আসমাউল হুসনা
প্রকাশ : ০৫ মে ২০২৪ ১৩:৪৭ পিএম
বোরড টানেলার্সের তৈরি খননযন্ত্রটি (টিবিএম) দেশের কাজেও লাগবে বলে বিশ্বাস করেন এর নির্মাতারা। ওয়াসার লাইনের জন্য খনন পরিচালনা, নিষ্কাশনব্যবস্থায় কাজ করাসহ নানা কাজে ব্যবহৃত হতে পারে এ যন্ত্র। প্রবা ফটো
‘আমার সীমার বাঁধন টুটে/দশদিকেতে পড়ব লুটে/পাতাল ফেড়ে নামব নীচে, উঠব আবার আকাশ ফুঁড়ে/বিশ্ব-জগৎ দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে।’ কবি কাজী নজরুলের লেখা ‘সংকল্প’ কবিতা বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন পর্যায়ে একের পর এক সফলতা অর্জন করছে তারা। মার্চের শেষ সপ্তাহে শেখ মোহাম্মদ শিথিলের নেতৃত্বে ‘বোরড টানেলার্স’ নামে একটি টিম ইলন মাস্কের নট আ বোরিং কমপিটিশনের ফাইনালে অংশ নিয়ে সেরা ৩-এ থাকার পাশাপাশি প্রথম দল হিসেবে সম্মানসূচক ‘রুকি’ পদক জিতেছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশলের ২০ শিক্ষার্থী নিয়ে গড়া হয়েছে বোরড টানেলার্স। যাদের মধ্যে সাতজন চূড়ান্ত পর্বে অংশ নিতে গিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের বাসট্রপে অবস্থিত ইলন মাস্কের দ্য বোরিং কোম্পানির মূল ভেন্যুতে।
নট আ বোরিং কমপিটিশন নামক এ প্রতিযোগিতার আয়োজক ইলন মাস্কের প্রতিষ্ঠান দ্য বোরিং কোম্পানি। নতুন চিন্তা ও প্রযুক্তির সমন্বয়ে মাটির নিচ দিয়ে টানেল তৈরির যন্ত্র নির্মাণের উদ্দেশ্যে প্রতিযোগিতাটি আয়োজন করে তারা।
২০২১ সাল থেকে নট আ বোরিং কমপিটিশন হয়ে আসছে। দুই ধাপের অনলাইন পর্ব পেরিয়ে ফাইনালে পৌঁছায় বিশ্বের সেরা ১০ দল। আট দিনের ফাইনাল পর্বের প্রথম সাত দিন প্রকল্প উপস্থাপনা করতে হয়। সঙ্গে চলে যন্ত্রের নিরাপত্তাসংক্রান্ত পরীক্ষা। অর্থাৎ কাজ করার জন্য যন্ত্রটি প্রস্তুত কি না, তারই যাচাইবাছাই। শেষ দিনে নিজেদের তৈরি যন্ত্র দিয়ে মাটি খুঁড়ে দেখাতে হয়।
দুই ধাপের অনলাইন পর্ব পেরিয়ে ফাইনালে পৌঁছার পর মূল প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে দ্য বোরিং কোম্পানির ভেন্যুতে যাওয়া নিয়েই দলের সবাই শঙ্কায় ছিল একসময়। পৃষ্ঠপোষকতা পেতে বোরড টানেলার্সকে কিন্তু বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। যন্ত্র নির্মাণে কারিগরি সহায়তা দিয়েছে বাংলাদেশ শিল্প কারিগরি সহায়তা কেন্দ্র (বিটাক)। পরে গিগাবাইট ও সুপার স্টার গ্রুপও পৃষ্ঠপোষক হিসেবে যোগ হয়েছে। সহ-দলনেতা এম শাহরিয়ার ইকবাল বলেন, ‘শুরুর দিকে আমরা প্রত্যেক সদস্য নিজেদের সাধ্যমতো টাকা দিয়ে যন্ত্রটা দাঁড় করিয়েছি। পর্যাপ্ত টাকার অভাবে কিছু অংশ সম্পূর্ণ করা হয়ে ওঠেনি। যন্ত্রটি যুক্তরাষ্ট্রে নিতেও অনেক ঝক্কি পোহাতে হয়েছে। টাকার অভাবে যন্ত্রাংশগুলো ভাগ করে নিজেদের লাগেজে করে নিতে হয়েছে।’
বোরড টানেলার্স টিম নট আ বোরিং প্রতিযোগিতায় ফাইনালে অংশ নিয়ে সেরা ৩-এ থাকার পাশাপাশি প্রথম দল হিসেবে সম্মানসূচক ‘রুকি’ পদক অর্জন করে
প্রথমবার অংশ নিয়েই বাজিমাত
বোরড টানেলার্সের দলনেতা শেখ মোহাম্মদ শিথিল বলেন, ‘এ অর্জন নিয়ে আমরা এখনও ঘোরের মধ্যে আছি। সেরা ৩-এ থাকা আমাদের জন্য অনেক সম্মানের। রুকি পুরস্কার সেই সম্মান আরও সমৃদ্ধ করেছে। আমরাই এশিয়ার প্রথম দল, যারা এ প্রতিযোগিতায় এত ভালো অবস্থানে পৌঁছালাম। আমাদের প্রতিযোগিতাটি খুবই চ্যালেঞ্জিং। কেননা একটি বোরিং মেশিন তৈরি করতে যে প্রযুক্তি ও গবেষণা প্রয়োজন তা আমাদের দেশে খুব একটা সহজলভ্য নয়। দলগত প্রচেষ্টা ও ইচ্ছাশক্তির জোরে নামমাত্র ফান্ডিং থাকার পরও বিশ্বের বড় বড় দলের সঙ্গে লড়াই করে চূড়ান্ত পর্যায়ে নির্বাচিত হয়েছিল আমাদের দল। বোরড টানেলার্স বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছে। আমাদের লক্ষ্য হলো উদ্ভাবনী মাইক্রো-টানেল বোরিং মেশিন ডিজাইন ও তৈরি করা। সেই সঙ্গে বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে বাইরের দেশগুলো কাছে বাংলাদেশের প্রকৌশলের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার করা।’
প্রতিযোগিতায় প্রথমবার অংশ নিয়েই নিজেদের প্রতিভা ও দক্ষতার প্রমাণ দেওয়ায় বাংলাদেশ দলটিকে রুকি পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশের মার্কিন দূতাবাস থেকেও বোরড টানেলার্স টিমকে অভিনন্দন জানানো হয়েছে।
প্রতিযোগিতা মাত্র সাত দিনের হলেও অনলাইনের দুটি ধাপ সফলভাবে শেষ করার পরই মূলত শুরু হয়েছিল আসল কাজ। ভার্চুয়াল ডিজাইনের বাস্তবায়নে টিমের সদস্যদের দিনরাত একটানা নিরলস চেষ্টায় ধাপে ধাপে তৈরি হয় বোরিং যন্ত্রের বিভিন্ন অংশ। এতে যুক্ত হয় সর্বাধুনিক প্রযুক্তি। প্রতিটি অংশের জন্য আলাদাভাবে কাজ করেছে ডেডিকেটেড টিম। আর সব টিমের সমন্বয়ক ছিলেন শেখ মোহাম্মদ শিথিল।
দেশের অবকাঠামো নির্মাণে ব্যবহৃত হবে এ যন্ত্র
বোরড টানেলার্সের তৈরি খননযন্ত্রটি (টিবিএম) দেশের কাজেও লাগবে বলে বিশ্বাস করেন এর নির্মাতারা। ওয়াসার লাইনের জন্য খনন পরিচালনা, নিষ্কাশনব্যবস্থায় কাজ করাসহ নানা কাজে ব্যবহৃত হতে পারে এ যন্ত্র।
এ দলের উপদেষ্টা ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক সালমান প্রমন। শিল্প উপদেষ্টা ছিলেন বিটাকের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মামুনুর রশীদ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মো. আশরাফুজ্জামান। এ তিনজনের প্রতিই ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে বোরড টানেলার্স। অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসহ একটি ডেডিকেটেড ল্যাব প্রদানের জন্য দলটি তাদের উৎপাদন সহযোগী বাংলাদেশ শিল্পপ্রযুক্তি সহায়তা কেন্দ্রের (বিটাক) কাছে কৃতজ্ঞ।