রেজাউল বাহার
প্রকাশ : ০৬ মে ২০২৪ ১২:১৫ পিএম
আপডেট : ০৬ মে ২০২৪ ১২:২৮ পিএম
আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল আর প্যারাগুয়ের সীমানার মিলনস্থলে অবস্থিত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জলপ্রপাত ইগুয়াজু। ছবি : লেখক
ফুটবলের জন্য আর্জেন্টিনা আমাদের কাছে অতি পরিচিত একটি নাম। সময়ের সেরা ফুটবলার লিওনেল মেসি কিংবা সারা বিশ্বে তুমুল জনপ্রিয় প্রয়াত ম্যারাডোনার কারণে বাঙালি আবেগে এক বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছে দেশটি। ফুটবল কিংবদন্তিদের। এ দেশ সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিভাবেও অত্যন্ত সমৃদ্ধ। সম্প্রতি আর্জেন্টিনা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন রেজাউল বাহার
ভালোবাসার এক দেশ বাংলাদেশ। এই দেশের মাটিতে লাল-সবুজের পতাকার পর যে পতাকাটা সবচেয়ে বেশি উড়তে দেখা গেছে সেটি সাদা আর হালকা নীল রঙে জড়ানো। ছোটবেলা থেকেই মনের গভীরে জমে ছিল জমাট বাঁধা অনুভূতি। আর সেটা শুরু হতো বিশ্বকাপ ফুটবল ঘিরে। আমি ম্যারাডোনার দেশের কথা বলছি। আমরা যাচ্ছি এবার সেখানে, আর্জেন্টিনা।
আমাদের ফ্লাইট এসে নেমেছে বুয়েন্স আয়ার্স এয়ারপোর্টে, সেখান থেকে সরাসরি পালেরমোতে। শহরের একটা পাড়ার নাম পালেরমো। বুয়েন্স আয়ার্স দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে বড় শহর, শহরজুড়ে অসংখ্য পাড়া। দুই উচ্চবিত্তের পাড়া পালেরমো আর রেকোলেটা। শহরের ট্যুরিজমের মূল আকর্ষণ এই দুই পাড়া বা তার আশপাশ ঘিরেই। আমাদের থাকার বন্দোবস্ত হয়েছে শহরের কেন্দ্রস্থলে অত্যাধুনিক এক ট্রিপ্লেক্স অ্যাপার্টমেন্টে। ভ্রমণে আমরা হোটেলে থাকার চেয়ে এয়ারবিএনবি/ভিলাতেই থাকাটা পছন্দ করি, এর সুবিধা অনেক। সে প্রসঙ্গে না যাই।
আমাদের শহর ভ্রমণ মানেই হাঁটা, যতটা পথ হেঁটে হেঁটে দেখা যায়। হাঁটতে ক্লান্তি এলে কোথাও বসে এক কাপ চা বা কফি, তারপর আবার পথচলা। আর্জেন্টিনা চা বা কফির দেশ নয়, এখানকার অনেক মানুষ নেশার মতো মাতে ড্রিংকস খায়। গত বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা শিরোপা জেতার সঙ্গে তাদের মাতে ড্রিংকসের কথা সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে। মূলত উরুগুয়ে আর আর্জেন্টিনা এই দুই দেশে মাতে মানেই সকাল-দুপুর-সন্ধ্যায় সাথী। এদেশে বেড়াতে এসে মাতে না খেলে ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যায়। চা/কফির মতো মাতে কোনো কফিশপে পাওয়া যাবে না। বানাতে হবে নিজেকে, সম্পূর্ণ আলাদা এক প্রসেস। সরঞ্জামাদি প্রয়োজন, মাতে পাতা প্রয়োজন। সেসবের ব্যবস্থা করেছিল লুসিয়া। ইউনিভার্সিটি পাস করা আর্জেন্টাইন মেয়ে। ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করছে। মাঝেমধ্যে সুযোগ হলে ট্যুর গাইড হিসেবে কাজ করে। এখন ডিজিটাল মিডিয়ার যুগ। কোথাও ভ্রমণে যাওয়ার আগে চাইলে স্থানীয় কারও সঙ্গে পরিচিত হওয়া যায়। শো-অ্যারাউন্ড নামক একটা অ্যাপ আমরা প্রায়ই ব্যবহার করি। লুসিয়ার সঙ্গে পরিচয় সেখানে। অদ্ভুত চটপটে প্রাণবন্ত একজন মানুষ। এই শহরে সেই ছিল আমাদের ট্যুর গাইড। প্রযুক্তি আর ইন্টারনেটের কারণে ভ্রমণ এখন সহজ মনে হয়। পৃথিবীতে ৩০টির মতো দেশে আমরা এয়ার বিএনবি ব্যবহার করেছি। কখনও কোনো ঝামেলা হয়নি।
বুয়েন্স আয়ার্স শহরে আসা মানেই কয়েকটা জিনিস খুব কাছ থেকে ছুঁয়ে যেতে হবে। ফুটবল তার অন্যতম। যে ফুটবল ভালোবাসে না, তার কাছে শহরটা ভিনগ্রহ মনে হতে পারে। ম্যারাডোনা, মেসি এই দেশের মানুষের কাছে যেন দুই নয়নমণি। সমানভাবে আর্জেন্টিয়ানরা ভালোবাসেন দুজনকেই। শহরে ঘুরে অনেকের কাছ থেকেই তা জানলাম, আরও জানলাম এই শহরের প্রায় সবাই চেনেন বাংলাদেশকে। তারা জানেন বাংলাদেশের কতটা গভীরে গেঁথে আছে আর্জেন্টিনার ফুটবল। আর্জেন্টিনার সংবাদমাধ্যমগুলোতে দেখানো হয় কী হচ্ছে বাংলাদেশে; যখনই খেলায় জিতে বা হেরে যায় আর্জেন্টিনা। শহরের এক নিম্ন আয়ের এক পাড়া, নাম লা বোকা, যেখানে আছে ম্যারাডোনার ভালোবাসার বোকা জুনিয়র্স স্টেডিয়াম। বেশ পুরোনো ঘরবাড়ি, পথঘাট অলগলি অনেকটা দেশের পুরাতন ঢাকা শহরের মতো, তবে বেশ কিছু বাড়ি বিভিন্ন রঙে রাঙানো, একটু হাঁটলেই দেখা যায় ফুটবলপ্রেম। বাড়ির বারান্দায়, ছাদে বা গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে আছেন ম্যারাডোনা বা মেসি। তাদের মূর্তি আর দেয়াল জোড়া ছবি।
লা বোকাতে হাঁটতে গিয়ে দেখলাম এক যুগল নেচে বেড়াচ্ছে, ট্যাংগো নাচ যার উত্তরাধিকার দক্ষিণ আমেরিকার এই অংশে। ইশারায় আমাদের আমন্ত্রণ জানালেন নাচের জন্য। নাচ তো দূরের কথা, জীবনে কাত হয়ে পড়ে যাওয়া কিংবা ব্যায়াম করার প্রয়োজন ছাড়া নিজের শরীরের অঙ্গভঙ্গি প্রকাশ্যে কখনও করিনি। সে যাই হোক, ভ্রমণ মানেই তো অভিজ্ঞতা। আমরা আছি বুয়েন্স আয়ার্স শহরে, এই তো সুযোগ। শুরু করে দিলাম পথে ট্যাংগো নাচের প্রশিক্ষণ। নাচছি লা বোকা পাড়ায়, কালের সাক্ষী আর ইতিহাস ছুঁয়ে যেতে কার না ইচ্ছে হয়। আর্জেন্টিয়ান যুগলের মেয়েটার সঙ্গে নাচ শেষ হওয়ার পর একটু অনুরোধ আর জোড়াজুড়িতে শারমীনও নেমে পড়ল ছেলেটার সঙ্গে। আমাদের দুজনেরই বেশ কিছু ছবি তোলা হলো। শারমীন হুঁশিয়ার করে বলে দিয়েছে, ভুলেও আমার এই ছবি কারও সঙ্গে শেয়ার করবা না। আর্জেন্টিনা আর বাংলাদেশি সমর্থকদের এই এক তফাত। সমাজ, সংকোচ, পরিচিত মানুষের ভাবনায় বাংলাদেশ নিমগ্ন। অথচ এই দেশটা যথেষ্ট সংস্কারমুক্ত। অন্যের চরকায় তেল দেওয়ার মানসিকতা এদের নেই। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে এখানে সমাজব্যবস্থা যথেষ্ট উন্মুক্ত।
আর্জেন্টিনা দেশটা বেশ বড়। এতটাই বড় যে, উত্তর থেকে দক্ষিণে গেলে ঋতূ পরিবর্তন হয়ে যাই, গ্রীষ্ম থেকে শীত অথবা উল্টো। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এদেশের পরতে পরতে। এখানে ভ্রমণের জন্য প্রয়োজন লম্বা সময়। আমরা দুজনেই চাকরিজীবী মানুষ। বছরের অল্প কিছু ছুটি মিলিয়ে গত ১৬ বছরে আমাদের দেখা হয়েছে ১০৮টি দেশ। হয়তো সহজ নয়, কোথাও ঘুরতে যাওয়া মানেই প্রতি ঘণ্টা আমাদের কাজে লাগাতে হবে, এমন মানসিকতা সঙ্গে থাকে সবসময়। আমাদের আর্জেন্টিনা সফর খুবই সংক্ষিপ্ত, কিন্তু মূলত আমরা এখানে এসেছি পৃথিবীর এক প্রাকৃতিক বিস্ময় দেখার জন্য। আর তার অবস্থান দেশটির উত্তর-পূর্বে। আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল আর প্যারাগুয়ের সীমানার মিলনস্থলে আছে ইগুয়াজু জলপ্রপাত। বিশ্বের সবচেয়ে বড় জলপ্রপাত। একসঙ্গে মোট ২৭৫টি জলপ্রপাত নেমে এসেছে আমাজন রেইন ফরেস্ট ঘেঁষে। এলিয়ানোর রুজভেল্ট, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের স্ত্রী এখানে এসে নায়াগ্রা জলপ্রপাত নিয়ে আফসোস করে বলেছিলেন, নায়াগ্রা এত ছোট কেন। ইগুয়াজু জলপ্রপাত দৃষ্টি সীমানায় ধরার মতো নয়। বুয়েন্স আয়ার্স থেকে ঘণ্টাখানেকের ফ্লাইটে আমরা এসে নামলাম পূর্ত ইগুয়াজুর ছোট এক এয়ারপোর্টে। সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে ওমর ফার্নান্ডেজ নামক এক ভদ্রলোক। ইগুয়াজুতেই হবে আমাদের গাইড এবং ড্রাইভার।
ইগুয়াজু জলপ্রপাত নেমে গিয়ে হয়েছে ইগুয়াজু নদী, সেটি এসে মিলে গেছে পারানা নদীতে। ইগুয়াজু নদীর একপাশে আর্জেন্টিনা অন্যপাশটা ব্রাজিল। পারানা নদীর ওপাশটা প্যারাগুয়ে। আন্তর্জাতিক বর্ডার তিন দেশের মানুষের জন্য যথেষ্ট খোলা, দ্রুত পেরিয়ে যাওয়া যায় নদীপথে বা ব্রিজ পার হয়ে সড়কপথে। আর্জেন্টিনার সঙ্গে প্যারাগুয়ের সড়কপথে এ অঞ্চলে কোনো ব্রিজ নেই, আছে ছোট এক ফেরি। তাও চলে না সময়মতো। ফেরি চলাচল নদীর পানির ওঠানামার সঙ্গে সম্পৃক্ত, ফেরি থাকে প্রায়ই বন্ধ। আমাদের ইচ্ছা ছিল ফেরি নিয়ে প্যারাগুয়ে ঘুরে আসা। এতদূর এসেছি যখন দেখে যাই একটা দেশ স্বল্প সময়ের জন্য। গিয়ে দেখি ফেরি চলাচল বন্ধ। অগত্যা ঠিক করলাম সড়কপথেই যাব। সমস্যা একটাই। আর্জেন্টিনা থেকে ব্রাজিল হয়ে যেতে হবে প্যারাগুয়েতে। তার মানে বহুবার ইমিগ্রেশন চেকইন আর চেকআউট করতে হবে। গুনে গুনে আটবার। ভ্রমণ মানেই তো অভিজ্ঞতা, কাজেই শুরু করলাম সড়কপথে যাত্রা।
