হাসনাত মোবারক
প্রকাশ : ২০ এপ্রিল ২০২৪ ১৪:১৪ পিএম
আপডেট : ২০ এপ্রিল ২০২৪ ১৬:০৬ পিএম
সম্রাটের সময় কাটে বন্ধেুদের কাছ থেকে পাওয়া চিঠি পড়ে। ছবি : সুজিত সরকার
কবি মহাদেব সাহা প্রিয় মানুষটির কাছে আকুতি জানিয়ে মাত্র একটি চিঠির প্রত্যাশা করে লিখেছেন- এটুকু সামান্য দাবি চিঠি দিও, তোমার শাড়ির মতো অক্ষরের পাড়-বোনা একখানি চিঠি।’ অথচ মনজুর কাদের সম্রাটের কাছে তার বন্ধুরা লিখেছেন হাজার হাজার চিঠি। ঠিক কত চিঠি এসেছে সম্রাটের ঠিকানায়! তা তো প্রায় ৪ হাজার হবে। সত্তর বছর বয়সি এ মানুষটি এখনও হাতে লেখা চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ করেন। নতুন-পুরাতন সেই চিঠিগুলো তিনি সংরক্ষণে রেখেছেন অতি যত্নে। শুধু নিজে যে চিঠি পেয়েছেন তা কিন্তু নয়, তিনিও পত্র লিখে পাঠিয়েছেন বন্ধুদের কাছে। সেসব ফিরিস্তি জানতে পৌঁছাই তার সিরাজগঞ্জ শহরের রহমতগঞ্জ এলাকার বাড়িতে। চিঠির সংগ্রহ দেখে কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করি আপনার কাছে এত চিঠি এসেছে কিন্তু আপনি কত চিঠি পাঠিয়েছেন? হেসে বললেন, ‘এর সঠিক হিসাব বের করা কি সম্ভব! কপি তো রাখা হয়নি।’ এই বলে অ্যালবামের ভেতরে থাকা চিঠিগুলো বের করে দেখাতে দেখাতে বললেন, ‘আমার মতো অন্যরা কেউ কি এভাবে রেখেছেন। কত কত বন্ধুর সঙ্গে পত্রযোগাযোগ হতো। তাদের অনেকের সঙ্গে এখন আর যোগাযোগ নেই। কিন্তু তাদের চিঠিগুলো এখন স্মৃতি।’
বন্ধুদের পাঠানো চিঠি পাওয়ার মুহূর্তগুলো স্মরণ করে গল্পের
ঝাঁপি খুলে বসলেন। এর মধ্যে বের হলো তার মায়ের কাছে লেখা বাবার চিঠি। সেটি পরম
মমতায় দুই হাতের মুঠোয় আগলে ধরে বললেন, এটা তাদের ব্যক্তিগত দলিল।
ষষ্ঠ শ্রেণিতে পাঠ্যবইয়ে ‘পেনফ্রেন্ড’ গল্প পড়ে চিঠি লেখার প্রতি আগ্রহ জন্মে সম্রাটের। কিন্তু চিঠি লেখার আবেগ থাকলেও মনের কথাগুলো গুছিয়ে লিখতে না পারায় কাউকে পাঠাননি। স্মিত হেসে বললেন, চিঠি লেখা নিয়ে প্রথমে শঙ্কা কাজ করত। তবে নিজের কাছের আত্মীয়দের ছোট ছোট করে চিঠি লিখে পাঠাতেন। ছোটবেলা থেকেই তার পত্র লেখার অভ্যাস গড়ে ওঠে। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় নিয়মিত চিঠি পাঠাতে শুরু করেন।
তার সংগ্রহে থাকা রঙবেরঙের চিঠির খাম দেখিয়ে বললেন, এমন নান্দনিক ইনভেলাপে করে বন্ধুরা চিঠি পাঠাত। চিঠির ভাঁজ খুলে ঘ্রাণ শুঁকতাম। ঝরনা কলমে লেখা সেই চিঠির গোটা গোটা অক্ষরের দিকে তাকিয়ে সম্রাট স্মতিকাতর হয়ে বললেন, ‘পোস্ট অফিসের পিয়নের জন্য দৈনিক অপেক্ষা করতাম। কখন আসবে চিঠি! রুটিন করে চিঠি লিখে বন্ধুদের উত্তর পাঠাতাম।’
চিঠি লেখা কর্মটি তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। তার জীবনে
উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথা স্মরণ করে বলেন, এক দিনে তিনি বিশ্বের ছয়টি দেশের বন্ধুদের
পাঠানো ১২টি চিঠি পেয়েছেন। দেশগুলো- নেপাল, ভুটান, ভারত, জাপান ও পাকিস্তান। তাদের
কাছে তিনিও নিয়মিত পত্র পাঠাতেন।
বিদেশি বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগের ঠিকানা পেলেন কোথা থেকে তিনি?
তাই তো! হ্যাঁ, তখন পত্রপত্রিকা ও ম্যাগাজিনের রমরমা যুগ। দেশবিদেশ থেকে কত যে
ম্যাগাজিন প্রকাশ পেত! রেলস্টেশনে, বাসস্ট্যান্ডে এবং বইয়ের দোকানগুলোয় হরেক রকমের
পত্রিকা, ম্যাগাজিন পাওয়া যেত। সেগুলোয় পাঠকদের পত্রমিতালির জন্য ঠিকানা ছাপা হতো।
১৯৭৭ সাল। নারায়ণগঞ্জের বন্দর থেকে প্রকাশিত হয়েছে ‘মিতালী’ নামে একটি মাসিক ম্যাগাজিন। সে পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লেখা ছিলÑ‘আপনাদের আনন্দ দানের জন্য সর্বোপরি মনের মতো একটি পত্রমিতালী পত্রিকা প্রকাশ করার জন্য যে স্বপ্ন আমরা এত দিন মনে মনে পোষণ করেছি, তা অনেক বাধাবিপত্তি পেরিয়ে বাস্তবে রূপ পেল।’ এ পত্রিকার সদস্য হন সম্রাট। এখান থেকে নতুন বন্ধুদের ঠিকানা নিয়ে মনের কথা লিখে পাঠাতে শুরু করেন। পরিচয় হয় দেশবিদেশের অসংখ্য বন্ধুর সঙ্গে। এরপর খুঁজে পান ভারতের বিশ্বমিতালী সংঘ থেকে প্রকাশিত ‘লিপিমিতা’, ‘ইয়থ পেনপালস’, ‘ফ্রেন্ডশিপ’সহ বেশ কিছু পত্রিকা।
বন্ধুরা থাকেন দূরপরবাসে। কখনও সামনাসামনি দেখা হয়নি। মনের কথা
আদানপ্রদান চলে চিঠির মাধ্যমে। কোনো কোনো বন্ধু চিঠির সঙ্গে নিজের ছবি দিতেন। ১৯৭৭
সালে ভারতের বিহার রাজ্যের ধানবাদ জেলার পত্রমিতা সোমা দেবনাথ এবং জাপানের
পত্রমিতা ইরিকো হোনেসির সঙ্গে পরিচয় ঘটে। এরপর ইতালির পত্রমিতা লুরা সিরির সঙ্গে
যোগাযোগ হয়। এদের কারও সঙ্গেই সম্রাটের দেখা হয়নি।
পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের পত্রমিতা সূর্য্যকান্ত বিশ্বাসের
সঙ্গে পরিচয় হয় ১৯৮১ সালে। সূর্য্যকান্তই মূলত তার পত্রমিতার জীবনের মাইলফলক। এখন
পর্যন্ত তাদের যোগাযোগ অক্ষুণ্ন রয়েছে। দুজনের মধ্যে কত চিঠি যে চালাচালি হয়েছে
তার হিসাব নেই। ৪৩ বছরের বন্ধুত্বের জীবনে দুজনের সামনাসামনি কখনও দেখা হয়নি। একে অন্যকে
প্রতি মাসে অন্তত চারটি করে চিঠি লিখেছেন। হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, মেসেঞ্জারের এ
যুগেও তারা অন্যকে চিঠি লেখেন। এমনকি মোবাইল ফোনেও কথা হয়নি তাদের।
২০১৮ সালে এটিএন বাংলার এক অনুষ্ঠানে প্রথম কথা ও দেখা হয়
অনলাইনে ভিডিও লাইভের মাধ্যমে। সে সময়ই দুই বন্ধুর মধ্যে কথা হয়। ২০২০ সালে
সূর্য্যকান্তর বাড়িতে যাওয়ার জন্য ভিসা-পাসপোর্ট করেন সম্রাট। কিন্তু এর মধ্যে
করোনা এসে হানা দিল। আর যাওয়া হয়নি সেখানে।
বিদেশি বন্ধুদের কাছে চিঠি পাঠাতেন ইংরেজি ভাষায়। নিজে
ইংরেজিতে পারদর্শী না হওয়ায় বাংলা ভাষায় নিজের মনের কথা লিখতেন। তারপর তা ছোটবোনকে
দিয়ে ইংরেজিতে অনুবাদ করিয়ে বিদেশি বন্ধুদের কাছে পাঠাতেন। তাই তাদের সঙ্গে সম্পর্ক
বেশি দূর গড়াতে পারেননি সম্রাট। পত্রমিতাদের মধ্যে কারও কারও সম্পর্কের সুতো আঁটোসাঁটো
হলেও তিনি শুধু বন্ধুত্বে সীমাবদ্ধ রেখেছেন। তার বেশিসংখ্যক পত্রমিতা ছিলেন
বাংলাভাষী।
শখের বশে চিঠি লেখা এ মানুষটি ডাকটিকিটও সংগ্রহ করেন। সংগ্রহশালার একটি দেয়ালে তিনি টানিয়ে রেখেছেন বাংলাদেশের মানচিত্র। ডাকটিকিটি দিয়ে তৈরি করা এ মানচিত্র দেখিয়ে বলেন, ডাকটিকিট যেকোনো দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্মারক।
বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপালসহ দেশি-বিদেশি মিলে ২০
হাজারের বেশি ডাকটিকিট রয়েছে তার সংগ্রহে।
দুর্লভ মুদ্রা : পৃথিবীর অনেক দেশ হারিয়ে গেছে কালের বিবর্তনে। স্মৃতির স্মারক হিসেবে রয়ে গেছে সেসব দেশের মুদ্রা। এমন কিছু দেশের মুদ্রাও রয়েছে তার সংগ্রহে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাজ্য যেমন হায়দরাবাদ, বরোদা, গোয়ালিয়র, কুরাকাও মাদ্রাজের রুপা, তামা, নিকেল, কপার, ব্রোঞ্জ ও সংকর ধাতুর মুদ্রাও রয়েছে তার কাছে। এ ছাড়া আছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মুদ্রা, ব্রিটিশশাসিত ভারতের মুদ্রা, পাকিস্তান আমল এবং বাংলাদেশের মুদ্রা। মুদ্রাও একটি ইতিহাস বহন করে। মুঘল আমল থেকে শুরু করে ব্রিটিশ আমলের মুদ্রাও আছে তার সংরক্ষণে। প্রায় ১৫০টি দেশের মুদ্রা রয়েছে।
ছোটবেলা থেকে বই পড়া এবং সংগ্রহে রাখার অভ্যাস সম্রাটের। কয়েক
হাজার বই রয়েছে তার সংগ্রহে। ১৯৭৪ সালে তিনি খুলনা নিউমার্কেটের স্ট্যান্ডার্ড
পাবলিশার্স থেকে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যয়ের ‘বিন্দুর ছেলে’ বইটি এক টাকা দিয়ে
কিনেছিলেন। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে কেনা বইয়ের সেই রসিদ তার সংগ্রহে রয়েছে। খুলনার
সেই বইয়ের দোকানটি আর নেই। এমন অনেক বই কেনার রসিদ দেখা গেল তার সংগ্রহশালায়; যা
অতি যত্নে রেখেছেন। ডাকটিকিট, মুদ্রা, কাগজের নোট, চিঠিপত্র সম্পর্কিত বিষয়ে কোনো
ফিচার বা নিবন্ধ, প্রবন্ধ পত্রিকায় ছাপা হলে সেটাও তিনি সংগ্রহ করেন। পত্রিকা
কাটিংয়ের তিনটি অ্যালবাম রয়েছে তার কাছে। এখানে যে শুধু দেশের পত্রিকা কাটিং তা নয়,
ভারতের বিভিন্ন পত্রিকার কাটিংও রয়েছে।
১৯৯২ সালে ডাকটিকিট প্রদর্শনীতে তিনি এশিয়া গ্রুপে চ্যাম্পিয়ন হয়ে জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন। বিভিন্ন আঞ্চলিক প্রদর্শনীতেও প্রথম স্থান অধিকার করেছেন। এ কার্যক্রমের শুরুর দিকে তাকে নানান কটুকথাও শুনতে হয়েছে। এমনকি তার বাবা-মাও শুরুতে বিরক্ত হতেন। কিন্তু ডাকটিকিট প্রদর্শনীর জন্য জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্তির খুশিতে বাবা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। সেই দিনটি ছিল তার জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত।
বিচিত্র এ সংগ্রহশালার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি
অকপটে বলেন, ‘এ সংগ্রহের যেমন সামাজিক মূল্য আছে তেমন আর্থিক মূল্যও রয়েছে।’ কৌতূহল
প্রকাশ করলে তিনি সংগ্রহের মুদ্রা ও ডাকটিকিটের দিকে আঙুল তুলে বলেন, ‘এগুলোর
বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ৩০ লাখ টাকা। নিজে শখের বশে গড়েছি। আমার মৃত্যুর পর কী
হবে সেসব ভাবতে গেলে সংগ্রহের আনন্দ বা মজাটা পাব না।’ কিছু সময় ঝিম মেরে থেকে
মনজুর কাদের সম্রাট বলেন, ‘আমার যেহেতু সন্তানাদি নেই তাই এর ভবিষ্যৎ নিয়ে একটু
ভালোভাবে ভাবতে হবে।’