পারভেজ খান
প্রকাশ : ০২ অক্টোবর ২০২৪ ০৯:০৯ এএম
মারাত্মক ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের মুখোমুখি বাংলাদেশ। ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার মতো ভাইরাস বহনকারী মশায় সয়লাব বাংলাদেশের প্রতিটি এলাকা। হাসপাতালগুলোতে প্রতিনিয়ত ভিড় বাড়ছে আক্রান্তদের। বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। গত দুই মাসে ১৬৩ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। এই সময়ের মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে প্রায় ১৭ হাজার মানুষ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব মতে, এখনও সারা দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে প্রায় চার হাজার ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘন ঘন তাপপ্রবাহ, বৃষ্টি, দীর্ঘতর বন্যা, আবহাওয়ার অস্বাভাবিক উষ্ণায়নের কারণে মশকপাল বিস্তারের অনুকূল পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। ফলে আক্রান্তের সংখ্যা দিনদিনই বাড়ছে। এ অবস্থায় কেবল চিকিৎসা দেওয়াই যথেষ্ট নয়; বরং সবার আগে মশা প্রতিরোধ ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করেন, মশার ‘জন্ম নিয়ন্ত্রণ’ করার জোরালো কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। তা না হলে বেড়ে যাবে ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত ও মৃত্যুর আশঙ্কা। একপর্যায়ে দ্রুতই ডেঙ্গু রূপ নেবে মহামারিতে। এমনকি ডেঙ্গুর চেয়েও ভয়ংকর রোগ জিকা ভাইরাসও ছড়িয়ে পড়তে পারে বাংলাদেশে।
ডেঙ্গু নিয়ে এবার দুশ্চিন্তা বেশি যেসব কারণে
প্রাকৃতিক কারণ তো আছেই, পাশাপাশি বর্তমানে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোতে চলমান অস্থিতিশীলতাও এ বছর ডেঙ্গু নিয়ে বাড়তি দুশ্চিন্তার জন্ম দিচ্ছে। সারা দেশের সিটি করপোরেশনগুলোর অধিকাংশই নেতৃত্বশূন্য। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর থেকে মেয়র, কমিশনারদের বেশিরভাগই পলাতক। ফলে মশক নিধন ও পরিচ্ছন্নতার নিয়মিত কার্যক্রম অনেকাংশেই অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় মশার প্রজনন এবার কতটা নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। ডেঙ্গু রোগের ভুক্তভোগীরা বিষয়টি নিয়ে যতটা বিচলিত হচ্ছেন, মশা নিধনের কাজে সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থাপকদের তৎপরতা এখনও সেভাবে দৃশ্যমান নয়।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ বলেছেন, ডেঙ্গুর সংক্রমণ বাড়ছেÑ এটা আমাদের জন্য চিন্তার বিষয়। অবশ্যই এদিকে বাড়তি নজর দিতে হবে। সংক্রমণ রোধে কিছু বিষয়কে গুরুত্বের সাথে খেয়াল রাখা হচ্ছে। তা হলো- চারপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, লার্ভিসাইডের মেডিসিন দেওয়া আর ফগিং করা। পাশাপাশি আরেকটি হলো জনগণকে সচেতন করা।
তিনি আরও বলেন, ডেঙ্গু সমস্যা সম্পর্কে সবাই অবগত। প্রতিবছরই এটা নিয়ে মহড়া হয়। যখনই ডেঙ্গু বাড়তে থাকে, তখন আমরা হইচই করি। নানারকম কার্যকলাপ দেখাই। কিন্তু যদি গোড়া থেকে পদক্ষেপ নেওয়া থাকে, শুরু থেকে আমরা প্রত্যেকে সচেতন হই, তাহলে ডেঙ্গুর সংক্রমণ হ্রাস পাবে। চলমান ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলায় এরই মধ্যে ১০টি টিম গঠন করা হয়েছে। প্রতিটি টিম কাজ শুরু করে দিয়েছে। ডেঙ্গু সংক্রমণ রোধে তারা খুঁটিনাটি সব বিষয় পর্যবেক্ষণ করছে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে এই টিমগুলো কাজ করবে।
যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
কমিউনিটি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. জাকিয়া ফেরদৌসী খান গতকাল মঙ্গলবার প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, মশা থেকে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগ হয়Ñ সে তথ্য অনেকেরই জানা। কিন্তু এই মশা আরও যে মারাত্মক রোগের জীবাণু বহন করে, সেটা অনেকেই জানেন না। ডেঙ্গুর চেয়েও ভয়ংকর হচ্ছে জিকা ভাইরাস। অথচ জিকা শনাক্ত করার কোনো ব্যবস্থা বাংলাদেশের হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে নেই বললেই চলে। কেবল সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে জিকা ভাইরাস শনাক্ত করার ব্যবস্থা রয়েছে। ডেঙ্গুজ্বরের প্রাদুর্ভাবের বিষয়ে কর্তৃপক্ষ সজাগ; কিন্তু জিকা ভাইরাস সম্পর্কে কতটা প্রস্তুত? এর আগে ২০১৪ সালে দেশে ৬৭ বছর বয়সি এক রোগীর দেহে (রক্ত পরীক্ষা করে) জিকা ভাইরাসের নমুনা পাওয়া গিয়েছিল। এর লক্ষণগুলো হলোÑ হালকা জ্বর, চোখে ব্যথা ও লালচে রঙ, মাথাব্যাথা, গিঁটে গিঁটে ব্যথা এবং শরীরে র্যাশ দেখা দেওয়া।
এই রোগের বা রোগীর লক্ষণ নিয়ে ডা. জাকিয়া আরও বলেন, জিকা নিয়ে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা গবেষণায় জানা গেছে, আক্রান্ত প্রতি পাঁচজন রোগীর মধ্যে একজনের মধ্যে হালকা জ্বর, চোখ লাল হওয়া বা কালশিটে দাগ পড়া, মাথাব্যথা, হাড়ের গিঁটে ব্যথা ও চর্মরোগের লক্ষণ দেখা যায়। বিরল ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তি গুলেন ব্যারি সিনড্রোমেও ভুগতে পারেন। এর ফলে সাময়িক পক্ষাঘাতগ্রস্ততা কিংবা ‘নার্ভাস সিস্টেম ডিজঅর্ডারের’ মতো ঘটনা ঘটতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, এই ভাইরাসের কোনো প্রতিষেধক বা চিকিৎসায় ওষুধ নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তিকে বিশ্রাম ও বেশি করে তরল খাবার খেতে পরামর্শ দেওয়া হয়।
নিউক্লিয়ার মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সানোয়ার হোসেন বলেন, মশাবাহিত রোগ সংক্রমণের বর্তমান তরঙ্গ আমাদের সতর্কবার্তা দিচ্ছে। কারণ এটি ভাইরাসের একটি শক্তিশালী স্ট্রেন দ্বারা সৃষ্ট। আর তাই চিকিৎসার চাইতে রোগ প্রতিরোধ বা মশার বংশবিস্তার রোধকেই সবার আগে গুরুত্ব দিতে হবে। মশার কামড় থেকে রক্ষা পাওয়ার বিষয়ে সতর্ক থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বয়স্ক ও দুর্বল ইমিউন সিস্টেমের লোকদের অসুস্থতার ঝুঁকি বেশি থাকে, যা মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করে। এমনকি সেটা মারাত্মক হতে পারে। গুরুতর ক্ষেত্রে, ডেঙ্গু শরীরে অভ্যন্তরীণ রক্তপাত ঘটায়, যা মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের মতো পৃথিবীর কোনো দেশেই ডেঙ্গুতে এত মৃত্যুর রেকর্ড নেই। বাংলাদেশে অসচেতনতার কারণে রোগীদের দেরিতে হাসপাতালে ভর্তি হওয়াকে তারা একটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বিশেষত, নারীদের স্বাস্থ্য সচেতনতা কম এবং তারা সচরাচর জ্বর নিয়ে অবহেলা করেন। ফলে তাদের ডেঙ্গু শনাক্ত হতে দেরি হয়ে যায়। একই সাথে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার কারণেও রোগীর মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ড. মুশতাক আহমেদ বলেন, প্রথমত রোগীর সংখ্যা বাড়লে আনুপাতিক হারে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়বে। গত বছর সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়েছে যেসব কারণে সেগুলো কিন্তু আজও দূর হয়নি। বিশেষ করে আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ হয়নি। যারা শনাক্ত হচ্ছে কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ নন, তাদের মাঠপর্যায়ে হাসপাতালেই রাখার কথা। দেখা যাচ্ছে, তারাও চলে আসছেন রাজধানীতে বা বিভাগীয় বড় হাসপাতালে। আবার গুরুতর অবস্থায় থাকা রোগীরা পড়ে থাকছেন মাঠ পর্যায়ের হাসপাতালে। সাধারণ আর জটিল রোগীদের একসঙ্গে রাখা হলে যথাযথ চিকিৎসা সম্ভব নয়। কাজেই চিকিৎসাব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ করা খুব দরকার। অনেক ক্ষেত্রেই রোগীকে উপজেলা পর্যায়ে প্রাথমিক চিকিৎসা না দিয়ে জেলা কিংবা বিভাগীয় হাসপাতালে রেফার করা হয়। এতে মধ্যবর্তী সময়ে অনেক রোগীর প্লাটিলেট কমে যাওয়ার কারণে মুমূর্ষু হয়ে পড়েন। এসব রোগীকে সুস্থ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, যে রোগীকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব তাকে জেলা বা বিভাগীয় হাসপাতালে ট্রান্সফার করে দেওয়া হয়। এতে যে সময় লাগে তাতে করে রোগীর প্লাজমালি কেইস হয়ে যায়, প্লাটিলেট কাউন্ট কমে যায়। ফলে রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। এ ব্যাপারে মাঠ পর্যায়ের চিকিৎসকদেরও সচেতনতা বাড়াতে হবে।
কীটতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. ছানোয়ার হোসেন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, বাংলাদেশে ২০০০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৪৪ হাজার ২৪৬। মৃত্যু ছিল ৮৫৩ জন। ওই ২২ বছরের রেকর্ড ভেঙে ২০২৩ সালে আক্রান্ত হয় ৩ লাখ ২১ হাজার জন। এর মধ্যে মারা যান ১ হাজার ৭০৫ জন। চলতি বছর যে কত বড় ভয়াবহতা অপেক্ষা করছে, তার সুস্পষ্ট লক্ষণ আমরা দেখতে পাচ্ছি। বতর্মান আক্রান্ত আর মৃত্যুর পরিসংখ্যানকে যদি ২০২৩ সালের সঙ্গে তুলনা করি, তাহলে গা শিউরে উঠবে। এমনকি পরিসংখ্যানের সঙ্গে যদি বিগত বছরের আবহাওয়া ও পরিবেশের উপাদানগুলোর তুলনা করি, তাহলে সেখানেও একটা হোঁচট খেতে হবে। বিগত বছরের তুলনায় এ বছর তাপমাত্রা এখন পর্যন্ত নিম্নগামী, যা এডিস মশার প্রজননের জন্য অনুকূল। এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া না গেলে ২০২৪ সালের পরের দিনগুলোয় ডেঙ্গুর ভয়াবহতা অগ্নিমূর্তি ধারণ করতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা আরও মনে করেন, ডেঙ্গুর ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পেতে সমন্বিত কার্যক্রম প্রয়োজন। টেকসই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা বলবৎ রাখতে ভেক্টর ও ভেক্টরবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ ইনস্টিটিউটসহ বিশ্বমানের গবেষণাগার স্থাপন করা দরকার। একই সঙ্গে ওয়ার্ল্ড মসকুইটো প্রোগ্রামে এবং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রয়োজনীয় চুক্তির মাধ্যমে কাজ করতে হবে। স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমন্বয়ের মাধ্যমে মশা প্রতিহত করতে হবে। জলাবদ্ধতা দূর করাসহ নতুন ইমারত তৈরির কার্যক্রমকে একটা নিয়ন্ত্রণ বিধির মধ্যে রাখতে হবে। এডিস মশার লার্ভা তৈরির স্থান ধ্বংস করতে দায়িত্বপ্রাপ্তদের কার্যক্রমের পরিসর আইনি কাঠামোর মাধ্যমে আরও সুদৃঢ় করতে হবে। নইলে রেহাই নেই কারোই।