজন প্রকল্প পরিচালক বদল হয়েছে। পূর্ণকালীন পরিচালক ছিলেন মাত্র দুজন। বাকিরা অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে কাজ করেছেন। কেউ কেউ দুই মাসের বেশি দায়িত্বে থাকেননি। প্রথম পরিচালক ড. ইকবাল কবীর দায়িত্ব পান ২ মাস ১৫ দিনের মতো। এরপর ড. কাজী শামীম হোসেন দায়িত্ব পান চার মাস। পদ পরিবর্তনের এই ধারা প্রকল্পের ধারাবাহিকতা নষ্ট করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সাইয়েদ আবদুল হামিদ বলেন, ‘এই প্রকল্পের পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে দেশের স্বাস্থ্য খাত ভবিষ্যতের সংক্রামক রোগ মোকাবিলায় প্রস্তুত হতো। কিন্তু দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় সেই লক্ষ্যপূরণ সম্ভব হয়নি। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে জেলা পর্যায়ের মানুষের। তাদের জন্য জরুরি স্বাস্থ্যসেবার প্রবেশাধিকার বাড়ানোর যে লক্ষ্য ছিল, তা পুরোটাই ব্যর্থ হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকার বাইরের মানুষের জন্য আইসিইউ, আইসোলেশন জরুরি ছিল। এসব সুবিধা না থাকায় আবার রাজধানীমুখী রোগীর চাপ বাড়বে, যা সামলানো কঠিন হবে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, দায়িত্বে নিয়োজিত প্রকৌশলী ও ঠিকাদার নিয়োগে রাজনৈতিক চাপ ছিল। অনেক ক্ষেত্রেই অযোগ্য ঠিকাদার কাজ পেয়েছেন, যারা স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্পের সঙ্গে অভ্যস্ত ছিল না। এসব কারণে নির্মাণ দেরি হয়েছে।
আইএমইডির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সরবরাহকৃত অনেক যন্ত্রপাতির মান যাচাই করা হয়নি। ডাইরেক্ট প্রকিউরমেন্ট পদ্ধতির অপব্যবহার, অযোগ্য প্রতিষ্ঠানে কাজ দেওয়া, আয়কর-ভ্যাট যথাযথভাবে কর্তন ও সরকারি কোষাগারে জমা না দেওয়ার মতো অনিয়ম ধরা পড়েছে। এমনকি নির্দিষ্ট সময়ে সরঞ্জাম না দেওয়া হলেও ঠিকাদারদের জরিমানা আদায় করা হয়নি।
বিশ্লেষকদের মতে, এখনও প্রকল্পের অব্যবহৃত টাকার পরিমাণ কয়েক হাজার কোটি টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ জুনেই শেষ হচ্ছে। এসব টাকা ব্যয় না হলে প্রকল্পের মূল লক্ষ্যÑ করোনা বা ভবিষ্যতের মহামারির জন্য প্রস্তুতি অধরাই থেকে যাবে। আর নতুন করে করোনা সংক্রমণ বাড়তে থাকায় স্বাস্থ্য খাতের এ ধরনের ব্যর্থতা আরও বড় ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।