× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ফিলিস্তিনে রক্তভেজা ঈদের বার্তা

রাসেল পারভেজ

প্রকাশ : ০৬ এপ্রিল ২০২৪ ১২:৫০ পিএম

আপডেট : ০৬ এপ্রিল ২০২৪ ১২:৫২ পিএম

১৮০ দিন ধরে ইসরায়েলি বোমায়, গোলায় রক্তে রঞ্জিত ‍ফুটফুটে ছেলেটিকে, আদরের মেয়েটিকে; এক-দুটি ধ্বনিতে বা…বা…, মা…মা… বুলি ফোটা সন্তানকে, হাজার হাজার মাকে, বাবাকে কবরে শুইয়ে দেওয়ার মতো কত শত মর্মন্তুদ ঘটনার প্রবাহে এবার ঈদ আসছে ফিলিস্তিনিদের জন্য।

১৮০ দিন ধরে ইসরায়েলি বোমায়, গোলায় রক্তে রঞ্জিত ‍ফুটফুটে ছেলেটিকে, আদরের মেয়েটিকে; এক-দুটি ধ্বনিতে বা…বা…, মা…মা… বুলি ফোটা সন্তানকে, হাজার হাজার মাকে, বাবাকে কবরে শুইয়ে দেওয়ার মতো কত শত মর্মন্তুদ ঘটনার প্রবাহে এবার ঈদ আসছে ফিলিস্তিনিদের জন্য।

‘তখ্‌তে তখ্‌তে দুনিয়ায় আজি কমবখ্‌তের মেলা/শক্তি-মাতাল দৈত্যেরা সেথা করে মাতলামি খেলা’। সেই কত বছর আগে ‘ভয় করিয়ো না, হে মানবাত্মা’ কবিতায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম শক্তির বাহাদুরিতে অন্ধ-উন্মাদদের নিষ্ঠুরতার কথা বলে গেছেন। হত্যা-উন্মুখ দৈত্যরা দুর্বল জনগোষ্ঠীর জন্য কতটা নিষ্ঠুর খেলায় মেতে উঠতে পারে, তা তো নজরুল-মানসে ধরা পড়েছে সেই কবে। আজ যা দেখা যাচ্ছে ফিলিস্তিনের গাজায়। নির্বাক বিশ্ববাসীর সামনে নির্বিচার গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে জায়নবাদী আগ্রাসী শক্তি ইসরায়েল নামে জোর করে পত্তন করা দেশটি। পবিত্র রমজান মাসে যে হত্যাযজ্ঞ ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় চালাচ্ছে, তা কোনোভাবেই মানবিক পৃথিবীতে ঘটার কথা নয়; তবু ঘটছে- এ যেন মানুষ হত্যার উৎসব। রক্তাক্ত মরু ভূখণ্ডে মৃত্যুর নাদ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে প্রতিটি ক্ষুধার্ত দিনে। খেয়ে, না খেয়ে রোজা রাখার এসব কষ্টের দিনে চাঁদের ঘূর্ণনে আসছে ঈদের বার্তা।


৯ বা ১০ এপ্রিল আরব দেশগুলোর মতো চাঁদ দেখা সাপেক্ষে ফিলিস্তিনে পবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপন হওয়ার কথা। অথচ ১৮০ দিন ধরে ইসরায়েলি বোমায়, গোলায় রক্তে রঞ্জিত ‍ফুটফুটে ছেলেটিকে, আদরের মেয়েটিকে; এক-দুটি ধ্বনিতে বা…বা, মা…মা… বুলি ফোটা সন্তানকে, হাজার হাজার মাকে, বাবাকে কবরে শুইয়ে দেওয়ার মতো কত শত মর্মন্তুদ ঘটনার প্রবাহে এবার ঈদ আসছে ফিলিস্তিনিদের জন্য। গত বছরও গাজায় ঈদ হয়েছিল আতশবাজি, রঙিন জামা আর ঐতিহ্যবাহী খাবারে; এবার সেখানে শুধুই আকাশভরা হাহাকার, কবর আর গণকবরের শোকগাথা, বাবা-মা হারানো হাজারো এতিমের বুকফাটা চিৎকার। হয়তো ঈদের দিনটিও তাদের একই রকম কাটাতে হবে। খুশির দিনটি হয়তো ক্ষুধার জ্বালায়, চোখের জলে, কবরের কিনারে কাটবে তাদের। কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য যেন দিনটিতে ফিলিস্তিনিদের জন্য প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবেনÑ ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’। শতবর্ষেরও বেশি সময় ধরে স্বজন হারানোর স্মৃতি নিয়ে ঈদের দিন কাটাতে হলেও আনন্দ কমবেশি ছিল ফিলিস্তিনিদের। তবে এবার ঈদ আসছে নিষ্ঠুরতার এক অন্যরকম ঘৃণ্য নজির নিয়ে।

বিদ্রোহী নজরুল তখন টগবগে তরুণ, যখন ফিলিস্তিন ভাগ করে নেওয়ার সেই কুখ্যাত ‘সাইকস-পিকো’ গোপন চুক্তি হয়। বলছি, ১৯১৬ সালের ৯ মে তারিখের কথা। তারও আগে থেকে ইউরোপসহ বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে ফিলিস্তিনে আসা শুরু করে ইহুদিরা। যার অনিবার্য পরিণতি দেখা যায় ১৯৪৮ সালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বছরটিতে যুক্তরাষ্ট্রের সার্বিক সহযোগিতায় ফিলিস্তিনকে নিজেদের দেশ ঘোষণা করে জায়নবাদী ইহুদিরা। লাখ লাখ ফিলিস্তিনিকে নির্যাতন করে, খুন করে তাদের ঘরবাড়ি থেকে বের করে দেয় তারা। শুরু হয় আরব ও ইসরায়েল যুদ্ধ। সেটিই ছিল মূলত ফিলিস্তিনি জাতিগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার প্রথম অপচেষ্টা, যা আজও চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। নিশ্চিহ্ন হওয়া, না-হওয়ার প্রশ্নে রক্ত ও আত্মাকে উৎসর্গ করে টিকে আছে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠী, খোলা আকাশের নিচে বিশ্বের বৃহত্তম কারাগারখ্যাত গাজার ফিলিস্তিনিরা।

১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের ধ্বংসলীলাকে ফিলিস্তিনিরা দুটি অভিধায় চিহ্নিত করে থাকে। এক. আল-গুরবা অর্থাৎ নির্বাসন। দুই. আল-নাকবা অর্থাৎ ধ্বংস বা বিপর্যয়শব্দ দুটি ফিলিস্তিনি অভিধানে নিপীড়নের তাজা ক্ষতচিহ্ন বয়ে চলেছে৭৬ বছর ধরে এমন নাকবার মধ্য দিয়ে তাদের যেতে হচ্ছে। কারণ, আরও অনেকবার ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড দখল করতে বর্বর হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এবার যেন তার চূড়ান্ত রূপ দেখাচ্ছে তারা। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ইসরায়েলের নির্বিচার গণহত্যা অভিযান নিয়ে মানবতাবাদী বিশ্ব প্রতিবাদী চিৎকার করে গেলেও নিরীহ ফিলিস্তিনিদের হত্যায় পিছপা হচ্ছে না ইসরায়েল। উপরন্তু তাদের ইন্ধন দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, তাদের আইনপ্রণেতা ও উগ্রবাদী ইহুদি ব্যবসায়ীরা। যেমনÑ ১ এপ্রিল এক মার্কিন সিনেটর ইসরায়েলকে পরামর্শ দিয়েছেন, হিরোশিমা-নাগাসাকির মতো গাজায় হামলা চালিয়ে এই যুদ্ধের ইতি টানতে। আণবিক বোমা ফেলে জাপানের এই দুটি শহর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শ্মশান বানিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। এ কী বিভীষিকাময় মনুষ্যত্ব! যেখানে গাজার ক্ষুধার্ত মানুষ পবিত্র রজমানে ধুঁকছে আর কখন বোমার আঘাতে মৃত্যু হয়, সেই ভয়ে দিন কাটাচ্ছে।


ফিলিস্তিনে রমজান ও ঈদে খুশির আবহ দেখা যায়। ঈদের আয়োজন শুরু হয় রমজান ঘিরেই। নিপীড়নের শৃঙ্খলে বাঁধা থাকলেও ধর্মীয় বিধান, আচার, ঐতিহ্য পালন ও উদযাপনে তাদের আগ্রহ দেখা যায়। রমজান মাসে ফিলিস্তিনি রবদের ঘরে ঘরে জ্বলে ওঠে বাতি। মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসে। সবার বাড়িতে ইফতারির আয়োজন থাকে। পবিত্র রমজান মাসটি ফিলিস্তিনিদের জন্য কিছুটা উৎসবই বয়ে আনে। অথচ এবার ফিলিস্তিন, বিশেষ করে গাজার চিত্রটা আলাদা। খাবার, পানিÑ ইফতারের সব খাদ্যসামগ্রীই এবার যেখানে অনিশ্চিত। আনন্দঘন আয়োজনের বদলে বাবা-মাকে দেখতে হচ্ছে ক্ষুধার্ত সন্তানদের বিমর্ষ মুখ। সব আনন্দ কেড়ে নিয়েছে ইসরায়েলের নৃশংসতা।


