রনি রহমান
ইমাম মেহেদী
প্রকাশ : ৩০ মার্চ ২০২৪ ১৩:০৬ পিএম
কুষ্টিয়ার পৌর গোরস্থানে শহীদ রনি রহমানের কবর
১৯৭১ সালে বৃহত্তর কুষ্টিয়ায় প্রতিরোধযুদ্ধে প্রথম শহীদ হন রনি রহমান। পুরো নাম দেওয়ান মিজানুর রহমান রনি হলেও রনি রহমান নামেই পরিচিত। রনির বাড়ি রংপুরে হলেও কুষ্টিয়ায় বোনের বাড়ি এসে ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ হানাদারদের গুলিতে শহীদ হন।
রংপুর জিলা স্কুলের শিক্ষক মোস্তাফিজুর রহমান ও গৃহিণী রহিমা খাতুনের ছোট সন্তান রনির জন্ম ১৯৪৯ সালের ১২ নভেম্বর রংপুর শহরের পাকপাড়ায়। রংপুর সরকারি কলেজে স্নাতকের ছাত্র থাকাবস্থায় সহপাঠীদের নিয়ে ’৭১-এর ২১ ফেব্রুয়ারি রংপুর প্রেস ক্লাবে লাল সবুজ পতাকা উত্তোলন করেন। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র এনে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে শাসকগোষ্ঠী। ফলে গ্রেপ্তার এড়াতে রনি রংপুর ছেড়ে কুষ্টিয়ায় বোনের বাড়ি চলে আসেন।
কুষ্টিয়া শহরের এনএস রোডের সদর উদ্দিন ম্যানসনের ভাষাসৈনিক নজম উদ্দিন আহমেদ ছিলেন রনির সেজ বোন রুহ আফজার স্বামী। কুষ্টিয়ায় এসেও তিনি স্থানীয় ছাত্রনেতাদের সঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ২৬ মার্চ রাতে যশোর সেনানিবাস থেকে মেজর শোয়েবের নেতৃত্বে ২৭ বালুচ রেজিমেন্টের প্রায় ২০০ সেনা কুষ্টিয়া প্রবেশ করে জিলা স্কুল, ওয়্যারলেস গেট ও পুলিশ লাইনসে অবস্থান নেয়। ২৬ মার্চ থেকে কুষ্টিয়া শহরে কারফিউ জারি করে। রাতের অন্ধকারে বন্ধুরা মিলে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের বিজ্ঞান গবেষণাগারের তালা ভেঙে বিস্ফোরক নিয়ে আসেন রনি। সহযোদ্ধাদের নিয়ে রাতেই পেট্রোল ও বিস্ফোরক দিয়ে বোমা তৈরি করেন।
২৭ মার্চ সকালে সহযোদ্ধা আবদুল জলিল, শামসুল হাদী, আ স ম আখতারুজ্জামান মাসুম, মতিউর রহমান মতি ও অন্যদের নিয়ে রনি বর্তমান সিভিল সার্জন অফিস সংলগ্ন ‘নিজামত উল্লাহ ভবন’-এর কাছে যান। সবাইকে পেছনে রেখে তিনি বোমা নিয়ে ওই ভবনের ছাদে উঠে অপেক্ষা করতে থাকেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর টহলগাড়ির। একসময় হানাদার বাহিনীর গাড়ি এগিয়ে আসতে থাকে। বোমা নিক্ষেপে প্রস্তুত রনি রহমানকে ছাদে দেখেই গুলি করে পাকিস্তানি বাহিনী। আর বোমা নিক্ষেপ করতে পারেননি; মাথায় গুলি লাগায় ছাদ থেকে রাস্তায় পড়ে শহীদ হন রনি রহমান। মৃত্যুর পর পাকিস্তানি বাহিনী রনির লাশ টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায়। হানাদার বাহিনী কিছু সাধারণ মানুষের সহযোগিতায় কুষ্টিয়া পৌর গোরস্থানে গর্ত খুঁড়ে রনি রহমানকে মাটিচাপা দেয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে কুষ্টিয়ার প্রথম শহীদ হিসেবে রনি রহমান জীবন উৎসর্গ করলেন। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকেও গুরুত্বের সঙ্গে এ খবর প্রচারিত হয়েছিল।
রনি রহমানের সহযোদ্ধা কুষ্টিয়া শহরের বীর মুক্তিযোদ্ধা আ স ম আখতারুজ্জামান মাসুম সাক্ষাৎকালে জানান, ‘রনি রহমান আমার বাড়ির পেছন দিক থেকে পাড়ার ভিতর দিয়ে এসে বাড়ির ভিতর ঢুকল। তারপর বলল, আমি একটা বোমা বানিয়েছি। হাতে একটা বোতলের মতো। পেট্রোলবোমা। এটা আর্মির গাড়িতে মারতে হবে। ওখানে আমরা ছাত্রলীগের আরও কয়েকজন ছিলাম। বললাম, ভালো কথা, চলো যাই। আর্মিরা টহল দিচ্ছে, মারতে হবে। আমরা ছাত্র। বুকে খুব সাহস। এত কিছু ভাবার সময়ও নেই। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর পুরো জাতি ঐক্যবদ্ধ। তখন এই যে এখনকার পলাশ স্টোর, তখন ওইখানে একটি বিল্ডিং ছিল। আমরা নিজামত উল্লাহ সংসদ নামে পাড়ায় একটি ক্লাব চালাতাম। ওইটার দোতলায় ছাদে। এক তলা একটা লাল বিল্ডিং। আমরা ভাবলাম দোতলায় উঠে এটা করব। রনি আগে, আমি তার পরে। আমরা সাত-আট জন। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠব। একেবারে দরজার কাছে গিয়ে ছাদে ওঠার যে জায়গাটা, রনি এক পা ছাদে দিয়েছে আর এক পা নিচে সিঁড়িতে। আমি তার পেছনে। হঠাৎ একটা গুলির শব্দ হলো আর রনি পড়ে গেল। যখন রনি পড়ে গেল তখন আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেলাম। কারণ আমাদের হাতে কোনো অস্ত্র নেই।’
রনির বড় ভাই দেওয়ান মাসুদুর রহমান জনি। জীবদ্দশায় বহু বছর ধরে ছোট ভাইয়ের আত্মত্যাগের স্বীকৃতির আশায় ছুটে গেছেন বিভিন্ন অফিস-আদালতে। মৃত্যুর আগে দেশপ্রেমিক ছোট ভাই রনির মূল্যায়ন দেখে যেতে চান। তিনি বলেন, ‘রনির নাম তালিকাবদ্ধ করার জন্য মন্ত্রণালয়ে অনেকবার গিয়েছি। বিভিন্ন সময় আবেদন করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় মুক্তিযুদ্ধের এত বছরেও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আজও ঠাঁই পায়নি সরকারি তালিকায়। কুষ্টিয়া-রংপুর চিঠি চালাচালির মধ্যেই আটকে রয়েছে। আমরা আশা ছেড়ে দিয়েছি। সবাই রনির অবদান স্বীকার করে কিন্তু শহীদ মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম ওঠে না!’
আশির দশকে রংপুরে যখন অনেক সড়কের নামকরণ হয়েছিল শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামে; তখন গোমস্তাপাড়ার পাকপাড়াসংলগ্ন একটি রাস্তার নামকরণ হয়েছিল শহীদ রনি রহমানের নামে। এখন আর সে নামফলকের দৃশ্য নেই। সাধারণ মানুষও ভুলতে বসেছে এই শহীদ মুক্তিযোদ্ধাকে।