× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

সরকারি হাসপাতাল

কিডনি রোগে আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা নিয়ে বিপাকে অভিভাবকরা

ফারহানা বহ্নি

প্রকাশ : ১৬ মার্চ ২০২৫ ১১:১২ এএম

গ্রাফিক্স : প্রবা

গ্রাফিক্স : প্রবা

আট বছরের শিশু সোহানা। ফেব্রুয়ারি মাসে তার কিডনিতে জটিলতা ধরা পড়ে। চিকিৎসকরা জানান ডায়ালাইসিসের কথা। সরকারি হাসপাতালে শিশুদের ডায়ালাইসিসের ব্যবস্থা নেই। মা শিপ্রা আক্তার তাই মেয়েকে নিয়ে আসেন বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে। ভর্তির পরের ১৫ দিনেই খরচ হয় প্রায় লাখ টাকা। হাসপাতাল থেকে রোগীর বিছানা বিনামূল্যে দেওয়ার কথা জানানো হলেও তিনি আর মেয়ের চিকিৎসা করাতে রাজি নন। অসুস্থ মেয়েকে বাড়িতে ফিরিয়ে নেবেন। ক্লান্ত সোহানা তখনও মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে শুয়েছিল বিছানায়। মা কেন হাসপাতাল ছেড়ে চলে যাচ্ছে বুঝতেও পারছে না।

মা শিপ্রা আক্তার বলেন, ‘ডাক্তার বলেছেন, ওর আরও ডায়ালাইসিস লাগবে না। এখন পর্যন্ত যা চিকিৎসা করিয়েছি, তার সবই ধারদেনায়। নিজের আর কিছু নাই। ঢাকা মেডিকেলে ডায়ালাইসিস হয় না। এখানে আসলাম বিছানাপ্রতি ভাড়া ৭০০ টাকা করে দিছি। ডায়ালাইসিস প্রতিটাতে লাগে ১ হাজার। প্রতিদিন টেস্ট করাতে হয়। কেউ বুঝব না, মা হইয়া কখনও সন্তানরে এভাবে নিয়া যায়। যদি কেউ আমারে সাহায্য করত, মাইয়ার চিকিৎসাটা চালাইতাম।’

শুধু শিপ্রা না, কিডনি রোগে আক্রান্ত শিশুদের নিয়ে অসহায় নিম্ন আয়ের বাবা-মায়েরা। ছেলে লুৎফুর ইসলামের (১১) শ্বাসকষ্ট হঠাৎ তীব্র আকার ধারণ করে। ডাক্তার জানান, হার্টে সমস্যা। মা সুমাইয়া আক্তার হেমায়েতপুর থেকে ছেলেকে অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে আসেন হার্ট ফাউন্ডেশনে। সেখানে ভর্তি করানোর আগেই দিতে হয় ৫০ হাজার টাকা। কিন্তু হাতে অত টাকা না থাকায় প্রায় ১ ঘণ্টা ছেলেকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সেই অপেক্ষা করেন। চোখের সামনে দেখতে হয় ছেলের ছটফটানি। পরে নিয়ে আসেন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেলে নিলে বলা হয়, হার্ট বন্ধ হয়ে গেছে। লুৎফুরের মা সুমাইয়া আক্তার নিজের ভোগান্তির কথা বলতে বলতে কাঁদতে শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘ঢাকা মেডিকেলে ওরা চিকিৎসা দিতে পারল না। একজন আরেকজনকে বলছেন, হার্ট বন্ধ হয়ে গেছে। পরে তারা জানান কিডনির সমস্যা। আইসিইউতে নিতে হবে, ডায়ালাইসিস লাগবে। সেখানে কোনো ব্যবস্থা নেই। তার আগে আমরা শিশু হাসপাতালে যোগাযোগ করে সিট পাইনি। অবস্থা এত খারাপ যে, দুদিন পরে সিট পেয়ে শিশু ইনস্টিটিউটে নিয়ে আসি। এর মধ্যে খরচ হয়ে গেছে দেড় লাখ টাকা।’ 

সরেজমিন রাজধানীর শিশু হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, চিকিৎসাসেবা নিতে আসাদের বড় অংশই নিম্ন আয়ের মানুষ। চিকিৎসা করাতে গিয়ে তাদের অনেকেই সর্বস্বান্ত। একদিকে সরকারি হাসপাতালগুলোতে শিশুদের কিডনি ডায়ালাইসিসের ব্যবস্থা নেই। অন্যদিকে শিশু হাসপাতালে আসন সংকট। খরচও কুলাতে পারেন না অনেকে। 

ডায়ালাইসিস দুই ধরনের হয়Ñ হিমোডায়ালাইসিস ও পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস। রক্ত পরিশোধিত করার প্রক্রিয়া হচ্ছে হিমোডায়ালাইসিস। রক্তের মাধ্যমে ফ্লুইড শরীরের ভেতর প্রবেশ করানো হয়। পরে ডায়ালাইসিস যন্ত্রের মাধ্যমে রক্ত পরিশোধন করা হয়। রক্তে জমে থাকা বর্জ্য, লবণ ও তরল ডায়ালাইসিস যন্ত্রের মাধ্যমে ফিল্টার করা হয়। 

পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিসের ক্ষেত্রে ডিভাইসের মধ্যে ডায়ালাইসিস ফ্লুইড দেওয়া হয়, আর তা পেটের ভেতর গিয়ে রক্ত পরিশোধিত করে আবার বেরিয়ে আসে। পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস সবাইকে দেওয়া যায়, তবে সেটা কাজ না করলে অবশ্যই হিমোডায়ালাইসিস করাতে হয়। সে সময় শিশুর বয়স, ওজন অনুযায়ী ক্যাথেটার প্রয়োজন হয়। 

শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের প্রধান অধ্যাপক ডা. শিরীন আফরোজ বলেন, ‘হিমোডায়ালাইসিসের জন্য শিশু হাসপাতালে ৬টি বেড আছে। এ ছাড়া শিশুদের কিডনি আইসিইউ আছে ৮টি। এর মধ্যে সাতটি পেইড আর একটি নন-পেইড। নবজাতক থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত শিশুদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। আকস্মিক যাদের কিডনি ফেইলিউর হয়, তারা যেন অর্থাভাবে ফিরে না যায়, সেজন্যই নন-পেইড একটা বেড আইসিইউতে রাখা হয়েছে। আর যাদের হঠাৎ কিডনি বিকল হয়ে যায়, তাদের আইসিইউ লাগে। আইসিইউর ব্যবস্থা অন্য কোনো হাসপাতালে নেই। বিএসএমএমইউতে সদ্য দুটি বেড উদ্বোধন করা হয়েছে। আর শিশুদের যদি পেটে ডায়ালাইসিস দিয়ে কাজ না করে, তখন হিমোডায়ালাইসিস দিতে হয়। এতে যে সংকট তৈরি হয়, তা হলো শিশুদের ওজন, বয়স অনুযায়ী ক্যাথেটার পাওয়া যায় না। বিদেশ থেকে আনতে হয়। আকস্মিক কোনো রোগীর জন্য আমরা একটা রাখি।’ 

তিনি বলেন, ‘বেশিরভাগ রোগীই খারাপ অবস্থায় আসে। বেশিরভাগই নিম্ন আয়ের মানুষ। অনেকেই চিকিৎসা খরচ চালাতে না পেরে চলে যায়। এখন পর্যন্ত এই হাসপাতালে যা ব্যবস্থা করা গেছেÑ সবই ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে। যন্ত্রপাতিগুলো বিভিন্ন ফান্ডিং থেকেই এসেছে। যদি এখানে আরও ফান্ড থাকত তাহলে আরও অনেকের জন্য ব্যবস্থা করা যেত।’ 

জাতীয় পর্যায়ে নিবন্ধন না হওয়ায় দেশে শিশু কিডনি রোগীর সঠিক পরিসংখ্যান নেই। ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব মেডিকেল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল রিসার্চ জার্নাল বলছে, ‘দেশে হাসপাতালে ভর্তি শিশুদের মধ্যে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ কিডনি রোগী।’ এমআর খান শিশু হাসপাতাল ও শিশু স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, ‘দেশে প্রায় ৫০ লাখ শিশু বিভিন্ন পর্যায়ের কিডনি রোগে ভুগছে। তাদের মধ্যে আড়াই লাখ দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগী (সিকেডি)।’ 

জন্মগত, ডায়রিয়ার পর অ্যাকিউট কিডনি ফেইলিউর এবং নেফ্রাইটিসের প্রদাহ শিশুদের কিডনি রোগের প্রধান কারণ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘শিশুদের কিডনি রোগের চিকিৎসার সুব্যবস্থা দেশে এখনও নেই। এতে ঝুঁকিতে আছে অনেক শিশু।’

সরকারি হাসপাতালে নেই শিশুদের কিডনি ডায়ালাইসিসের সুবিধা

বরিশালের আসাদুল ইসলাম আলিমের (৩) দুটি কিডনি ছোট। চার মাস আগে হঠাৎ অবস্থা অনেক খারাপ হওয়ায় তাকে প্রথমে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। কিডনি প্রায় শতভাগ কাজ বন্ধ করে দেওয়ায় জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন হয় ডায়ালাইসিসের। সরকারি হাসপাতালগুলোতে যোগাযোগ করা হলে জানানো হয় তাদের ডায়ালাইসিসের ব্যবস্থা নেই। পরে জাতীয় কিডনি রোগ ও ইউরোলজি ইনস্টিটিউটে (এনআইকেডিইউ) যোগাযোগ করলে জানানো হয়, সেখানে শিশুদের ডায়ালাইসিস সুবিধা নেই। ঢাকা মেডিকেলেও নেই। সবশেষে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে (ঢাকা শিশু হাসপাতাল) পিআইসিইউসহ ডায়ালাইসিসের সুবিধার খোঁজ পান, তবে সেখানে শয্যা খালি নেই। কয়েকদিন অপেক্ষা করার পর সিট পান।

আলিমের মা আছিয়া বেগম বলেন, ‘ওর বাবা গাড়ি চালায়। চার মাস হলো চিকিৎসা চলছে। ৮ লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে। সরকারিতে সুবিধা থাকলে হয়তো একটু কম লাগত।’ 

আলিমের মতো বেশিরভাগ শিশুই চিকিৎসার জন্য প্রথমে সরকারি হাসপাতালে গেলেও পরে এই বিশেষায়িত হাসপাতলে চিকিৎসা নিতে আসে। দেশে শিশু কিডনি রোগীর তুলনায় চিকিৎসার সুবিধা একেবারেই কম। শিশুদের জন্য স্বতন্ত্র ডায়ালাইসিস মেশিন লাগে। 

দেশে কিডনি রোগের সরকারি সর্বোচ্চ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান এনআইকেডিইউতে দীর্ঘদিন ধরে শিশুদের ডায়ালাইসিস সুবিধা নেই। এখানে ১০ শয্যার শিশু ডায়ালাইসিস ইউনিট খুলতে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগকে লিখিতভাবে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। হাসপাতালটির চিকিৎসক মো. কবির আলম বলেন, ‘আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আটকে আছে এই উদ্যোগ।’ তিনি বলেন, ‘এটা খুব দুঃখের বিষয়Ñ সরকারি হাসপাতালে শিশুদের জন্য কোনো ইউনিট নেই। এখন পর্যন্ত এই হাসপাতালে ১২ বছরের কম বয়সি কারও কিডনি প্রতিস্থাপন হয়নি।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘এই হাসপাতালে কিডনি ডায়ালাইসিসটা সেনডোর নামের একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান করে। খরচের ক্ষেত্রে সরকার কিছু অর্থায়ন করে। তবে সেখানে একটা শিডিউল থাকে, এর বাইরে দেওয়া যায় না। শিশুদের ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র মেশিন লাগে, সেই মেশিনগুলোর নাম লিখেও আমরা আবেদন করেছি, কিন্তু সাড়া পাইনি।’ 

শুধু চিকিৎসা নয়, ডায়ালাইসিস শিক্ষার ক্ষেত্রেও শিক্ষার্থীদের নির্ভরশীল হতে হচ্ছে অন্য হাসপাতালের ওপর। ডা. মো. কবির আলম বলেন, ‘দেশে কিডনি রোগের চিকিৎসা ও শিক্ষার এটি সর্বোচ্চ সরকারি প্রতিষ্ঠান। এখান থেকে শিশু কিডনি রোগের ওপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়া চিকিৎসকদেরও শিশু ডায়ালাইসিস ইউনিট না থাকায় এ-বিষয়ক শিক্ষা নিতে যেতে হয় বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট অথবা বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (পূর্বনাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়)। শিক্ষার্থীরা দেড় মাস সেখানে প্রশিক্ষণ নেন আর ১৫ দিন আসেন শিশু হাসপাতালে। 

সরেজমিন বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, সেখানেও নিম্ন আয়ের মানুষ তাদের সন্তানকে চিকিৎসা করাতে আসে। তাদের একজন বৃষ্টি আক্তার, তার ছয় বছরের মেয়ে রাইসাকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছেনÑ ১০ দিন হলো। এরই মধ্যে ২০ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। মেয়ের অবস্থা এতই খারাপ যে, ঢাকা মেডিকেল থেকে এই হাসপাতালে আসতে হয়েছে। তিনি বলেন, ‘ঢাকা মেডিকেলে সিট পাওয়া যায় না। মেয়ের অবস্থা দেখে এখানে নিয়ে আসি। ডাক্তার বলেন, কিডনিতে সমস্যা থাকতে পারে। কোনো ওষুধে কাজও করছে না। পানি উঠে শরীর ফুলে গেছে। এখন আবার বায়োপসি করাতে বলেছেন কিন্তু এক সপ্তাহ হয়ে গেলেও টাকা ম্যানেজ করতে পারি নাই। ১৫ হাজার টাকা লাগবে টেস্ট করাতে।’ সেখানে ঘুরে দেখা যায় বেশিরভাগই নিম্ন আয়ের মানুষ। তারা চিকিৎসা নিতে এসেছে বিশেষায়িত এই হাসপাতালে। 

বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (সাবেক পিজি)-এর শিশু কিডনি বিভাগের অধ্যাপক ডা. আফরোজা বেগম বলেন, ‘শিশু কিডনি রোগীদের ডায়ালাইসিসের চাহিদার তুলনায় সুবিধা কম। বিএমইউ ও শিশু হাসপাতালে ডায়ালাইসিস দেওয়া হয়। বিভাগীয় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সরকারের পদক্ষেপের তেমন অগ্রগতি হয়নি।’

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা