মো. মাসুদ, চবি
প্রকাশ : ২১ এপ্রিল ২০২৪ ১৫:১৫ পিএম
প্রবল ইচ্ছাশক্তির জোরে শ্রমিক থেকে রিয়াদ আজ গ্র্যাজুয়েট
কথায় আছে ‘ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়’। ফেনীর একটি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম রিয়াদের। ছোটবেলা থেকেই পরিবারের ভরণপোষণে সাহায্য করতে হতো। পড়াশোনা শেষ না করেই কাজে নেমে পড়েন। কিন্তু রিয়াদের অদম্য ইচ্ছা তাকে আবারও পড়াশোনায় ফিরিয়ে আনে।
দিনে কাজ আর রাতে কলেজের পড়াশোনা। কাজের ক্লান্তি ও অসুবিধা সত্ত্বেও হার মানেননি। প্রবল ইচ্ছাশক্তির জোরে শ্রমিক থেকে রিয়াদ আজ গ্র্যাজুয়েট। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে সিজিপিএ ৩.৫৮ পেয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে সম্মান (স্নাতক) শেষ করেছেন এবং একই বিভাগে বর্তমানে স্নাতকোত্তরে পড়াশোনা করছেন।
২০১৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি পকেটে মাত্র ৫০০ টাকার একটি নোট নিয়ে পড়াশোনা চিরতরে বিদায় জানিয়ে ফেনী থেকে চট্টগ্রাম শহরে আগমন রিয়াদের। উদ্দেশ্য থাই গ্লাসের কাজ করা। সেদিন এক বাসায় ওস্তাদের সঙ্গে কাজে যান। ওই বাসার পড়ুয়া মেয়েটাকে তখন টিউটর প্রাইভেট পড়াচ্ছেন, অন্য পাশে রিয়াদ আর তার ওস্তাদ মিলে কাজ করছেন। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পড়াশোনা ছেড়ে আসার কষ্টটা সেদিনই সবচেয়ে বেশি অনুভব করেছিলেন রিয়াদ।
গিয়াস উদ্দিন রিয়াদের বাড়ি ফেনী সদর উপজেলার ১০ নম্বর ছনুয়া ইউনিয়নের পশ্চিম ছনুয়া গ্রামে। সাত ভাইবোনের পরিবারে সবার ছোট রিয়াদ। তার শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি ছনুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ছনুয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১৫ সালে জিপিএ-৫ পেয়ে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এসএসসি পাস করেন। ছোটবেলা থেকেই মেডিকেলে পড়ার স্বপ্ন থাকলেও পড়াশোনার খরচ চালানোর সামর্থ্য ছিল না পরিবারের। কিছুদিন রাজমিস্ত্রির কাজও করেন এলাকায়। পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে রোজগারের খোঁজে চট্টগ্রাম পাড়ি জমান।
গত ৩ এপ্রিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতার অনার্স ২০২২-এর ফলাফল প্রকাশিত হয়। এতে সিজিপিএ ৩.৫৮ সম্মিলিত পঞ্চম হোন রিয়াদ। সেদিন নিজের সংগ্রামী জীবনের কথা তুলে ধরে সমাজমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করেন।
সংগ্রামী জীবনের এক বছর পর আবারও পড়াশোনায় ফেরার বিষয়ে রিয়াদ লেখেন, ‘একদিন নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটিতে কাজ করছিলাম। কাজ শেষ করতে রাত ১২টা বেজে গেছে, লেট হয়ে যাওয়ায় মালিকপক্ষের কটুকথা শুনতে হলো। ওনার ছেলের এইচএসসি টেস্ট পরীক্ষা ছিল পরদিন। এ কাজে যেহেতু মেশিনের আওয়াজ বেশি, সেজন্য ছেলের পড়াশোনায় ডিস্টার্ব হয়েছিল। তাই আমাদের “গণ্ডমূর্খ” সম্বোধন করে এমন কিছু কথা শোনালেন তিনি, যা হজম করার মতো ছিল না। ব্যস, এটুকুতেই জেদ চেপে গেল। পড়াশোনা আবার শুরু করার সিদ্ধান্ত নিলাম। ’
পরে এক বছর লস দিয়ে ২০১৬ সালে নিজের বিভাগ পরিবর্তন করে চট্টগ্রাম কলেজে মানবিক বিভাগে ভর্তি হন রিয়াদ। সপ্তাহে দুই দিন ক্লাস করে বাকি সময়টুকু কাজ করতেন। রিয়াজুদ্দিন বাজারের চৈতন্য গলির এক আলুর গুদামের ওপর ছোট্ট একটা রুমে গাদাগাদি করে চারজনের সঙ্গে থাকতেন।
পরে বন্ধুর ভগ্নিপতির ফার্নিচারের দোকানে কাজ করার এবং বন্ধুর সঙ্গে একসঙ্গে থাকার সুযোগ আসে তার। ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে নন্দনকাননকে গুডবাই বলে দেন রিয়াদ। এরপর সকাল ১০টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত দোকানে ডিউটি করতেন। কলেজে গুরুত্বপূর্ণ কিছু থাকলে সেটা বন্ধুই বলে দিতেন। মালিকপক্ষের উদারতায় দোকানে বসেই ডিউটিরত অবস্থায় পড়াশোনা করে এইচএসসির পাট চোকান। মানবিক শাখায় এইচএসসিতেও জিপিএ-৫ পেয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করেন রিয়াদ।
পরে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে তিন মাসের জন্য বাড়ি পাড়ি জমান। টিউশনির পাশাপাশি নিজেকে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেন এবং সফল হন। নানান বাধাবিপত্তি আর প্রতিকূলতার পরও একজন শ্রমিক থেকে গ্র্যাজুয়েট রিয়াদ। রিয়াদ বিশ্বাস করেন, ইচ্ছাশক্তি এবং পরিশ্রম করার মানসিকতা থাকলে যেকোনো অসম্ভব সম্ভব করা যায়।
রিয়াদ ফেসবুকে লিখেছেন, ‘নন্দনকাননের একজন শ্রমিক থেকে আজকের এই গ্র্যাজুয়েট আমি হওয়ার গল্পে যাদের সামান্য হলেও অবদান রয়েছে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি! প্রাইমারি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব শিক্ষকের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি! শুকরিয়া আদায় করছি মহান সৃষ্টিকর্তার, যিনি আমাকে এত বেশি ধৈর্যধারণের ক্ষমতা দিয়েছেন।’
ভবিষ্যৎ স্বপ্ন নিয়ে জানতে চাইলে রিয়াদ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘এই যাত্রা কখনোই সহজ ছিল না। কখনও থাই গ্লাসের কাজ, কখনও রাজমিস্ত্রির কাজ, কখনও টিউশনি করেছি। টিকে থাকার জন্য যখন যেটা পেরেছি করেছি। ছোটবেলায় স্বপ্ন ছিল মেডিকেলে পড়ব। এখন আর তেমন কিছু নেই। পড়াশোনা শেষ করে ভালো কিছু করে পরিবারকে ভালো রাখাই মূল লক্ষ্য। আর মানুষের টাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছি, তাই দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে মানুষের জন্য কাজ করার ইচ্ছা আছে।’