যখন প্যারাগুয়ের কুইডেড ডেল এস্টেট শহরে এসে পৌঁছলাম, মনে হলো ঢাকা শহরে ফিরে এসেছি। কোলাহল, পথের দুপাশ আর অলিগলি শপিং সেন্টারে ভরপুর, রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে মানি এক্সচেঞ্জ চলছে, হকাররা ব্যস্ত জ্যামের রাস্তায় থেমে থাকা গাড়িতে সদয় বিক্রিতে। এই শহর ছেড়ে একটু দূরেই আছে আরেকটা জলপ্রপাত, নাম মানডে (সোমবার) জলপ্রপাত। গেলাম সেখানে, অদ্ভুত সুন্দর, অথচ কোনো ট্যুরিস্ট নেই। পুরো জলপ্রপাতটাই যেন আমাদের নিজস্ব। ট্যুরিস্ট না থাকার মূল কারণ একটু দূরেই সেই বিস্ময়কর ইগুয়াজু জলপ্রপাত। যারা এই অঞ্চলে আসে, প্রায় সবাই ইগুয়াজু জলপ্রপাত দেখতেই আসে। এবার আমাদের ইগুয়াজুর পথে যাত্রা শুরু। আমরা এই জলপ্রপাত দেখব আকাশ থেকে, নদীপথে এবং হেঁটে হেঁটে। আকাশ থেকে জলপ্রপাত দেখার একমাত্র উপায় ব্রাজিল থেকে। সেখান থেকেই হেলিকপ্টার রাইড করার বন্দোবস্ত আছে, কাজেই গেলাম সেখানে। পাখির চোখে ওপর থেকে দেখা এক অবাক পৃথিবী, সবুজের পথ ধরে অনেকটা সীমাহীন এলাকাজুড়ে উপচে পড়ছে পানি। শুধুমাত্র আকাশ থেকেই দেখা যায়, জল দৈত্যের শাখাপ্রশাখা। দূর হতে প্রশান্তিময় মনে হলেও এ যেন এক দৈত্য নেমে যাচ্ছে রেইন ফরেস্ট থেকে নদীতে।
পানিপথে আর হেঁটে ইগুয়াজু জলপ্রপাত দেখা আর্জেন্টাইন সাইড থেকে। পায়ে হাঁটা পথ অনেকটা অ্যাডভেঞ্চার, শরীরে ক্লান্তি আসে, শুধু ক্লান্ত হয় না দুচোখ। ভ্রমণের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর অংশটা ছিল মোটরচালিত নৌকায় দৈত্যের সামনাসামনি এসে দাঁড়ানো। পুরো ট্রিপটা হয়তো অনেকের জন্য কিছুটা ভয়ের ব্যাপার। শারীরিক সক্ষমতার প্রয়োজন আছে। খরস্রোতা যদিও, পাহাড় বা পাথরের পাশ ধরে যেতে হবে। ধীরে ধীরে প্রকৃতির এক অপার্থিব আয়োজনে ভেতরের ভয় নামক জিনিসটা আর যেন টের পাওয়া যায় না। আমরা চলে এসেছি দৈত্যের মুখের কাছাকাছি, ফিরে যাওয়ার পথ নেই। কী ভয়ংকর উত্তাল চারপাশ।
একসময় যন্ত্রচালিত নৌকা ক্ষণিকের জন্য চলে যায় জলপ্রপাতের নিচে। মনে হচ্ছে, ভাসিয়ে নিয়ে যাবে সব যাত্রীকে। একসময় সেই অ্যাডভেঞ্চার শেষ হতে থাকে। চুপচুপে ভেজা শরীরে লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে আমরা ফিরে আসি। ফিরে এসে মনে হয়েছে যারাই এখানে আসবে, অন্তত একবার যেন নদীপথে খুব কাছ থেকে ইগুয়াজুকে দেখে আসে। প্রকৃতির রূপ কাছ বা দূর হতে দেখা, আর তাকে ছুঁয়ে দেখা সম্পূর্ণ ভিন্ন অভিজ্ঞতা। সেই অভিজ্ঞতা এখন আমাদের স্মৃতি। কিছু ছবি, ভিডিও- এটুকু লেখা আর মনে জমে থাকা স্মৃতি। ভ্রমণ দিয়েছে অনেক। কখনও কখনও মনে হয়, এত সুন্দর কেন এই পৃথিবী। আমি কি না দেখেই চোখ বুজে যাব? আমরা দুজন অপারগ, পৃথিবী দেখার নেশায় আমরা এখন নেশাগ্রস্ত। আবার যাব, বারবার যাব, যাব পৃথিবীর অন্যত্র, যেখানে প্রকৃতি রূপ নিয়েছে ভিন্নভাবে।