অথচ এই ফিলিস্তিনেই রোজা মানে ছিল উৎসব, মানুষে মানুষে সমবেত আয়োজন। গত বছর মার্চ-এপ্রিলে রমজানে গাজায় দেখা গিয়েছিল সাজানো-গোছানো ঘরবাড়ি ও সড়ক রমজান উপলক্ষে লন্ঠন, রঙবেরঙের বাতি জ্বালাতে দেখা গিয়েছিলসমবেত ইফতারে নানা পদে খাবার ছিল। সড়কে-গলিতে ছিল মানুষের আনাগোনা। আনন্দে মাততে দেখা গিয়েছিল শিশুদের। এবার তার কিছুই নেই। ফলে রমজান শেষে এবার পবিত্র ঈদুল ফিতর শোকে আর পরিতাপে কাটবে ফিলিস্তিনিদের। হয়তো সেদিনও তাদের পোশাক ভিজে যাবে ইসরায়েলের বোমার আঘাতে; গুলি ও গোলায় ঝাঁঝরা হবে কোনো না কোনো মায়ের বুক। অথচ গত বছরও ঈদুল ফিতরের চিত্র ছিল উৎসবমুখর।

যেমন ছিল ২০২৩ সালের ঈদুল ফিতর

২০২৩ সালের ২১ এপ্রিল ফিলিস্তিনে ঈদুল ফিতর উদযাপন হয়। ফিলিস্তিন ইনফরমেশন সেন্টার ২০ এপ্রিল ঈদের প্রস্তুতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। তাতে বলা হয়, ঈদুল ফিতর হলো আনন্দদায়ক একটি উৎসব, যা ফিলিস্তিনে তিন ধরে উদযাপন করা হয়। পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন মিলেমিশে আনন্দ ভাগ করে নেওয়া, খাবার ভাগ করে নেওয়া এবং পরস্পরের সঙ্গে দেখা করার আয়োজনে ব্যস্ততার বর্ণনা ছিল ওই প্রতিবেদনে।

প্রতি বছরের মতো গত বছরও গাজা উপত্যকার সমস্ত শহর ও গ্রামজুড়ে ঈদের জনপ্রিয় খাদ্যসামগ্রীর মধ্যে অন্যতম ‘কাক’ ও ‘মামুল’ বেকিংয়ের ঘ্রাণ পাওয়া যায়। তার সঙ্গে কুকি খেজুরের পেস্ট বা বাদাম থাকে। ঈদের দিন এসব খাবারের সঙ্গে থাকে চা বা কফি। প্রতি বাড়িতে তৈরি করা ঈদের খাদ্যসামগ্রী নারীরা আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন।

গত বছর ঈদুল ফিতরের আগের দিন শাতি শরণার্থী শিবিরের তিন সন্তানের মা ওম আহমাদ আবু জাইদাহ বলেছিলেন, ‘আমি কাক ছাড়া ঈদ কল্পনা করতে পারি না! পরিবারের নারী সদস্যরা ভাগাভাগি করে কেউ ময়দা মাখে, অন্যরা তা গোলাকৃতির করে দেয় এবং অন্যরা তা সেঁকে কাক তৈরি করে। ঈদের এই খাবারের ঘ্রাণ বেশ খানিকটা দূর থেকে পাওয়া যায়। এটি মুখে পানি আনা ঐতিহ্যবাহী খাবার বটে।’

ঈদের আগে ফিলিস্তিনের সাধারণ বাজারগুলোতে নতুন পোশাক কেনা মানুষের ভিড় দেখা যায়। গত বছরও তা ছিল। বাড়িঘরও পরিষ্কার করতে দেখা যায়। ঘরের দেয়ালে রঙিন প্রলেপ পড়ে। দলবেঁধে পরিবারের সদস্যদের কবর জিয়ারত করতে দেখা যায়। এবারও ফিলিস্তিনিদের কবরের পাশে দেখা যাবে, দেখা যাবে না রঙিন প্রলেপ দেওয়া বাড়ির দেয়াল, পরিচ্ছন্ন ঘরদ্বোর, নতুন পোশাক। জালিম ইসরায়েলের নৃশংসতায় স্বজন হারানোর বেদনা আর শোক-স্মৃতি নিয়ে কাটবে ফিলিস্তিনিদের ঈদ।

৭ অক্টোবর থেকে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের আগ্রাসনে প্রাণ হারিয়েছে অন্তত ৩৩ হাজার মানুষ, যার মধ্যে শিশুই ১৩ হাজারের বেশি। গত ঈদে দোলনা ও গোলচত্বরে খেলা করেছিল ওরা। এবার তারা কবরে ঘুমিয়ে আছে, অনেকের কবরও চিহ্নিত করা যায়নি। ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়া বহু শিশুকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। বাবা-মা ও পরিবারের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শরণার্থী শিবিরে অনিশ্চিত দিন গুনছে যে শিশুরা, এবার তাদের কপালে চুমু দিয়ে আদর করে ঈদের নামাজ পড়তে পাঠাবেন কে? তার উত্তর দেওয়ার কেউ নেই। গাজা উপত্যকায় ঈদের আগাম বার্তা তাই এবার শুধু মরু-ধূসর।

  • লেখক : সাংবাদিক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা