কৃষ্ণ ব্যানার্জী, সাতক্ষীরা
প্রকাশ : ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ১২:৫৯ পিএম
তারা সবাই জীবন সংগ্রামী। প্রয়োজনের খাতিরে সংসার ও সন্তানদের দায়িত্ব তুলে নিয়েছেন আপন কাঁধে। তাদের সম্মানিত করেছে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর
সমাজ, পরিবারের নানা বাধা কাটিয়ে সফলতার মুখ দেখেছেন দেবহাটা উপজেলার পাঁচ নারী। তৃণমূল থেকে উঠে আসা এই নারীদের মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর ‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’ কর্মসূচির আওতায় খুঁজে করেছে। তাদের রয়েছে আলাদা কাহিনী।
অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে ওঠা এমনই একজন নুর নাহার বেগম। উপজেলার পূর্বকুলিয়ার বাসিন্দা নুর নাহার বলেন, ‘বিয়ের পর স্বামী আমার সঙ্গে বেশ কিছুদিন ভালো ব্যবহার করে। তার পর থেকে স্বামীর নির্ধারিত উপার্জন না থাকায় আমার ওপর যৌতুকের জন্য নির্যাতন শুরু করে। দরিদ্র পিতা যৌতুক দিতে না পারায় নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে থাকে। এরই মধ্যে আমি তিন পুত্রসন্তানের মা হই। তারপরও নির্যাতন কমেনি। একপর্যায়ে বাবা বাড়ি চলে এসে নতুন করে জীবন শুরু করি। শত কষ্টের মধ্যেও ছেলেদের লেখাপড়া বন্ধ হতে দিইনি। তারা প্রত্যেকেই লেখাপড়া শিখে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সবাই প্রতিষ্ঠিত। বড় ছেলে আজহার উদ্দীন এমএ পাস করে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে চাকরি করছে। মেজো ছেলে সালাউদ্দীন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ পাস করে লংকাবাংলা ফাইন্যান্স লিমিটেডে কর্মরত আর ছোট ছেলে একেএম মহিউদ্দীন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করে চাকরিপ্রার্থী। বর্তমানে আমি আমার সন্তানদের নিয়ে অনেক ভালো আছি।’
অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী নারী রুবিনা আক্তার (২৬)। তিনি দেবহাটার, চণ্ডীপুর গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে সন্তান। মাত্র ১৪ বছর বয়সে নবম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় একই গ্রামের এক বেকার ছেলেকে তিনি বিয়ে করেন। স্বামী দিনমজুরের কাজে যোগ দেন আর তিন বাড়িতে হাঁস-মুরগি পালন ও পড়ালেখা চালিয়ে যেতে থাকেন। এর মধ্যেই জন্ম নেয় এক কন্যাসন্তান। কঠিন সময়ের মধ্যে ২০১৫ সালে সার্স এনজিওতে স্বাস্থ্য পরিদর্শকের কাজ নেন রুবিনা। ২০১৬ সালে জিপিএ ৪.৯৬ পেয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। একদিকে চাকরি, অন্যদিকে সংসার ও পড়ালেখা- ঠিকমতো সামাল দিতে পারছিলেন না। তাই বাড়িতে বাড়তি আয়ের জন্য ছোট পরিসরে মুরগি পালন শুরু করেন। ঋণ নিয়ে বড় আকারে খামার তৈরি করেন এবং স্বামীকে একটি মাছের ঘের লিজ নিয়ে দেন। তা থেকে লাভবান হওয়ায় ঋণ পরিশোধ করে নিজেই পুঁজি গঠন করেছেন। বর্তমানে তার বাড়িতে সমৃদ্ধ খামার ও পুষ্টিবাগান থাকায় উৎপাদিত পণ্যে পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে অর্থ আয়ের পথ সৃষ্টি হয়েছে।
সফল জননী মিতা রানী পাল। উপজেলার কুলিয়া ইউনিয়নের গুরুগ্রামের অশোক পালের স্ত্রী। স্বামী কৃষক। অভাবের সংসারে এক ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে জীবনসংগ্রাম শুরু হয় তার। মিতা রানী বলেন, ‘আমার স্বামী শিক্ষাসচেতন না হওয়ায় ছেলেমেয়েদের লেখাপড়াসহ সব দায়িত্ব নিজেই পালন করতাম। ঘরে হাঁস-মুরগি পালন করে স্বল্প আয় দিয়ে সন্তানদের খাতা-কলম ও পড়ালেখার খরচ জোগাতাম। ছেলেমেয়েরা স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সাফল্যের সঙ্গে পড়াশোনা করেছে। বড় মেয়ে সুমা মণি পাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে এমএসএস করে কাস্টমস অফিসার পদে কর্মরত। ছেলে সঞ্জয় পাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিভাগে এমএ করে ঝিনাইদহে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট পদে কর্মরত। আর ছোট মেয়ে রমা রানী পাল সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস পঞ্চম সেমিস্টারে অধ্যয়নরত।’
শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী সালমা সুলতানা। তিনি উপজেলার কামটা গ্রামের শওকত মীরের মেয়ে। সালমা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তি হওয়ার পরও কোনো কিছু তাকে থামিয়ে রাখতে পারেনি। দিনমজুর বাবার সংসারে অতিকষ্টে বড় হয়েছেন। কিন্তু দারিদ্র্য ও শারীরিক অক্ষমতার মাঝেও সাহস না হারিয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যান। এইচএসসি পাস করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে উত্তীর্ণ হন। সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান কামটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। শিক্ষকতার পাশাপাশি উচ্চতর ডিগ্রির জন্য লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছেন এই নারী।
সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখা নারী উত্তরা দাশ। তিনি উপজেলার মাঝপারুলিয়া গ্রামের জগবন্ধু দাশের স্ত্রী। নিম্নবিত্ত পরিবারের গৃহবধূ হওয়া সত্ত্বেও সমাজসেবামূলক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। উত্তরা দাশ বলেন, ‘আমি নিজের উদ্যোগে এলাকায় কয়েকটি বাল্যবিয়ে বন্ধ করেছি। শিশুশ্রম ও ইভ টিজিং প্রতিরোধেও কাজ করছি। সমাজের পিছিয়ে পড়া শ্রেণি বিশেষ করে দলিত সম্প্রদায়ের মানুষের অধিকার আদায় ও সার্বিক কল্যাণের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে দরিদ্র অসহায় মানুষের ভাতা প্রাপ্তিতে সহযোগিতা করি। অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আয়বর্ধনমূলক প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি করি। শিশুদের স্কুলগামী করার লক্ষ্যে গ্রামে পিতা-মাতাকে উৎসাহিত করা, কিশোরীদের বয়ঃসন্ধিকালীন স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে সেবিকার ভূমিকা পালন করছি। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় করণীয়, মায়ের গর্ভকালীন পরিচর্যা, শিশুর পুষ্টি নিশ্চিতকরণ ও বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে উঠান বৈঠকের মাধ্যমে জনসাধারণের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছি।