রাজশাহী অফিস
প্রকাশ : ০৪ মে ২০২৪ ১৩:৫৬ পিএম
রাজশাহী শহরের উত্তরে পবা উপজেলার বড়গাছি ইউনিয়নে অবস্থিত জরাজীর্ণ তামলি রাজপ্রাসাদ। প্রবা ফটো
পানবাণিজ্যের সঙ্গে রাজশাহীর ইতিহাস হাজার বছরের পুরোনো। সেই পাল ও সেন আমল থেকেই এ অঞ্চলের পান পুরো ভারতবর্ষে সমাদৃত। পান ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা এ অঞ্চলের পান রপ্তানি করে রাজশাহীতে জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন। গড়ে তোলেন আলিশান প্রাসাদ। পান ব্যবসা করে যারা প্রভাবপ্রতিপত্তি গড়েছিলেন তারা এ অঞ্চলে তামলি জমিদার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। পানের সংস্কৃত তাম্বূল। তাম্বূল থেকে এসেছে তামলি শব্দটি। পরে তারা সুদ ব্যবসার মাধ্যমে পান চাষিদের নানাভাবে শোষণ ও নিপীড়ন শুরু করেন।
সংরক্ষণের অভাবে পান ব্যবসায়ীদের সেই নিপীড়নের শেষ স্মৃতিচিহ্ন তামলি প্রাসাদটি ইতিহাস থেকে মুছে যেতে চলেছে। রাজশাহী শহরের উত্তরে পবা উপজেলার বড়গাছি ইউনিয়নে এ প্রাসাদ অবস্থিত। এখন শুধু দাঁড়িয়ে আছে সামান্য কিছু জরাজীর্ণ ও জঙ্গলে ভরা অংশ। প্রাসাদে নেই আভিজাত্যের ছাপ। সেই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে এখনও কয়েকটি দেয়াল দাঁড়িয়ে রয়েছে। কৌশলে ভেঙে ফেলা হয়েছে প্রাসাদটির মূল অবকাঠামো। বিশাল মাঠের মাঝখানে তিন পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে শুধু তিনটি স্তম্ভ। স্তম্ভগুলোর গায়ে ভর করেছে বিভিন্ন প্রজাতির পরগাছা। ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে না থেকে তামলি প্রাসাদ নামের পুরাকীর্তিটি কীভাবে যেন চলে গেছে ব্যক্তিমালিকানায়!
ঠিক কবে এ প্রাসাদটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জানা না গেলেও এলাকাবাসীর মুখে প্রচলিত আছেÑপ্রায় ৫০০ বছরের পুরোনো। পুরাকীর্তিটি সংরক্ষণের অভাবে এর ইতিহাস সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায় না। এমনকি রাজশাহীর অনেকেই এ স্থানটির অতীত সম্পর্কে জানে না। অতীতের জাঁকজমকপূর্ণ ইতিহাস খুঁজতে চাইলে জঙ্গলে ভরা জীর্ণ প্রাসাদের প্রবেশপথটুকুও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
লোকমুখে প্রচলিত আছে- মুঘল আমলে পশ্চিমবঙ্গের কিছু পান ব্যবসায়ী পান ও ওষুধের ব্যবসা করতেন। সে সময় তারা ভারতের বিহার ও উত্তর প্রদেশে রাজশাহীর সুস্বাদু পান পাঠাতেন। একচেটিয়া ব্যবসা করার ফলে তারা হঠাৎই অনেক টাকার মালিক হয়ে যান। এরপর পবা উপজেলায় প্রাসাদ নির্মাণ করেন। এমনই একটি জমিদারবাড়ি ছিল এ তামলি প্রাসাদ।
তামলি রাজা মূলত কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন না। যারা পান ব্যবসা করতেন এবং এ ব্যবসার মাধ্যমে জমিদারি গড়ে তুলেছিলেন তাদেরই তামলি বা তাম্বূল রাজা বা জমিদারের মর্যাদা দেওয়া হতো।
পান চাষের পাশাপাশি তারা কৃষককে সুদ দেওয়া শুরু করে। কৃষকের কাছ থেকে ৩৭ শতাংশ পর্যন্ত তারা সুদ আদয় করত। উচ্চ সুদি কারবার ছিল তাদের আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস। শেষ পর্যন্ত গর্ভবতী নারীরাও এ তামলি রাজার নির্যাতন থেকে রেহাই পাননি।
অত্যাচারীরা কখনই ক্ষমা পায়নি। ১৯০৯ সালের দিকে তাহেরপুরের রাজা শিব শিখরেশ্বর স্থানীয় নির্যাতিত প্রজাদের নিয়ে তামলি রাজাদের ওপর আক্রমণ করে বসেন। উচ্ছেদ করা হয় তামলি রাজাদের। পরে তামলি রাজাদের বা তাদের বংশধরদের কী হয়েছিল জানা যায়নি।
তামলি রাজাদের অত্যাচার-নিপীড়নের কথা তুলে ধরে স্থানীয়রা জানায়, সুদ পরিশোধ করতে গেলে সুদের টাকা নিয়ে কৃষককে আপ্যায়নের নামে এটাওটা খাইয়ে কৌশলে আবারও নতুন ঋণের জালে জড়িয়ে ফেলত তামলি রাজারা। রাজার কাছ থেকে নেওয়া ঋণ শোধ দেওয়া কারও পক্ষেই সম্ভব ছিল না। ফলে কৃষকের উৎপাদিত পান নামমাত্র মূল্যে কিনে নিতেন তামলি রাজা। এভাবেই তারা এ অঞ্চলের কৃষককে যুগের পর যুগ শোষণ করে গেছেন।