বাসন্তি সাহা
প্রকাশ : ০১ মে ২০২৪ ১০:১০ এএম
আপডেট : ০১ মে ২০২৪ ১০:১৫ এএম
নারীকে বাধার প্রাচীর ভেঙে বেরিয়ে আসতেই হবে। কারণ অধিকার প্রতিষ্ঠা ও ক্ষমকতায়নের কোনো সংক্ষিপ্ত পথ নেই। ছবি : আরিফুল আমিন
চার ছেলেমেয়ে আর অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে ময়মনসিংহের ফুলপুর থেকে ঢাকায় আসেন কুলসুম বেগম (৫১)। বাড়িতে চায়ের দোকান ছিল স্বামীর। স্বামীর টিবি রোগ ধরা পড়লে কেউ তার দোকানে চা খেতে আসত না। বাধ্য হয়ে গ্রাম ছাড়তে হয় কুলসুমকে। ঢাকায় এসে পাঁচ-ছয়টি বাড়িতে ছুটা কাজ শুরু করেন। এভাবে কেটে গেছে দীর্ঘ ২০ বছর। দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। দুই ছেলে এখন গার্মেন্টসে কাজ করে। ছেলে ও তারটা মিলিয়ে পরিবারের আয় এখন ৩৫ হাজার টাকার মতো। গ্রামে নিজের ভিটেয় ঘর তুলেছেন। ইচ্ছে আছে আগামী ঈদে যে বোনাস পাবেন তা দিয়ে আলাদা করে বাথরুম করার। বছরে দুবার এক সপ্তাহের জন্য বাড়ি যান তারা। তবু তাদের একটা ঠিকানা আছে। একদিন ঢাকার এ বস্তিজীবন ছেড়ে ফিরে যাবেন গ্রামে।
কুলসুম বেগম লেখাপড়া জানেন না, কিন্তু পরিবারের সিদ্ধান্ত তিনি নিজেই নেন। তার কথা সবাই মেনে নেয় কেনÑজানতে চাইলে বলেন, ‘মানবে না কেন! সংসারে সব খাওয়ানোর দায়িত্ব আমার। এই যে ঈদের ছুটিতে ছেলেরা গ্রামে গেলে, ফিরল যে-যার মতো করে। কারও চিন্তা নেই ঠিক সময়ে কাজে না গেলে মজুরি পাবে না। কিন্তু আমার সে চিন্তা আছে তাই আমি ছুটি থেকে এসেই কাজে ফিরেছি, কারণ আমার মাস শেষে ঘর ভাড়া আর সংসারের বাজারের চিন্তা রয়েছে।’
অর্থনৈতিক উপার্জন নারাীকে এক ধরনের স্বাধীনতা দেয়, দেয় নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষমতা- এটাই ক্ষমতায়ন। বিশেষ করে অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নারীর সম্পদ ও আয় উপভোগ করে মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের স্বাধীনতা দেয়। কিন্তু ক্ষমতায়ন একটা প্রক্রিয়া; এটা নারী এক দিনে অর্জন করতে পারে না। এজন্য রাজনৈতিক ও সামাজিক সুরক্ষার দরকার হয়।
দুই.
কয়েক দিন আগে একটি ছবি দেখলাম সমাজমাধ্যমে মা সন্তানকে জমিতে শুইয়ে রেখে ফসল কাটছে। তার কোন শ্রমের মজুরি সে পায়Ñকেবল ধান কাটার নাকি সন্তানকে ওখানে শুইয়ে রাখার, নাকি সন্তানের যে উষ্ণ বিছানাটুকু পাওয়ার কথা ছিল তার। আমি একসময় একটা অফিসে কাজ করতাম। আমার সঙ্গে কাজ করত শিরিন। ও ওর মেয়েকে নিয়ে অফিসে আসত। বাচ্চাটাকে শুইয়ে রাখত থালাবাটি ধোয়ার সেই কলের ধারে। বলেছিলাম, নিয়ে এসো ওকে। গেস্টরুমে শুইয়ে দাও। সাহস করেনি। অনেক অফিসেই তো বাচ্চাদের জন্য ক্রেশ থাকে, সেখানে কি অফিসের সাপোর্ট স্টাফের বাচ্চাও থাকতে পারে! জানি না দেখিনি আমি।
একদিন সকালে মোমেনা কাজে এসে বলল, মনিরুলকে (৬) বাড়িতে আম্মার কাছে রেখে এসেছি। কেন? গত পরশু পানিতে পড়ে গিয়েছিল, এক লোক দেখে তুলেছে। আর আমি না থাকলে এ ঘর-ও ঘরে সে ঘুরতে থাকে, মানুষ বিরক্ত হয়। তাই তাকে রেখে এসেছি! তোমার কষ্ট হবে না? হলে কী করব! সারা দিন মানুষের বাড়িতে কাজ করি! ওকে কে দেখবে! আম্মা একটা মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেবে মনিরুলকে।
একজন নারী শ্রমিক যখন মা তখন তার কোন শ্রমের মজুরি সে পায়Ñতার বাচ্চাকে অনিরাপদে রেখে কাজ করতে আসার যে কান্না তার? বাচ্চাটার বঞ্চনার, নাকি কেবল তার শ্রমের?
তিন.
সম্প্রতি নারীর গৃহস্থালি কাজের অর্থনৈতিক মূল্য নির্ধারণের সুপারিশ করেছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। এর আগে গত বছরের এপ্রিলে জিডিপিতে নারীর গৃহস্থালি কাজ অন্তর্ভুক্তির নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নারী উন্নয়ন নিয়ে যারা কাজ করছেন তাদের মতে, নারীর অর্থনৈতিক কাজে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা গৃহস্থালি কাজ। কোনো অর্থনৈতিক সুবিধা বা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার আশা না রেখেই নারী গৃহস্থালি কাজ করেন। তাদের এ কাজ উৎপাদনের জাতীয় হিসাব অথবা জাতীয় আয় পরিমাপের পদ্ধতির (এসএনএ) বাইরে থাকে। যদিও জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
নারীর গৃহশ্রমের মূল্য দেওয়া নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, নারীকে যদি গৃহশ্রমে মজুরি দেওয়া হয় তাহলে নারী সংসারে নিজের অবস্থান হারাবে। নিজের সংসার বলে নারীর যে আত্মতৃপ্তি তা থাকবে না।
সংসারে নারীর যে শ্রম বিশেষ করে গ্রামীণ নারীরা পরিবারের কল্যাণে অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেন। প্রায়ই দিনে ১৬ ঘণ্টা কাজ করেন। এর পরও তারা অদৃশ্য ও অবমূল্যায়িত থাকেন। তাদের প্রাপ্য মর্যাদা তাদের দেওয়া হয় না। তাদের এ অদৃশ্য অবদান জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত।
মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির তথ্য অনুযায়ী, ৭৪১টি ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানের ঋণগ্রহীতার ৯১ শতাংশ নারী। এরা প্রমাণ করে দেখিয়েছেন ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবহার করে তারা তাদের পুরুষ সঙ্গীর মতোই উৎপাদনশীল ও উদ্যোগী হতে পারেন। কিন্তু ভূমি, ঋণব্যবস্থা, কৃষি উপকরণ কিংবা বাজার কোনোখানেই তাদের সমান প্রবেশাধিকার নেই। কৃষিতে বেশিরভাগ নারীর অবদান অদৃশ্য থাকে; যা ‘সংসারের কাজ’ হিসেবে পরিগণিত করা হয়। আমাদের আইন, নীতি ও সামাজিক চর্চা সম্পত্তিতে নারীর মালিকানার বিষয়টি সমর্থন করে না। বেশিরভাগ নারী তাদের প্রথাগত গৃহস্থালির কাজ ও পরিবারের যত্ন নেওয়ার নির্ধারিত ভূমিকায় যুক্ত করেন।
চার.
সময় পাল্টাচ্ছে পৃথিবীজুড়েই। একদিকে সমাজমাধ্যমে সত্যাসত্য তথ্যপ্রবাহ, অন্যদিকে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিকাশ, মুক্তবাজার; সবকিছু মানুষকে সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক চূড়ান্ত সংকটে পৌঁছে দিয়েছে। নারীর জন্য এ সংকট আরও বহুমুখী হয়েছে। একদিকে বেড়েছে সংসারের প্রয়োজনে বাইরে বেরিয়ে কাজ করার প্রয়োজন, ধর্মের প্রভাব আর সামাজিক নিরাপত্তাও প্রভাব ফেলছে তাদের অবাধ চলাফেরায়। ফলে নব্বইয়ের দশকে যে সামাজিক নিরাপত্তা একজন নারীকে ছায়া দিত তা অনুপস্থিত। অর্থনৈতিক শক্তিই রাজনীতির ওপর চেপে বসেছে। ফলে নৈতিকতা ও সম্মিলিত হওয়ার শক্তি মানুষের কমে যাচ্ছে; এ অবস্থার সবচেয়ে অসহায় শিকার নারী। নারীর ওপর চেপে বসে নানানরকম বিধিনিষেধ। কিন্তু নারীকে এ বাধার প্রাচীর ভেঙে বেরিয়ে আসতেই হবে; কারণ অধিকার প্রতিষ্ঠা, ক্ষমতায়ন- এর কোনো সংক্ষিপ্ত পথ নেই।
লেখক : কোঅর্ডিনেটর, রিসার্চ ও ডকুমেন্টেশন দ্বীপ উন্নয়ন সংস্থা