× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

হাওরে ধান কাটা উৎসব

আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি

সাইফুল হক মোল্লা দুলু, মধ্যাঞ্চল

প্রকাশ : ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ১০:৩৬ এএম

আপডেট : ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ১৮:০১ পিএম

কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলে শুরু হয়েছে ধান কাটার উৎসব

কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলে শুরু হয়েছে ধান কাটার উৎসব

কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলসহ পুরো জেলায় শুরু হয়েছে ধান কাটা উৎসব। হাওরের পাড়ে পাড়ে কৃষাণ-কৃষাণীর যূথবদ্ধ কর্মচাঞ্চল্যে সরব ও মুখরিত হয়ে উঠেছে প্রতিটি জনপদ। একদিকে মাঠে মাঠে কৃষিশ্রমিকদের ধান কাটার ব্যস্ততা, অন্যদিকে হাওরের পাড়ে বা বাড়ির সম্মুখস্থ বিশাল চত্বরে ধান মাড়াই, ধান শুকানো ও শুকনো ধান ঝেড়ে গোলায় তোলার নান্দনিক আয়োজন পুরো হাওর জনপদে তৈরি করেছে উৎসবের সমারোহ। এ আয়োজন অন্য যেকোনো বছরের তুলনায় এবার একটু বেশিই মনে হচ্ছে।

এসব অঞ্চলে এমন কৃষকও আছেন যাদের উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ তিন থেকে চার হাজার মণও ছাড়িয়ে যায়। সব ধান সংরক্ষণ করার মতো ব্যবস্থা না থাকায় অনেকে পরিবারের বাৎসরিক খোরাকি রেখে বাকি ধান মাড়াইস্থলেই বিক্রি করে দেন। এ সময় দূর-দূরান্তের মহাজন ও চাতাল মালিকরা ধান কেনার জন্য হাওরাঞ্চলে ভিড় জমান। বোরো ফসলকে কেন্দ্র করে প্রতি বছরই কৃষকদের মধ্যে আনন্দ-উদ্দীপনার অদ্ভুত শিহরন জেগে ওঠে। বোরো মৌসুমে জিরাতির সমাগমও বেড়ে যায়। যারা কৃষকের জমি টাকার বিনিময়ে পত্তন নিয়ে চাষ করেন তাদের বলা হয় জিরাতি। এই জিরাতিরা আসেন দূর-দূরান্ত থেকে। তারা ফসল কাটার মৌসুমে জমির পাশে ছোট ছোট অস্থায়ী ঘর তুলে সেখানে রাত যাপন করেন। সঙ্গে নিয়ে আসেন প্রয়োজনীয় সংখ্যক কৃষিশ্রমিক। এসব জিরাতি ও কৃষিশ্রমিকও এ মৌসুমে প্রচুর ধান পেয়ে থাকেন। এ ছাড়া এই মৌসুমে ধানের বিনিময়ে কৃষকের জমিতে ধান কাটার জন্য সুদূর ময়মনসিংহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, শেরপর, জামালপুর, নেত্রকোণা, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, গাইবান্ধা থেকেও দরিদ্র কৃষিশ্রমিকরা হাওরের বিভিন্ন উপজেলায় এসে অস্থায়ী ডেরা তুলে বসবাস করেন। মৌসুম শেষে ধান কাটার পারিশ্রমিক হিসেবে এরাও পেয়ে থাকেন প্রচুর পরিমাণ ধান।

প্রতি বছর চৈত্র-বৈশাখ এলেই কৃষকদের মধ্যে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা কাজ করে। এবারও কৃষকরা সে আশঙ্কার বাইরে ছিলেন না। তবে এ বছর প্রকৃতি কৃষকদের প্রতি বিরূপ ছিল না। আশঙ্কা থাকলেও এখন পর্যন্ত জেলায় বড় ধরনের ঝড়, অকাল বন্যা কিংবা শিলাবৃষ্টি হয়নি। ফলে বিশাল-বিস্তীর্ণ হাওরের বোরো জমিতে এবার যেন প্রকৃতিমাতা দুই হাত উজাড় করে ঢেলে দিয়েছেন কৃষকের বহু কাঙ্ক্ষিত সোনালি ফসল। যেদিকেই চোখ যায় সোনারঙ ধানের উজ্জ্বল ঝিলিক দৃষ্টির সীমানায় আলো ছড়িয়ে দেয়। 

ধান কাটা শেষে মাথায় করে বাড়ি ফিরছেন কৃষক

অনেক জমিতে দেখা যায় দিনমজুররা কাস্তে হাতে ধান কাটছেন, অনেকে আবার ধান কাটার কাজ সারছেন হারভেস্টার মেশিনের সাহায্যে। এবার সারা দেশের মতো কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকায়ও চলছে তীব্র তাপপ্রবাহ। এই তাপপ্রবাহ জনজীবনে অস্বস্তি তৈরি করলেও বোরো চাষিদের ভাগ্যে নিয়ে আসে প্রকৃতির লক্ষ্মীমন্ত আশীর্বাদ। রৌদ্র আর গরমে এ বছর মাঠের ধান পরিপুষ্ট হওয়ার যেমন সুযোগ পেয়েছে তেমনি মৌসুমের শুরুতেই জমির ফসল পেকে গেছে। 

এ বছর কিশোরগঞ্জের ইটনা, অষ্টগ্রাম, মিঠামইন হাওরসহ নিকলী, বাজিতপুর, তাড়াইল, করিমগঞ্জ, কটিয়াদী এবং উজান এলাকার অন্যান্য উপজেলায়ও বোরোর বাম্পার ফলন হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ধানের দামও আশা দেখাচ্ছে। মাড়াইস্থলে প্রতি মণ ধান বিক্রি হচ্ছে সাড়ে আটশ থেকে সাড়ে নয়শ টাকায়। হাওর পাড়ে পাড়ে এখন কেবল আনন্দের উদ্দীপনা।

সরেজমিনে বিস্তীর্ণ হাওরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বোরোর বাম্পার ফলনে কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকার হাট-বাজার, মাঠ-ঘাট, বাড়িঘরে লোকজ শিল্পীর গান বাজছে। ধানে ধানে বাড়িঘর, আঙিনা ভরা। কেউবা গান শুনছে, কেউবা গাইছে। পাশপাশি ধান কাটার কাজও করছে। দোকানিরা পণ্যের পসরা সাজিয়ে করছেন বেচাকেনা। এ যেন স্বপ্নের সোনালি ধানের বাংলাদেশ।

ধান মাড়াইয়ে ব্যবহার হচ্ছে আধুনিক যন্ত্রপাতি

ফাল্গুন-চৈত্রের অভাব আর ক্ষুধার যন্ত্রণা কৃষাণ-কৃষাণীরা ভুলে গিয়ে সোনালি ধান ভরছে তার গোলায়। একসঙ্গে চলছে ধান কাটা, মাড়াই, শুকানো ও ভাঙানোর কাজ। গ্রামে গ্রামে এখন এমন অভূতপূর্ব দৃশ্য। টোপা বোরো ধানের সুঘ্রাণ, চ্যাপা-শুঁটকির ভর্তায় খাওয়ার ধুম লেগেছে হাওরের গ্রামগুলোতে। দাওয়াল ও কৃষাণ-কৃষাণীর দল মাঠে তপ্ত দুপুরে চ্যাপা শুঁটকি দিয়ে নতুন ধানের ভাত খেয়ে ফুর্তিতে কাজ করছে। 

গভীর হাওর মিঠামইন উপজেলার ঢাকী ইউনিয়নের ঢাকী বাজারে গত বুধবার গিয়ে দেখা যায়, নতুন ধানে বাজার সয়লাব। দামও বেশ ভালো। ৯০০ টাকা থেকে ৯২০ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে। চারিগ্রাম গ্রামের কৃষক জয়নাল মিয়া জানান, ফাল্গুন-চৈত্র মাসে তিন বেলা পর্যাপ্ত খাবার জোটেনি। কোনো কোনো দরিদ্র পরিবার অভাবের মাসে এক বেলা মিষ্টি আলু, খিরা এসব খেয়ে ছেলেমেয়ে নিয়ে কোনো রকমে ছিলাম। চার মণ ধান বিক্রি করে অনেক দিন পর মাছ ও ছেলেমেয়েদের জন্য জামা-কাপড় কিনলাম। 

ইটনা উপজেলার বরিবাড়ি গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, প্রায় ১০০ কৃষক নতুন ধান বিক্রি করে ৬০ হাজার টাকায় একটি বিশাল ষাঁড় কিনেছেন। সেটি জবাই করে ৫০০ টাকা করে নিজেদের মধ্যে মাংস ভাগাভাগি করেছেন। 

নিকলী উপজেলার ছাতিরচর গ্রামের কৃষক মিয়াফর মিয়া (৪২) বলেন, ফাল্গুন-চৈত্র মাসে ভালো খেতে পাইনি। চাষাবাদ মৌসুমে মাংস খাইনি। তাই মাংস কিনলাম। পরিবার নিয়ে মাংস দিয়ে পেটভরে নতুন চালের ভাত খাব। 

মাড়াই শেষে সংগৃৃহিত ধান

ইটনা বাজারের ব্যবসায়ী চন্দন বর্মণ জানান, গত তিন মাস কোনো বেচাবিক্রি ছিল না। নতুন ধান ওঠায় সবাই নতুন জামা-কাপড় কিনছে। বেচা বিক্রি কিছুটা হচ্ছে। তবে, পুরো ধান গোলায় তুলতে পারলে এবার সব পণ্যের বাজার জমবে ভালো বলে মনে হয়। দর্জি রাধাবর্মণ জানান, প্রতিদিন ২-৩টি শার্ট ও সালোয়ার কামিজের ফরমায়েশ পাচ্ছি। 

ইটনা উপজেলার শিমুলকান্দি গ্রামের নৌকার মাঝি আলতাব মিয়া জানান, ভালো ফলন হওয়ায় এবার নৌকার ব্যবসা ভালো। যাত্রী ও ধান পরিবহন করে প্রতিদিন গড়ে ৫০০ টাকা আয় হচ্ছে। বৈশাখে ভালো উপার্জনে আমি ফাল্গুন-চৈত্রের অভাবের যন্ত্রণা ভুলে গেছি। 

ইটনা সদর ইউনিয়নের আঙুর মিয়া জানান, দুই একর জমিতে ১৮০ মণ ধান পেয়েছি। গত বছর ধান হারিয়ে হতাশ ছিলাম। এবার সেই দুঃখ আর নেই। স্ত্রীকে শাড়ি, ছেলেমেয়েদের নতুন জামাকাপড় কিনে দেব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। 

গাজীপুর কাপাসিয়া থেকে কিশোরগঞ্জের হাওরে ধান কাটতে এসেছেন এক দল শ্রমিক। তাদের মধ্যে সালাহউদ্দিন জানান, ভালো ফলন হওয়ায় এবার আমাদের কিছু আয় হবে। গড়ে ২৫ মণ করে ধান পাব আশা করি। গত কয়ক বছরের চেয়ে আয় দ্বিগুণ হবে। এ ধানে আমাদের আগামী আট মাসের খাবারের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। 

ধান বিক্রির টাকায় ইটনা বাজারে অডিও-ভিডিও সিডি ব্যবসায়ী আঙ্গুর মিয়া দোকান ঘরে নতুন মালামাল তুলেছেন। দেদার বিক্রি হচ্ছে সিডি ক্যাসেট। তার আশা, ব্যবসা ভালো হবে। কারণ, মানুষের হাতে ধান আছে।

কেওয়ারজোর ইউপি চেয়ারম্যান মো. আবুল কাসেম বলেন, কৃষিশ্রমিক, বর্গাচাষি, জোতদার সবাই এবার ফলনে সন্তুষ্ট। এ বছর এলাকার সবার দুই বেলা খাবাবের নিশ্চয়তা হয়েছে। নতুন বোরো ধান পেয়ে সবাই ফাল্গুন-চৈত্রের দুঃখ ভুলে গেছেন। এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি উৎপাদন হয়েছে। 

হাওরের বিভিন্ন বাজারের স্টুডিওতে গিয়ে দেখা গেছে, ছেলেমেয়েরা খুশিতে ছবি তুলছে। স্টুডিও ব্যবসায়ী ওয়াজিদ উদ্দিন জানান, ব্যবসা ছেড়ে দেওয়ার কথা চিন্তা করেছিলাম। বৈশাখী ধান আমার চিন্তাধারা পাল্টে দিয়েছে।

ইটনার সংস্কৃতিকর্মী সাইফুল মাস্টার জানান, এবার ধান কাটার পর এবং তপ্ত আবহাওয়া কমলে হাওরের গ্রামগুলোতে নতুন ধানের আমেজে রাতে জারি ও পালাগানে অসংখ্য নারী-পুরুষর সমাগম হবে। এবার আমরাও নানা কর্মসূচির আয়োজন করব। গভীর রাত পর্যন্ত চলবে পালাগানের আসর।

গত বছরের তুলনায় এবার ফলন হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ

ফিরে আসার সময় দেখলাম ইটনা উপজেলার বড়িবাড়ি বাজারে নদীর পাড়ের খালি জায়গায় বসেছে গান শোনার আসর। সিডিতে বাজছে গান। বৃদ্ধ, কিশোর, তরুণ-তরুণীরা গান শুনছে। তাদের আনন্দের সীমা নেই। আমাদের চামড়াঘাট অভিমুখী নৌকা থেকে শোনা যাচ্ছে শিল্পী মমতাজের গান ‘আমার ঘুম ভাঙাইয়া গেলোরে মরার কোকিলে।’ দূরত্ব বাড়ছে গানের সুর ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে উঠছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ আব্দুস সাত্তার প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, কিশোরগঞ্জে এবার ১ লাখ ৬৭ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। ধানের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১২ লাখ ৫৩ হাজার ৬২৫ মেট্রিক টন। আশা করা হচ্ছে, এ থেকে চাল পাওয়া যাবে ৮ লাখ ৩৫ হাজার ৭৫০ মেট্রিক টন। হাওরাঞ্চলের ৪৫ শতাংশ ধান এরই মধ্যে কাটা হয়ে গেছে। বন্যার আশঙ্কায় এবার কৃষক আগাম জাতের ধান আবাদ করছে, তাছাড়া গরমের কারণে ধান আগেভাগে পেকে গেছে। এ কারণে আগেই কাটা শুরু হয়েছে। আবহাওয়া এ অবস্থায় থাকলে কয়েক দিনের মধ্যে সমুদয় ধান কাটা শেষ হয়ে যাবে। সারা জেলায় চাহিদা রয়েছে পৌনে চার হাজার মেট্রিক টন। বাকি ধান উদ্বৃত্ত থাকবে।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা