× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

অটিজম সচেতনতা

চোখে তার শিশিরের ঘ্রাণ...

বাসন্তি সাহা

প্রকাশ : ০৩ এপ্রিল ২০২৪ ১১:০২ এএম

চোখে তার শিশিরের ঘ্রাণ...

বাবি আজ হাত দিয়ে ভাত খেলো। শুকনো ভাত একটু দলা পাকানো। সে হাত দিয়ে খেলো। ছড়াল। তারপর উঠে হাত ধুয়ে গিয়ে বসল কম্পিউটার টেবিলে। বাবি এক বেলা ভাত এভাবেই খায়। শুধু ভাত। যতটা না খায় তার চেয়ে ছড়ায় অনেক বেশি। তবু আমি তাকে একবার খেতে দিই এভাবে। বাকি বেলার ভাত আমি খাইয়ে দিই। বাবির ১৪ বছর চলছে। কৈশোর-বয়ঃসন্ধির সব লক্ষণ তার শরীরে কিন্তু সে এখনও নিজের হাতে ভাত খেতে পারে না।

এই তো সেদিন বাবি ঠিকঠাক মোজা পরতে পারল। কয়েক দিন ধরে চেষ্টা করছিল। দূর থেকে দেখেছি। তাকে চেষ্টা করতে দিয়েছি। বাবির মতো বয়সি একটা বাচ্চার হাত দিয়ে ভাত খাওয়া বা মোজা পরাটা আহামরি কী! কিন্তু একটা ‘স্পেশাল’ বাচ্চার জন্য এগুলো একটা একটা মাইলফলক ছুঁয়ে যাওয়া। প্রত্যাশা, দুঃখ, কষ্ট সবই একসময় কমে যায়। শান্ত দিঘির মতো নিস্তরঙ্গ জীবন চলে। তার মধ্যে মাঝে মাঝে ছোট ছোট ঢেউ জেগে ওঠে কেউ ঢিল ছুড়লে। এই একটু একটু পারাটা তেমনই।

বাবিকে নিয়ে যখন প্রথম দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছি, এ ডাক্তার-ও ডাক্তার; এ কাউন্সিলর থেকে ও কাউন্সিলর করছি, তখন সবাই বলেছিল সাত-আট বছরের পর আর কিছু শিখবে না। চারপাশের পরিবেশের সঙ্গে ব্রেনের কানেকশন তৈরি করা চার-পাঁচ বছর বয়সের মধ্যেই হয়ে যায়। আমি কারও কথা শুনিনি। একসময় এ নিয়ে অনলাইনে পড়াও বন্ধ করেছি। তারপর বাবিকে জেনেছি, বাবিকে দেখেছি, বাবি আর আমার মধ্যে একটা বোঝাপড়া তৈরি করেছি। ওর চোখের ভাষা পড়তে শিখেছি।

নামিয়ে দিয়ে এসেছি সব বোঝা,

তরী আমার বেঁধে এলেম ঘাটে---

পথে পথে ছেড়েছি সব খোঁজা,

কেনা বেচা নানান হাটে হাটে। 

(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)


আমরা এখন সবাই কমবেশি অটিস্টিক শিশুদের সম্পর্কে জানি। একজন অটিস্টিক বাচ্চার মা হিসেবে এখন দেখলেই বুঝতে পারি বাচ্চাটার অটিজম আছে। অটিস্টিক শিশুর বিকাশ তিনটি ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনে বাধা, অন্য কোনো ব্যক্তির প্রতি আগ্রহ না থাকা, কে কী করছে তা নিয়ে কৌতূহল না থাকা, অন্যের আচরণ বুঝতে না পারা। কথা বলতে না শেখা, কোনোমতে কথা বলতে পারলেও অন্যের সঙ্গে আলাপচারিতায় সমর্থ না হওয়া। অটিস্টিক শিশুর মধ্যে আচরণের ভিন্নতা লক্ষ করা যায়।

অনেকে পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ করে। অর্থাৎ একই কাজ বারবার করে। এই তো সেদিন রবীন্দ্রসরোবরে দেখি একজন ব্যক্তি হাতে পুতুল নিয়ে পুতুলটা ঘোরাচ্ছে। অনবরত ঘোরাচ্ছে আমার বুঝতে বাকি রইল না সে অটিজমে আক্রান্ত। বাবিও ছোটবেলায় কিছু পেলে কেবল ঘোরাত। বুকের মধ্যে একটা ধাক্কা লেগেছিল তখন। কেন? ওর টুইন বোন তো এটা করছে না!

অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ ও আচরণে সীমাবদ্ধতা অটিস্টিক শিশুর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যেমন নাম ধরে ডাকলে সাড়া দেয় না। চোখে চোখে তাকায় না। কোনো খেলনা বা আনন্দদায়ক বস্তুর প্রতি আকৃষ্ট না হওয়া, কারও আদর পেতে না চাওয়া, কোলে উঠতে না চাওয়া, পায়ের গোড়ালি উঁচু করে হাঁটা ইত্যাদি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, অটিজমের সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ এখন পর্যন্ত নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। তবে কিছু বিজ্ঞানী মনে করেন, অটিজমের পেছনে দুটি কারণ রয়েছে। জিনগত ও পরিবেশগত। অটিজমে আক্রান্ত শিশুর জিন ‘কপি নম্বর অব ভ্যারিয়েন্ট’ নামক ত্রুটি বহন করে।

যদিও বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেখা গেছে, স্বল্প ও মধ্যম মাত্রার অটিজম প্রাথমিক অবস্থায় ধরা গেলে এবং সঠিকভাবে পরিচর্যা ও শিক্ষা পেলে রোগের উপসর্গ অনেকাংশ কমানো যেতে পারে। কিন্তু বাস্তবে খুব কম শিশুই নিজে একা একা স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, বেশিরভাগ অটিস্টিক শিশু অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। প্রতি ১০ অটিস্টিক শিশুর মধ্যে একজনের ছবি আঁকায়, গানে, গণিতে বা কম্পিউটারে প্রচণ্ড দক্ষতা থাকে। অটিস্টিক শিশুকে ঠিকমতো পরিচর্যা করতে পারলে পরবর্তী সময়ে সমাজে অনেক কিছু দিতে পারে। আমিও এমন ভাবতাম কিন্তু প্রত্যাশাগুলো কমে এসেছে। মিরাকল ঘটবে তা-ও মনে হতো একসময়। রূপকথার গল্পের মতো যে দিনগুলো শুরু হয়েছিল সেই দিনগুলো আজ দুশ্চিন্তার। কোথাও তাকে রেখে গেলেই মনে হয় বাবি ঠিক আছে তো! কী করছে! শুধু নিরাপদে আছে প্রত্যাশা কেবল এটুকুই। আজ মাঠের ঘাসের গন্ধ বুকে তার, চোখে তার শিশিরের ঘ্রাণÑএটুকুতেই মায়ের দিনরাত চলে যায়!


যারা স্পেশাল বাচ্চার বাবা-মা তারা চারপাশের অভিজ্ঞতাগুলো নেবেন, বিশেষজ্ঞ, কাউন্সিলরদের কথা শুনবেন কিন্তু নিজের বাচ্চাকে জানার চেষ্টা করবেন বেশি। কারণ প্রতিটি বাচ্চার লেভেল আলাদা, সমস্যা আলাদা। তাকে সেভাবেই মোকাবিলা করতে হবে। যেমন স্পেশাল বাচ্চারা বেশিরভাগ সময় ওয়াশরুমে কাপড় পাল্টাতে চায় না। ওদের অভ্যস্ত তো করতে হবে, বড় হচ্ছে। ভাবতে ভাবতে মনে হলো, একটা কিছু দিতে হবে যাতে ও ভাবে আমার এখানে এ কাজটি করতে হবে। যেমন ওয়াশরুমে একটা টুল রেখেছি ওর বসার মতো হাইটের। সেখানে ওর প্যান্ট রাখা থাকে যেন ও প্রয়োজনে ওটা ওখানে চেঞ্জ করে আসতে পারে। ওর প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো ওর হাতের কাছে রেখে দিয়ে লক্ষ করতে হবে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো ও নেয় কি না।

ওরা জানে চামচ দিয়ে পায়েস খেতে হবে, তাই পায়েস খাওয়ার ছোট চামচটা যেন ওর হাতের কাছে থাকে। না হলে ও ডালের চামচ নিয়ে পায়েস খাওয়ার চেষ্টা করবে। অন্যরা দেখে হাসবে আর আপনার বুক ভেঙে যাবে। আপনার যারা খুব কাছের তাদেরও কিছু এসে যায় না আপনার বাচ্চা নিয়ে। তাই বাচ্চাকে সময় দিন। নিজেকে সময় দিন। পরিবারের অন্যদের যত্ন, দায়িত্ব যদি বাড়তি এনার্জি ও সময় থাকে তখন করবেন। এ দিনগুলো কেটে গিয়ে খুব ভালো সময় আসবে তা না-ও হতে পারে। প্রতিদিন নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ সামনে আসবে। নিজেকে তৈরি করতে হবে।

গত জন্মের স্মৃতির মতো মাঝে মাঝে শীতের পাতা ঝরার ঝিরঝির শব্দ টের পাই। বাকিটা সময় সবটা জুড়ে কেবল বাবিই থাকে। তাই অনায়াসে উপেক্ষা করতে পারি বেড়াতে যাওয়ার প্রলোভন। শীতের সকালে কম্বলের ওমের মধ্যে বসে কফি খাওয়ার উষ্ণতা আর যখন তখন বেরিয়ে পড়ার আনন্দ। জীবন যখন যেমন আসে সেভাবেই নিয়েছি। তবু মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে করে ডুব দিয়ে পুরোনো জীবনটা তুলে নিয়ে আসি।

কোন্‌ সাগরের পার হতে আনে

কোন্‌ সুদূরের ধন!

ভেসে যেতে চায় মন,

ফেলে যেতে চায় এই কিনারায় 

সব চাওয়া সব পাওয়া॥ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরো ডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজম (ইপনা)-এর গবেষণায় উঠে এসেছে, প্রতি ১০ হাজারে গ্রামে ১৪ এবং শহরে ২৫ শিশু অটিজম বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন। তবে মেয়েশিশুর চাইতে ছেলেশিশু অটিজম আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় আড়াই গুণ বেশি।

বর্তমান সরকার অটিজমসহ সব প্রতিবন্ধী ব্যক্তির উন্নয়নে ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩’ এবং ‘নিউরো ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন ২০১৩’ নামে পৃথক দুটি আইন প্রণয়ন করেছে। যেখানে সরকারের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি কল্যাণমুখী দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে সাংবিধানিক অধিকারভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ পেয়েছে। এ আইন দুটিতে একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জীবন ও সুরক্ষার প্রতিটি বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যমতে, হাসপাতালটির শিশু নিউরোলজি বিভাগে প্রতিদিন দেড়শ থেকে দুইশ অটিজম শিশু চিকিৎসা নিতে আসে। সে হিসেবে নতুন-পুরান মিলিয়ে প্রতি মাসে ৩০ হাজারের বেশি অটিজমে আক্রান্ত শিশু চিকিৎসা নিতে আসে। জানা গেছে, বিএসএমএমইউ ছাড়াও দেশের ৩৪টি মেডিকেল হাসপাতালে অটিজম আক্রান্তদের চিকিৎসায় একটি করে শিশু বিকাশ কেন্দ্র রয়েছে। এর বাইরে অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন, প্রয়াসসহ আরও বহু প্রতিষ্ঠান বেসরকারিভাবে কাজ করছে।

লেখক : কোঅর্ডিনেটর, রিসার্চ অ্যান্ড ডকুমেন্টেশন দ্বীপ উন্নয়ন সংস্থা


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা